ঢাকা ২১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, বুধবার, ০৪ জুন ২০২৫
English

বাংলার নামে কাঠঠোকরা

প্রকাশ: ২৭ জুলাই ২০২৪, ০৯:২০ এএম
আপডেট: ২৭ জুলাই ২০২৪, ০৯:২১ এএম
বাংলার নামে কাঠঠোকরা
ছবি: লেখক

পাখির নাম ‘বাংলা-কাঠঠোকরা’! বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে সহজেই এর দেখা মেলে। পার্বত্য এলাকা ছাড়া ভারতের অনেক জায়গাতেই আপনি এ পাখি দেখতে পাবেন। কিন্তু বাংলাদেশ ও ভারত ছাড়া বিশ্বের আর কোথাও এ পাখির দেখা মিলবে না সহজে। 

আমাদের পাশের দেশ মায়ানমার, নেপাল ও ভুটানেই নেই এ পাখি। আমরা তাই সাদরে এর নাম রেখেছি ‘বাংলা-কাঠঠোকরা’। আমাদের আর দোষ কী; প্রাণীর আন্তর্জাতিক নামকরণের জনক ‘কার্ল লিনে’ নিজেই এর নামে ‘বেঙ্গল’ কথাটা জুড়ে দিয়েছিলেন। তাই বাংলা-কাঠঠোকরার আন্তর্জাতিক নাম হয়েছে ‘ডাইনোপিয়াম বেঙ্গলেন্স’। 

বাংলার বৃক্ষঘেরা পাড়াগাঁয়েই শুধু নয়; কংক্রিটের এই কঠিন নগরীতেও আপনি বাংলা-কাঠঠোকরার দেখা পাবেন। হয়তো দেখতে পাবেন প্রাচীন কোনো পথতরুর কাণ্ড আঁকড়ে ধরে সে নীরবে বসে আছে। বৃষ্টি নামলে প্রায়ই দেখবেন, মাটি ছেড়ে পিঁপড়ার দল পড়িমরি করে গাছের গা বেয়ে ওপরে উঠছে। পিলপিল করে গাছ-বাওয়া ওই পিঁপড়া বাহিনীই হলো অপেক্ষমাণ কাঠঠোকরার জন্য ধাবমান আহার্যের অসামান্য এক কনভেয়র বেল্ট। পাতাভুক কীটপতঙ্গ দমন করতে পৃথিবীতে যেমন পিঁপড়ার দরকার আছে; পিঁপড়ার বাড়বাড়ন্ত রোধ করার জন্য তেমনই প্রয়োজন রয়েছে কাঠঠোকরার। 

তাই বিশ্বের তাবৎ বনে ও বাগানে সারা দিনমান কীটপতঙ্গ ও পিপীলিকা দমনের কাজটি করে যায় কাঠঠোকরাদের বিশাল বাহিনী। পৃথিবীতে আছে ২৫৬ প্রজাতির কাঠঠোকরা এবং বাংলাদেশের মতো ছোট্ট এই দেশেও রয়েছে ২০টি প্রজাতির বসবাস। আমাদের জন্য আরও আকর্ষণীয় সংবাদ, বাংলাদেশেই বাস করে বিশ্বের বৃহত্তম ও ক্ষুদ্রতম কাঠঠোকরা। বিশ্বের অতিকায় কাঠঠোকরাদের অন্যতম হলো বাংলাদেশের পাহাড়ি-বনের এক বিরল বাসিন্দা, যার বাংলা নাম ‘বড় মেটেকুড়ালি’। খুদেদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘তিলা কুটিকুড়ালি’ ও ‘ধলাভ্রু কুটিকুড়ালি’ এবং এই দুটি প্রজাতিরই বসবাস আমাদের পাহাড়ি-বন ও সুন্দরবনে। 

খুদে ও অতিকায় ওই দুই ‘এক্সট্রিম’ বা প্রান্তিক কাঠঠোকরার মাঝামাঝি অবস্থান হলো আমাদের বাংলা-কাঠঠোকরার। এর চঞ্চু থেকে লেজের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত মাপলে ১০-১১ ইঞ্চি হয়। অর্থাৎ দৈর্ঘ্যে সে কুটিকুড়ালির দ্বিগুণ আর মেটেকুড়ালির অর্ধেক। বনের বাইরে মেটেকুড়ালি ও কুটিকুড়ালি দেখার আশা অত্যন্ত ক্ষীণ হলেও আপনি বাংলা-কাঠঠোকরার দেখা এ দেশের বনে, বাগানে ও লোকালয়ে সমানভাবে পাবেন। শীতকালে সহজেই দেখতে পাবেন এই পাখি তার অবিশ্বাস্য লম্বা লাল জিহ্বা দিয়ে খেজুরগাছের কাটা অংশ থেকে চেটে চেটে রস খাচ্ছে। 

মাথায় উজ্জ্বল সিঁদুরে টোপর আর পিঠে আগুন-রং পালকের জন্য বাংলা-কাঠঠোকরা আমাদের চোখে পড়েও বেশ সহজে। পিঠের এই আগুন-রং পালকের জন্যই এর চলতি ইংরেজি নাম ‘ফ্লেমব্যাক’ এবং পুরো নাম ব্ল্যাক-রাম্পড ফ্লেমব্যাক। ফ্লেমব্যাক নামে কাঠঠোকরা আছে পৃথিবীতে ১৪ আর বাংলাদেশে চার প্রজাতির। এর মধ্যে দুটি ফ্লেমব্যাক, বাংলা-কাঠঠোকরা ও বড় কাঠঠোকরা, এ দেশের লোকালয়েও আসে বলে আমজনতার পরিচিত পাখি। অন্য দুটি প্রজাতি- পাতি কাঠঠোকরা ও হিমালয়ী কাঠঠোকরা, বনে বাস করে বলে সচরাচর লোকের চোখে পড়ে না এবং দেখতে অনেকটা বাংলা-কাঠঠোকরার মতো বলে দক্ষ পাখিদর্শক ছাড়া কেউ আলাদা প্রজাতি বলে উল্লেখ করে না।

বসন্তকালে বাটালের মতো মজবুত চঞ্চু দিয়ে গাছের কাণ্ড কিংবা শাখায় কোটর কেটে সুরক্ষিত একটি বাসা বানায় বাংলা-কাঠঠোকরা। আর সব পাখির মতোই এরা এ বাসাটিকে ডিম দেওয়া ও ছানা পালনের জন্য অস্থায়ীভাবে ব্যবহার করে; বসবাসের জন্য নয়। মাত্র এক মাসের মধ্যে এরা ছানা নিয়ে সদ্যগড়া সে আঁতুড়ঘরটি ছেড়ে চলে যায়। তখন দোয়েল ও শালিকের মতো পাখি এসে এই পরিত্যক্ত কোটর দখল করে। প্রজননের জন্য এদের কোটরের প্রয়োজন হলেও এরা নিজে কোটর বানাতে পারে না। কাঠঠোকরা না থাকলে এদের মতো অনেক পাখিরই বংশ রক্ষা কঠিন হয়ে যেত। 

তাহলে দেখা যাচ্ছে যে পিঁপড়া ও কীটপতঙ্গ দমন ছাড়াও কাঠঠোকরাদের আরও একটা কাজ রয়েছে; তা হলো নিরীহ পাখিদের জন্য আঁতুড়ঘর সরবরাহ করা। দুটো কাজই সারা জীবন সযত্নে করে যায় কাঠঠোকরা; মৃত্যুর এক দিন আগেও অবসরে যায় না।

ধূসর শিখীপর্ণ প্রজাপতি

প্রকাশ: ০২ জুন ২০২৫, ১১:৪৪ এএম
ধূসর শিখীপর্ণ প্রজাপতি
ঢাকার বাউনিয়া বাঁধের ধারে দেখা ধূসর শিখীপর্ণ প্রজাপতি। ছবি: লেখক

সম্প্রতি রাজধানীর মিরপুরের কালশী মোড় থেকে বাউনিয়া বাঁধ রোড ধরে যাচ্ছিলাম দেওয়ানপাড়ার দিকে। রাস্তার দুই ধারে নতুন নতুন বড় বড় দালান উঠছে আর রাস্তার ধারের ঝোপঝাড় উজাড় হচ্ছে, ভরাট হয়ে যাচ্ছে। বড় কোনো গাছপালা নেই, সবুজ যেন নিশ্চিহ্ন হতে চলেছে, জলাশয়ও। শেষমেশ কী আছে ঢাকা শহরের ভাগ্যে কে জানে। রাস্তার ধারে ধুলোমাখা শরীর নিয়ে কিছু লতা, বিরুৎ, তৃণ যেন উদোম মাটির সেই লজ্জা ঢাকার চেষ্টা করে চলেছে। কয়েকটা আসামলতার গাছ যেন সেই আব্রু ঢাকার প্রধান অবলম্বন, সঙ্গে সঙ্গ দিচ্ছে মলিন চাপড়া, উলু ও দূর্বা ঘাস, ত্রিধারা আগাছা। কোনো গাছেই কোনো ফুল নেই। এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গাছগুলোর গা পরিষ্কার হয়েছে। ত্রিধারার ওই দু-চারটা ফুলেই হয়রান হয়ে ছোটাছুটি করছে একটা প্রজাপতি। কোথাও যেন ওর আহার জুটছে না। ক্ষুধার্ত প্রজাপতি সাদাটে ত্রিধারা ফুল থেকে মধু খেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। অনবরত উড়তে উড়তে ক্ষণিকের জন্য সে ফুলে বসে একটু জিরিয়ে নিচ্ছে। অলস-ক্লান্ত ভঙ্গিতে ডানা চারটে দুই পাশে মেলে ধরে সে যেন প্রকৃতিমাতার কাছে প্রার্থনা জানাচ্ছে একরত্তি আহার আর আশ্রয়ের জন্য। ঢাকা শহরে গাছ নেই, ফুল নেই, ফল নেই, পাখি নেই, প্রজাপতি নেই- এ রকম একটা দৃশ্য কল্পনা করতেও ভয় হয়। যা দু-চারটা প্রজাপতির দেখা মেলে তার জন্য যেতে হয় নগর উদ্যানগুলোয়।

প্রজাপতিটা বিশ্রাম নিতেই ওকে চেনা গেল, ধূসর-বাদামি রঙের চমৎকার ডানা। বেশ বড়। দেহ ও ডানার ওপরের পিঠ ধূসর-সাদা, নিচের পিঠ কিছুটা হালকা রঙের। ডানাগুলোর প্রান্তের দিকে চারটি করে আড়াআড়ি গাঢ় বাদামি রঙের ঢেউ খেলানো দাগ বা রেখা রয়েছে। সামনের ডানার প্রান্তে ৬টি ও পেছনের ডানার শেষে ৫টি করে চক্রাকার বাদামি দাগ। দাগগুলো সরু গাঢ় বাদামি রেখা দ্বারা বেষ্টিত, ভেতরে কমলা রঙের মধ্যে এক প্রান্তে কালচে বাদামি ফোঁটা।  ডানার গোড়ার দিকটা দাগশূন্য ও একহারা ধূসর-বাদামি, দেহের রংও তাই। সব মিলিয়ে প্রজাপতিটা খুব বর্ণিল না হলেও দেখতে বেশ সুন্দর। 

এ প্রজাপতির বাংলা নাম ধূসর শিখীপর্ণ হলেও এর আরও কয়েকটি নাম আছে। কেউ কেউ বলেন ধূসরাক্ষী বা ধূসর-সোনালি চক্র প্রজাপতি। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে এর নাম চাঁদনরি। লেপিডোপ্টেরা বর্গের নিম্ফালিডি গোত্রের এ প্রজাপতির ইংরেজি নাম গ্রে প্যানজি, বৈজ্ঞানিক নাম জুনোনিয়া আটলিটিস। এ দেশে সহজে এদের সর্বত্র দেখা যায়। তবে প্রচুর বৃষ্টিপাতপ্রবণ খোলা জায়গায় এরা বিচরণ করতে বেশি পছন্দ করে। এরা উড়তে উড়তে খুব বেশি ওপরে ওঠে না, সাধারণত মাটির কাছাকাছি চলাচল করে। জলাধারের ঝোপজঙ্গলে এদের বেশি দেখা যায়। গাজীপুরে পুবাইলে জলজঙ্গলের কাব্য রিসোর্টে গত নভেম্বরেও জলাময় বিলের ধারে এদের অনেকগুলোকে উড়তে দেখেছিলাম। ধানখেতেও এরা বিচরণ করে। তালমাখনা, কেশুটি, হেলেঞ্চা, কেশরদাম, আসামলতা ইত্যাদি আগাছার ফুলে ফুলে এদের ঘুরতে দেখা যায়। 

পুরুষ প্রজাপতির চেয়ে মেয়ে প্রজাপতির দেহ একটু বড়। পুরুষ প্রজাপতির মিলনের ইচ্ছা হলে সে অনুচ্চ ঝোপের ওপর ওত পেতে বসে থাকে। একটা মেয়ে প্রজাপতি দেখলে তার পিছু পিছু উড়তে থাকে। মেয়েটাকে মিলনে রাজি করাতে সে নানাভাবে তার সঙ্গে সখ্য স্থাপনের চেষ্টা করে। এরপর একসময় দুজনে মিলনে যায়। মেয়ে প্রজাপতি গাছের পাতার ওপর ডিম পাড়ে। ডিমগুলো সেখানে তিন দিন পর ফুটে বাচ্চা বের হয়, বাচ্চারা সেসব গাছের পাতা খেতে খেতে বড় হয়। বাচ্চার দেহের রং হলুদাভ-কমলা, নলাকার, মাথা কালো ও দেহজুড়ে ছোট ছোট কাঁটার মতো অঙ্গ থাকে। পূর্ণতা পেলে বাচ্চা বা কীড়ার দেহ কালচে হয়ে যায়। মাথাটা কমলা পট্টিযুক্ত কালো হয়। বাচ্চা অবস্থায় থাকে ১২ থেকে ২২ দিন। এরপর ৫ থেকে ৯ দিন শূককীট অবস্থায় থাকার পর সেখান থেকে প্রাপ্তবয়স্ক প্রজাপতি হয়ে বেরিয়ে আসে। শূককীট বা পিউপার রং ধূসর বাদামি। ওদের জীবনচক্র শেষ হতে ২০ থেকে ৩২ দিন সময় লাগে। বাচ্চারা পাতা খায় ও প্রাপ্তবয়স্ক প্রজাপতিরা খায় ফুলের মধু। এ দেশে এদের সারা বছরই বেশ দেখা যায়, আপাতত বিলুপ্তির কোনো ঝুঁকি বা শঙ্কা নেই। এ দেশ ছাড়াও এ প্রজাপতি আছে নেপাল, ভারত, ক্যাম্বোডিয়া, দক্ষিণ চীন, ফিলিপিন্স, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায়। 

হুমকিতে সুন্দরবনের প্রাণবৈচিত্র্য

প্রকাশ: ০১ জুন ২০২৫, ০৯:৩২ এএম
হুমকিতে সুন্দরবনের প্রাণবৈচিত্র্য
সুন্দরবনের ভেতরে পর্যটকদের ফেলা ওয়ান টাইম প্লাস্টিকের খাবারের পাত্র । খবরের কাগজ

সুন্দরবনের সীমানা ঘেঁষে থাকা সাতক্ষীরার শ্যামনগরে বাড়ছে ‘ওয়ান টাইম’ প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার। বাজার থেকে গ্রাম সবখানেই মিলছে একবার ব্যবহারযোগ্য গ্লাস, প্লেট, চামচ ও বক্স। ব্যবহার শেষে ফেলে দেওয়া এসব বর্জ্য নদীতে গিয়ে পড়ে। জোয়ার-ভাটার কারণে তা ছড়িয়ে পড়ে সুন্দরবনের নদী ও খালে। পরিবেশবিদরা বলছেন, অপচনশীল এসব প্লাস্টিক সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গাছপালা ও প্রাণীকুল।

যেসব প্লাস্টিক পণ্য একবার ব্যবহারের পর আর কোনো কাজে লাগে না, সেগুলোই সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক (ওয়ান টাইম প্লাস্টিক) হিসেবে পরিচিত। স্থানীয় জলবায়ু কর্মীরা জানান, দেশের উপকূলীয় এলাকায় একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের পণ্যের ওপর হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। 

সম্প্রতি সরেজমিনে সুন্দরবনের বুড়িগোয়ালিনী, মুন্সীগঞ্জ, হরিনগর, নীলডুমুর, রমজাননগর এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, পাশের নদীতে ভাসছে নানা রকম প্লাস্টিক পণ্য ও পলিথিন। দেখা মিলেছে খাবারের প্লেট, পানির বোতল, চানাচুর ও চিপসের প্যাকেটসহ আরও অনেক বর্জ্যের।

স্থানীয়রা জানান, এসব এলাকায় যেকোনো সামাজিক অনুষ্ঠান, বনভোজন এবং দোকানে খাবার ও পানীয় পরিবেশন করতে প্লাস্টিক ব্যবহারের আশঙ্কাজনকভাবে প্রবণতা বেড়েছে। নদী ও সুন্দরবন থেকে ধরা মাছের পেটেও মিলছে প্লাস্টিক। অনেক মাছ, কচ্ছপ প্লাস্টিকে আটকে মারা যাচ্ছে। বনের ফাঁকা জায়গায় গাছপালা গজানোর হারও কমেছে।

গত ২০ বছর ধরে সুন্দরবনসংলগ্ন খোলপেটুয়া নদীতে নিয়মিত মাছের পোনা ধরেন জহুরা বিবি। তিনি বলেন, ‘জালে মাছের পরিবর্তে পলিথিন উঠে আসে। আজ থেকে পাঁচ বছর আগেও এমন ছিল না। লোকালয়ে এখন পলিথিন ব্যবহার বেড়েছে। ব্যবহার শেষে তারা নির্দিষ্ট স্থানে না ফেলে যেখানে সেখানে ফেলে দেন। সেগুলোই পরে নদীতে এসে পড়ে।’ 

নীলডুমুর বাজারের ব্যবসায়ী আল-আমিন হোসেন জানান, এখন মানুষ প্রায় সব কাজে প্লাস্টিক ও পলিথিন ব্যবহার করে। সুন্দরবন ভ্রমণে আসা পর্যটকরা এখন ওয়ান টাইম প্লাস্টিকের গ্লাস, প্লেট, চামচ ও বক্স ব্যবহার করেন। ব্যবহার শেষে নদীতেই ফেলা হয় এসব প্লাস্টিক। এ ছাড়া প্রতিদিনের পরিত্যক্ত প্লাস্টিক-পলিথিন ঝাড়ু দিয়ে নদীতে ফেলা দেওয়া হয়।’

নীলডুমুর বাজারের সুন্দরবনের মাছ কেনাবেচার সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ী শরিফ হোসেন। তিনি জানান, তিনি কাইন ও ভোলা মাছের পেটের মধ্যে পলিথিন পেয়েছেন। জেলেদের পলিথিনে জড়িয়ে মৃত কচ্ছপ নিয়ে ফিরতে দেখেছেন।

জলবায়ু কর্মী শাহিন আলম বলেন, স্থানীয় নদ-নদী দিয়ে প্লাস্টিক সুন্দরবনে ঢুকে যাচ্ছে। বুড়িগোয়ালিনী, মুন্সীগঞ্জ, হরিনগর, রমজাননগর, আটুলিয়া, গাবুরা- এসব এলাকার প্লাস্টিক যাচ্ছে কপোতাক্ষ, খোলপেটুয়া, চুনকুড়ি নদী হয়ে সুন্দরবনে। এ হুমকি ঠেকাতে ‘ওয়ান টাইম’ পণ্যের বিকল্প দরকার।

বন বিভাগের সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী রেঞ্জার এবিএম হাবিবুল ইসলাম বলেন, পর্যটকদের সুন্দরবন ভ্রমণের অনুমতি দেওয়ার সময় নদীতে প্লাস্টিকের পণ্য না ফেলার নির্দেশনা দেওয়া হয়। এ ছাড়া প্রতিটি ট্রলারে ডাস্টবিনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবুও অনেক পর্যটক নদীতে প্লাস্টিক ফেলেন। পাশের লোকালয় থেকেও সুন্দরবনে প্রচুর বর্জ্য চলে আসে। 

শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক ডা. তরিকুল ইসলাম বলেন, ওয়ান টাইম পণ্যে গরম খাবার পরিবেশন স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এসব পণ্যে রাখা গরম খাবার ও পানীয় খেরে হৃদরোগ, রক্তনালির অসুখ, নারীদের ব্রেস্ট ও ওভারিয়ান ক্যানসার এবং পুরুষের প্রোস্টেট ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোছা. রনী খাতুন জানান, সুন্দরবনের দুষণমুক্ত রাখার জন্য নানাভাবে চেষ্টা চলছে। যত্রতত্র প্লাস্টিক-পলিথিন না ফেলতে মানুষকে সচেতন করা হচ্ছে।

নীলগলা বসন্ত

প্রকাশ: ৩১ মে ২০২৫, ১০:০০ এএম
নীলগলা বসন্ত
পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার একটি কাঁঠালগাছে বসা নীলগলা বসন্ত। ছবি: লেখক

বাংলাদেশের অনেক জনপদে পাখি দেখতে গিয়েছি। কিন্তু পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় নীলগলা বসন্ত পাখির সবচেয়ে বেশি দেখা পেয়েছি। তেঁতুলিয়ার  যে পথ দিয়েই হেঁটেছি, সব জায়গাতেই এ পাখির ডাকাডাকি শুনেছি। এ পাখি সাধারণত গাছের ফল খেতে বেশি ভালোবাসে। বিশেষ করে পাকা পেঁপে, পাকা তেলকুচা ফল ও পাকা পেয়ারা খেতে পছন্দ করে। তা ছাড়া এ পাখি নানা রকমের কচি ফলও খায়। 

নীলগলা বসন্ত (Blue-Throated Barbet) বাংলাদেশের সুলভ আবাসিক পাখি। এরা বৃক্ষচারী পাখি। দেশের কোথাও কোথাও এ পাখি বসন্ত বাউরি নামে পরিচিত। বাংলাদেশে পাওয়া যায় পাঁচ প্রজাতির বসন্ত পাখি। এরা হলো নীলগলা বসন্ত, নীলকান বসন্ত, সেকরা বসন্ত, দাগি বসন্ত ও বড় বসন্ত।

নীলগলা বসন্ত ভারি সুন্দর সবুজ-নীল ও লাল মেশানো রঙের পাখি। দেহের সবুজ পালকের রং গাছের পাতার সঙ্গে মিশে যায় বলে পাখিটি অনেক মানুষেরই দৃষ্টিগোচর হয় না। এ কারণে পাখিটিকে অনেকেই বিরল প্রজাতি মনে করেন।

প্রাপ্তবয়স্ক পাখির সামান্য কিছু পালক ছাড়া দেহের পুরোটাই সবুজ ঘাস বর্ণের। তবে মুখ, গলা ও বুকের উপরিভাগ নীল পালক দিয়ে আবৃত থাকে। বুকের পাশে কালো পট্টি রয়েছে। কপাল লাল, কালো ও গাঢ় লাল হয়ে থাকে। ঠোঁট ফিকে ধূসর। কমলা-হলুদ সরু চোখের কিনারাসহ চোখ লালচে বাদামি। পা ও পায়ের পাতা সবুজাভ। ছেলেও মেয়েপাখি দেখতে একই রকম। 

নীলগলা বসন্ত সব বন, বাগানে বিচরণ করে। এরা সাধারণত একা বা জোড়ায় থাকে। এরা মাঝেমধ্যে অন্যান্য ফলাহারী পাখির মিশ্র দলে যোগ দেয়। সাধারণত এরা জোর গলায় দীর্ঘক্ষণ ধরে ডাকে কুটুরর... শব্দে। প্রজনন সময়ে প্রায় বিরতিহীনভাবে সারা দিন ডাকে। প্রজনন মৌসুমে পুরুষপাখি বেশি ডাকাডাকি করে। মার্চ-জুলাই মাস এদের প্রজননের সময়। এ সময় ভূমি থেকে ২ থেকে ৮ মিটার ওপরে গাছে গর্ত খুঁড়ে এরা বাসা করে। বাসায় ৩-৪টি ডিম পাড়ে। ডিমগুলোর রং সাদা।

ঝরে যায় কামিনী ফুল

প্রকাশ: ৩০ মে ২০২৫, ১০:৪৪ এএম
ঝরে যায় কামিনী ফুল
ঢাকার ওয়ারীর খ্রিষ্টান কবরস্থানে কামিনীগাছে ফোটা ফুল। ছবি: লেখক

১৮৯৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর শাহজাদপুর থেকে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘যেদিকে চেয়ে দেখি সেই দিকেই গাছের সবুজ ডাল চোখে পড়ে এবং পাখির ডাক শুনতে পাই, দক্ষিণের বারান্দায় বেরোবা-মাত্র কামিনী ফুলের গন্ধে মস্তিষ্কের সমস্ত রন্ধ্রগুলি পূর্ণ হয়ে উঠে।’ শাহজাদপুরের কুঠিবাড়ির বারান্দায় বসে কবি হয়তো শৈশবসংগীতের কামিনী ফুল কবিতাটি পাঠ করতেন- ‘ছি ছি সখা কি করিলে, কোন প্রাণে পরশিলে,/কামিনীকুসুম ছিল বন আলো করিয়া,/মানুষ পরশ ভরে শিহরিয়া সকাতরে,/ওই যে শতধা হয়ে পড়িল গো ঝরিয়া।/জান ত কামিনী সতী, কোমলকুসুম অতি,/দূর হতে দেখিবারে, ছুঁইবারে নহে সে/দূর হতে মৃদু বায়, গন্ধ তার দিয়ে যায়,/কাছে গেলে মানুষের শ্বাস নাহি সহে সে।...’

আগস্টের এক সকাল। ঢাকার ওয়ারী তখন ব্যস্ত হয়ে ওঠেনি, মানুষের কোলাহল নেই, যানজট নেই। যাব বলধায়, গেলাম তার ঠিক উল্টো দিকে রাস্তার ওপারে নারিন্দার খ্রিষ্টান কবরস্থানে। বিশাল এলাকাজুড়ে প্রাচীরবেষ্টিত সে কবরস্থানের লোহার ফটকের ওপর লেখা রয়েছে ‘ঢাকা খ্রিষ্টান কবরস্থান ওয়ারী, স্থাপিত ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দ, নিজস্ব সম্পত্তি। পরিচালনায় ঢাকা খ্রিষ্টীয় সিমেটারি বোর্ড, সেন্ট মেরিস ক্যাথিড্রাল, কাকরাইল।’ সেখানে ভেতরে প্রবেশের জন্য অনুমতি লাগবে। অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কামিনী ফুলের গন্ধের মতো আমারও মস্তিষ্কের সমস্ত রন্ধ্র যেন পূর্ণ হয়ে উঠল। সোজা রাস্তা মূল ফটক থেকে সামনে চলে গেছে কবরস্থানের দিকে, একটা সাদা খিলানের মতো তোরণ দেখা যাচ্ছে। সে পথের বাম পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে পত্রপল্লব ও পুষ্পে শোভিত কামিনী বৃক্ষ। বৃক্ষ বলছি এ কারণে যে সাধারণত আমরা বাগানে ও টবে যেসব ছোট কামিনী ফুলের গাছ দেখি, এটি সে রকম না। কাষ্ঠল কাণ্ড, কালচে বাকল, শক্ত কাণ্ডের মাথায় এলোমেলো ডালপালার ঘন প্রসার। এত বড় বয়স্ক কামিনীগাছ ঢাকা শহরে খুব কম দেখেছি। ছোট ছোট গোছা ধরা পাতার ফাঁকে ফাঁকে থোকায় থোকায় ফুটে রয়েছে অজস্র সাদা রঙের ছোট মুধগন্ধী ফুল। গন্ধটা আসছে ওসব ফুল থেকেই। আশপাশের বাতাস সে সৌরভে মাতোয়ারা হয়ে উঠেছে। কামিনী ফুলের এই তীব্র ঘ্রাণ কেবল পাওয়া যায় দেশি জাতগুলোয়, যার পাতা ও ফুল ছোট। সম্প্রতি বড় বড় ফুল ও পাতার যে হাইব্রিড কামিনীগাছ এ দেশে এসেছে, সেগুলোর ঘ্রাণ কম। দেশি কামিনী ফুল যেন বাংলার লাজুক বধূ, হাইব্রিড বা সংকর জাতের কামিনী যেন কোনো বিদেশিনী কামিনী।

কামিনী নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে রমণী বা স্ত্রী। বাংলায় কামিনী মানে বধূ বা স্ত্রী। নিসর্গী বিপ্রদাশ বড়ুয়া তার গাছপালা তরুলতা বইয়ে কামিনী সম্পর্কে লিখেছেন: ‘কামিনী শব্দের অর্থ অতিশয় কামযুক্তা নারী। তাহলে একটি ফুলের নামের সঙ্গে কামিনী শব্দ যোগ হলো কেন? আমাদের এই গ্রহে সব জিনিসের নামকরণের উদ্দেশ্য তাকে চেনা; সব ভাষাতেই নিজের গরজে মানুষ তা করে নিয়েছেন। নারী শব্দের একটি অর্থ কামিনী। এ ছাড়া দয়িতা, গৃহিণী, কলত্র, দারা, পত্নী, স্ত্রী, সীমন্তিনী, ভার্যা ইত্যাদি। কিন্তু নারীকে যখন কামিনী বলা হবে, তখন সবাই কাছে টানতে চাইবে, আবার দূরে ফেলে দিতেও চাইবে। এর জন্য রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়েছে, রাজ্যে রাজ্যে সংঘর্ষ হয়েছে, সিংহাসন ছেড়েছে, অনেক অনর্থ ঘটেছে।’ তাই কামিনী শব্দের গূঢ়ার্থ শালীন নয়। কিন্তু প্রাচীনকাল থেকে এ ফুলের নাম রাখা হয়েছে কামিনী ফুল। 

কামিনীগাছের উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম মুরাইয়া প্যানিকুলাটা (Murraya paniculata) ও গোত্র রুটেসি (Rutaceae)। ১৭৬৭ খ্রিষ্টাব্দে কামিনী ফুলের গাছের প্রথম পূর্ণাঙ্গ বিবরণ দেন সুইডিশ উদ্ভিদবিদ কার্ল লিনিয়াস তার ম্যানটিসা প্লান্টারাম গ্রন্থে। মুরাইয়া নামাংশ এসেছে গটেনগোনের অধ্যাপক জে এ ম্যুরের নাম থেকে, প্যানিকুলাটা অর্থ গুচ্ছপুষ্প। এ গাছটির আদি জন্মস্থান দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। কামিনী চিরসবুজ ঘন পাতাবিশিষ্ট ছোট বৃক্ষ। গাছ ৭ থেকে ১০ মিটার লম্বা হয়। ডালপালা প্রচুর, ছোট ছোট পত্রদণ্ডের দুই দিকে চার জোড়া বা সাতটি পাতা থাকে। গাছের কাণ্ড মসৃণ, হলদে সাদা, বয়স্ক কাণ্ড কালচে, শক্ত। পাতা দেখতে অনেকটা কদবেলের পাতার মতো। পাতা ডিম্বাকৃতি থেকে রম্বসাকৃতি, চকচকে গাঢ় সবুজ, মসৃণ, কিনারা মসৃণ, ছোট। বৈশাখ থেকে শ্রাবণ মাস পর্যন্ত কামিনী ফুল প্রচুর ফোটে। ফুলের পাপড়ি পাঁচটি, সাদা ও সুমিষ্ট গন্ধে ভরপুর। রাতে ফুল ফোটে ও তার মিষ্টি গন্ধে বাগান ভরে থাকে, সকালে গাছতলায় পড়ে থাকে ঝরা পাপড়িগুলো। ফুল শেষে ফল হয়, ফল ডিম্বাকৃতি, খোসা মসৃণ ও চকচকে, কাঁচা ফলের রং সবুজ, পাকলে হয় কমলা-লাল, ভেতরে ঠাসা থাকে ক্ষুদ্র বীজে। বীজ থেকে চারা হয়, গুটিকলম করেও কামিনীর চারা তৈরি করা যায়। ঢাকার বিভিন্ন বাগানে ও উদ্যানে কামিনীগাছ দেখা যায়। কামিনীর সুদৃশ্য ঝোপ আছে মানিক মিয়া অ্যাভেনিউর সড়ক বিভাজক ও চন্দ্রিমা উদ্যানে।

দেখা পেলাম ঝুঁটি শালিকের

প্রকাশ: ২৯ মে ২০২৫, ১০:২৩ এএম
দেখা পেলাম ঝুঁটি শালিকের
ঝিনাইদহের মুরারীদহের মিয়ার দালানের কলাগাছে বৃষ্টিভেজা ঝুঁটি শালিক। ছবি: লেখক

শ্রীশ্রী রাম, মুরারীদহ গ্রাম ধাম, বিবি আশরাফুন্নেসা নাম, কি কহিব হুরির বাখান/ইন্দ্রের অমরাপুর নবগঙ্গার উত্তর ধার, ৭৫,০০০ টাকায় করিলাম নির্মাণ/এদেশে কাহার সাধ্য বাধিয়া নদীর অঙ্গ জলমাঝে কমল সমান/কলিকাতার রাজ চন্দ্র রাজ, ১২২৯ সালে শুরু করি কাজ, ১২৩৬ সালে সমাপ্ত দালান। ইতি-বাড়ির নির্মাতা- ছলিম চৌধুরী।

যাশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাস্ট) ঝিনাইদহ ক্যাম্পাসে অবস্থিত ভেটেরিনারি মেডিসিন অনুষদে ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর অ্যাপ্লাইড কর্তৃক আয়েজিত ‘প্রাণীর স্বভাব ও কল্যাণ’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক কর্মশালায় ‘বন্যপ্রাণী কল্যাণ ও সংরক্ষণ’ বিষয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপনের জন্য গত ২৩ মে সকালে ঝিনাইদহের উদ্দেশে রওনা হলাম। দুপুর দুইটায় পৌঁছার কথা থাকলেও পৌঁছাতে পৌঁছাতে চারটা বেজে গেল। ফলে দুপুরের খাবার খেতে হলো বিকেল সাড়ে ৪টায়। বেলা ৩টায় কর্মশালায় আগত অতিথিদের প্রাক-কর্মশালা ভ্রমণে যাওয়ার কথা। কিন্তু আমাকে ছাড়া তারা যাবেন না। তাই অপেক্ষা করতে থাকলেন। গেস্ট হাউসে খাবার অপেক্ষা করছিল, ১০ মিনিটে তার সদ্ব্যবহার করে ওদের সঙ্গে গাড়িতে উঠলাম। 

মুরারীদহ মিয়ার দালানে পৌঁছলাম ঠিক ৫টা ৫০ মিনিটে। এটি ২০০ বছরের পুরোনো এক জমিদার বাড়ি। ঝিনাইহের একটি দর্শনীয় স্থান যা ছলিমুল্লাহ (ছলিম) চৌধুরীর বাড়ি নামেও পরিচিত। বাড়িটি নবগঙ্গা নদীর উত্তর দিকে অবস্থিত। শহর থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরের এই দর্শনীয় বাড়িটি এখন ভগ্নপ্রায়। প্রাচীন ঐতিহ্য অনুযায়ী মিয়ার দালানের সদর দরজায় নির্মাণকালীন সময়ের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস কাব্যিকভাবে খোদাই করা আছে। সেই পঙক্তিগুলোই আমি গল্পের শুরুতে উল্লেখ করেছি। যাহোক, দালানে প্রবেশদ্বারের ইতিহাস পড়তে পড়তেই ঝম ঝম করে বৃষ্টি নেমে পুরো শরীর ভিজিয়ে দিল। ছাতা মেলে বাড়ির অন্দরমহলে প্রবেশ করলাম। নিচতলায় কক্ষগুলো দেখে পুরোনো সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠলাম। পুরোনো দালান, প্রচুর ফাঁকফোকর। বেশ সংখ্যায় শালিক দেখলাম মুখে খাবার নিয়ে ঘোরাঘুরি করছে। এখন গ্রীষ্ককাল। ওদের ডিম-ছানা তোলার সময়। কিন্তু দর্শনার্থীদের কারণে ছানাদের ঠিকমতো খাওয়াতে পারছে না। আমার কাছে আজ কোনো ভালো ক্যামেরা নেই। খাবার মুখে একটি শালিকের কোনো রকম দুটি ছবি তুলে ওখান থেকে চলে এলাম, যাতে ওরা ছানাদের খাওয়াতে পারে। এরপর বৈঠকখানায় এলাম। এখানে দর্শনার্থীদের জন্য একসেট 

জীর্ণশীর্ণ সোফা রয়েছে, সেখানেই খানিকটা বিশ্রাম নিলাম। পাশে বিশাল বড় বারান্দা। ওখান থেকে নবগঙ্গা নদী দেখলাম। নদীর অন্যপাড়ে দুটি শিয়াল ঘোরাঘুরি করছে। বারান্দার পাশে কলাগাছের পাতার ওপর কাকভেজা কটি শালিকে দেখলাম। তবে এখানে শুধু ঝুঁটিওয়ালা এই এক প্রজাতির শালিকই রয়েছে। পাখির মতো পুরোনো দালান বা স্থাপনা অর্থাৎ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনও আমার অনেক ভালো লাগে। আর সেই পুরোনো দালানে পাখি থাকলে তো কথাই নেই। যাক্, বৃষ্টি কমে এলে সন্ধ্যা ৭টায় মিয়ার দালান থেকে বিদায় নিলাম। 

মুরারীদহের মিয়ার দালানে দেখা শালিকগুলো আর কেউ নয়, আমাদের অতি পরিচিত বহুল দৃশ্যমান আবাসিক পাখি ঝুঁটি/জংলী শালিক। 

এরা বাংলাদেশসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়ার বাসিন্দা। 

ঝুঁটি শালিকের দেহের দৈর্ঘ্য ২৩ সেন্টিমিটার ও ওজন ৮৫ গ্রাম। বয়স্ক পাখির কপালের চমৎকার ঝুঁটিসহ মাথা ও ঘাড় কালচে-ধূসর। লেজ, পিঠ ও বুক মাঝারি ধূসর। দেহের নিচটা কালচে-গোলাপি। লেজতল-ঢাকনি ও ডানার প্রান্ত সাদা। চঞ্চু বা ঠোঁট কমলা-হলুদ, তবে নাসারন্ধ্রসহ চঞ্চুর গোড়া কালচে-ধূসর। চোখ চকচকে হলুদ, যার চারদিকের কিছু অংশে পালক নেই। পা ও পায়ের পাতা হলুদ। নখ বাদামি। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির দেহ কিছুটা উজ্জ্বল, চঞ্চু হলেও ঝুঁটি তুলনামূলকভাবে ছোট।
শালিকটিকে দেশজুড়েই দেখা যায়। সচরাচর গ্রাম, চষা জমি, মুক্ত বনভূমি, বনের প্রান্ত প্রভৃতি স্থানে এরা দলবেঁধে বিচরণ করে। নানা প্রজাতির ফল, কীটপতঙ্গ, কেঁচো ইত্যাদি খায়। ঝাঁকে ঝাঁকে বাঁশবন, নলবন, আঁখক্ষেত বা অন্যান্য স্থানে রাত কাটায়। 

ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত প্রজননকাল। সচরাচর আজীবনের জন্য জোড় বাঁধে। গাছের কোটর, বৈদ্যুতিক খুঁটি, পুল বা দালানের ফাঁকফোকরে বাসা বানায়। স্ত্রী নীলচে রঙের ৩-৭টি ডিম পাড়ে যা ১৫-২১ দিনে ফোটে। ছানারা ১৮-২০ দিনে উড়তে শিখে। বাঁচে প্রায় ৮ বছর ।

লেখক: পাখি, বন্যপ্রাণী প্রজনন ও চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ