
পাখির নাম ‘বাংলা-কাঠঠোকরা’! বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে সহজেই এর দেখা মেলে। পার্বত্য এলাকা ছাড়া ভারতের অনেক জায়গাতেই আপনি এ পাখি দেখতে পাবেন। কিন্তু বাংলাদেশ ও ভারত ছাড়া বিশ্বের আর কোথাও এ পাখির দেখা মিলবে না সহজে।
আমাদের পাশের দেশ মায়ানমার, নেপাল ও ভুটানেই নেই এ পাখি। আমরা তাই সাদরে এর নাম রেখেছি ‘বাংলা-কাঠঠোকরা’। আমাদের আর দোষ কী; প্রাণীর আন্তর্জাতিক নামকরণের জনক ‘কার্ল লিনে’ নিজেই এর নামে ‘বেঙ্গল’ কথাটা জুড়ে দিয়েছিলেন। তাই বাংলা-কাঠঠোকরার আন্তর্জাতিক নাম হয়েছে ‘ডাইনোপিয়াম বেঙ্গলেন্স’।
বাংলার বৃক্ষঘেরা পাড়াগাঁয়েই শুধু নয়; কংক্রিটের এই কঠিন নগরীতেও আপনি বাংলা-কাঠঠোকরার দেখা পাবেন। হয়তো দেখতে পাবেন প্রাচীন কোনো পথতরুর কাণ্ড আঁকড়ে ধরে সে নীরবে বসে আছে। বৃষ্টি নামলে প্রায়ই দেখবেন, মাটি ছেড়ে পিঁপড়ার দল পড়িমরি করে গাছের গা বেয়ে ওপরে উঠছে। পিলপিল করে গাছ-বাওয়া ওই পিঁপড়া বাহিনীই হলো অপেক্ষমাণ কাঠঠোকরার জন্য ধাবমান আহার্যের অসামান্য এক কনভেয়র বেল্ট। পাতাভুক কীটপতঙ্গ দমন করতে পৃথিবীতে যেমন পিঁপড়ার দরকার আছে; পিঁপড়ার বাড়বাড়ন্ত রোধ করার জন্য তেমনই প্রয়োজন রয়েছে কাঠঠোকরার।
তাই বিশ্বের তাবৎ বনে ও বাগানে সারা দিনমান কীটপতঙ্গ ও পিপীলিকা দমনের কাজটি করে যায় কাঠঠোকরাদের বিশাল বাহিনী। পৃথিবীতে আছে ২৫৬ প্রজাতির কাঠঠোকরা এবং বাংলাদেশের মতো ছোট্ট এই দেশেও রয়েছে ২০টি প্রজাতির বসবাস। আমাদের জন্য আরও আকর্ষণীয় সংবাদ, বাংলাদেশেই বাস করে বিশ্বের বৃহত্তম ও ক্ষুদ্রতম কাঠঠোকরা। বিশ্বের অতিকায় কাঠঠোকরাদের অন্যতম হলো বাংলাদেশের পাহাড়ি-বনের এক বিরল বাসিন্দা, যার বাংলা নাম ‘বড় মেটেকুড়ালি’। খুদেদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘তিলা কুটিকুড়ালি’ ও ‘ধলাভ্রু কুটিকুড়ালি’ এবং এই দুটি প্রজাতিরই বসবাস আমাদের পাহাড়ি-বন ও সুন্দরবনে।
খুদে ও অতিকায় ওই দুই ‘এক্সট্রিম’ বা প্রান্তিক কাঠঠোকরার মাঝামাঝি অবস্থান হলো আমাদের বাংলা-কাঠঠোকরার। এর চঞ্চু থেকে লেজের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত মাপলে ১০-১১ ইঞ্চি হয়। অর্থাৎ দৈর্ঘ্যে সে কুটিকুড়ালির দ্বিগুণ আর মেটেকুড়ালির অর্ধেক। বনের বাইরে মেটেকুড়ালি ও কুটিকুড়ালি দেখার আশা অত্যন্ত ক্ষীণ হলেও আপনি বাংলা-কাঠঠোকরার দেখা এ দেশের বনে, বাগানে ও লোকালয়ে সমানভাবে পাবেন। শীতকালে সহজেই দেখতে পাবেন এই পাখি তার অবিশ্বাস্য লম্বা লাল জিহ্বা দিয়ে খেজুরগাছের কাটা অংশ থেকে চেটে চেটে রস খাচ্ছে।
মাথায় উজ্জ্বল সিঁদুরে টোপর আর পিঠে আগুন-রং পালকের জন্য বাংলা-কাঠঠোকরা আমাদের চোখে পড়েও বেশ সহজে। পিঠের এই আগুন-রং পালকের জন্যই এর চলতি ইংরেজি নাম ‘ফ্লেমব্যাক’ এবং পুরো নাম ব্ল্যাক-রাম্পড ফ্লেমব্যাক। ফ্লেমব্যাক নামে কাঠঠোকরা আছে পৃথিবীতে ১৪ আর বাংলাদেশে চার প্রজাতির। এর মধ্যে দুটি ফ্লেমব্যাক, বাংলা-কাঠঠোকরা ও বড় কাঠঠোকরা, এ দেশের লোকালয়েও আসে বলে আমজনতার পরিচিত পাখি। অন্য দুটি প্রজাতি- পাতি কাঠঠোকরা ও হিমালয়ী কাঠঠোকরা, বনে বাস করে বলে সচরাচর লোকের চোখে পড়ে না এবং দেখতে অনেকটা বাংলা-কাঠঠোকরার মতো বলে দক্ষ পাখিদর্শক ছাড়া কেউ আলাদা প্রজাতি বলে উল্লেখ করে না।
বসন্তকালে বাটালের মতো মজবুত চঞ্চু দিয়ে গাছের কাণ্ড কিংবা শাখায় কোটর কেটে সুরক্ষিত একটি বাসা বানায় বাংলা-কাঠঠোকরা। আর সব পাখির মতোই এরা এ বাসাটিকে ডিম দেওয়া ও ছানা পালনের জন্য অস্থায়ীভাবে ব্যবহার করে; বসবাসের জন্য নয়। মাত্র এক মাসের মধ্যে এরা ছানা নিয়ে সদ্যগড়া সে আঁতুড়ঘরটি ছেড়ে চলে যায়। তখন দোয়েল ও শালিকের মতো পাখি এসে এই পরিত্যক্ত কোটর দখল করে। প্রজননের জন্য এদের কোটরের প্রয়োজন হলেও এরা নিজে কোটর বানাতে পারে না। কাঠঠোকরা না থাকলে এদের মতো অনেক পাখিরই বংশ রক্ষা কঠিন হয়ে যেত।
তাহলে দেখা যাচ্ছে যে পিঁপড়া ও কীটপতঙ্গ দমন ছাড়াও কাঠঠোকরাদের আরও একটা কাজ রয়েছে; তা হলো নিরীহ পাখিদের জন্য আঁতুড়ঘর সরবরাহ করা। দুটো কাজই সারা জীবন সযত্নে করে যায় কাঠঠোকরা; মৃত্যুর এক দিন আগেও অবসরে যায় না।