প্রেমাতুর এই পক্ষীযুগলের ছবি পেয়েছি আমি রাজশাহী শহরে। ফুলেভরা এক তেঁতুল গাছে ওরা বাসা বাঁধছে। এই শ্রাবণ-ভাদ্র মাসই ওদের প্রজননকাল। তাই ওরা জলা ছেড়ে এখন লোকালয়ে এসেছে এবং প্রফুল্ল এই তেঁতুলের ফুল ও পল্লবের মাঝে বাসর গড়েছে।
ওদের দেহে এখন প্রণয়ের সাজসজ্জা। হলদে চঞ্চুর রং বদলে হয়েছে ঘন কালো। নাকের সবুজ রং বদলে হয়েছে সোনালি। পিঠের ওপর গজিয়েছে এক সারি বাড়তি পালকের ঝালর। পালকের এই ঝালরের ইংরেজি নাম ‘এইগরেট’।
এই এইগরেটের জন্যই বিশ্ব থেকে ওরা একদিন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছিল। সে আজ থেকে দেড় শ বছর আগের কথা। অভিজাত মহিলাদের পোশাকে তখন পালকের ব্যবহার খুব জনপ্রিয়। প্রজননকামী বগার পিঠের ঝালরের সতেজ, শুভ্র পালক নারীর পোশাকে হয়ে উঠেছে মননশীলতা ও মুগ্ধতার প্রতীক। ফ্যাশনের এই ট্রেন্ড ১৯ শতকের শেষ দিকে তুঙ্গে উঠল। পোশাক-বাজারে ‘এইগরেট’ সরবরাহের জন্য লাখ লাখ বড়-বগা শিকার করা হলো। বগার সংখ্যা কমে যাওয়ায় বাজারে আরও মূল্যবান হলো এইগরেট। বগা-শিকার পরিণত হলো একটি আকর্ষণীয় পেশায়। পৃথিবী থেকে তখন বড়-বগা বিলুপ্ত হওয়ার সমূহ আশঙ্কা দেখা দিল।
তবে মানুষের ভোগের মুখে বড়-বগা শেষ পর্যন্ত ডোডো পাখির মতো বিলুপ্ত হয়ে গেল না। শেষ রক্ষা করলেন তারাই, যাদের জন্য বগার বংশ নিপাত হচ্ছিল। ১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন শহরে দুজন সম্ভ্রান্ত মহিলা সংকল্প করলেন, তারা এইগরেট বর্জনের উদ্যোগ নেবেন। তাদের নাম হ্যারিয়েট হেমেনওয়ে ও মিনা হল। চায়ের আসরে অভিজাত মহিলাদের আমন্ত্রণ করে তারা প্রচার শুরু করলেন। তাদের আবেদন: পাখির পালক বর্জন করুন। তাদের দল ভারী হলো এবং পাখি রক্ষার জন্য তারা ‘ম্যাসাচুসেটস অডুবন সোসাইটি’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়লেন।
একই সময়ে যুক্তরাজ্যের দুজন উদ্যোগী মহিলা পোশাকে পাখির পালক বর্জনের আন্দোলন শুরু করলেন। তাদের নাম এমিলি উইলিয়ামসন ও এলাইজা ফিলিপ্স। দল ভারী হলে। তারাও ১৮৮৯ সালে ‘রয়্যাল সোসাইটি ফর দ্য প্রটেকশন অব বার্ডস’ নামে এক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুললেন। ইউরোপ ও আমেরিকায় মানুষের পোশাকে পাখির পালকের ব্যবহার তারা বন্ধ করলেন। হাতে গোনা কয়েকজন যুদ্ধংদেহী মহিলার জন্য জনপ্রিয় এক ফ্যাশন ও পালকের আন্তর্জাতিক একটি ব্যবসা উৎখাত হলো।
তবে হ্যারিয়েট, মিনা, এমিলি, এলাইজা ও তাদের সহযোদ্ধাদের অবদানের কথা রাজশাহীর এই বগা দম্পতির মোটেই জানা নেই। বগারা এখানে আছে নির্ভাবনায়। এ দেশে আজ কোনো এইগরেট ব্যবসায়ী নেই। প্রজনন মৌসুম শেষ হলে বড়-বগার পিঠ থেকে মূল্যবান এইগরেটগুলো ঝরে পড়বে এবং ঝাড়ুদার তা নিয়ে বর্জ্যস্তূপে ফেলে দেবে। শরতের শেষে বাসা ছেড়ে ছানাগুলো উড়ে উড়ে উধাও হয়ে যাবে। শুধু পরবর্তী বর্ষা পর্যন্ত তেঁতুলের কালো ডালপালায় সাদা চুনের মতো তাদের মলের চিহ্ন লেগে থাকবে।
বিশ্বে মোট ৬৮ প্রজাতির বক আছে। এদের মধ্যে ১৪ প্রজাতিকে ‘ইগরেট’ বা ‘বগা’ বলা হয়। বগাদের পুরো গায়ে থাকে শুভ্র পালক এবং প্রজননকালে গজায় এইগরেট। বিশ্বের সবচেয়ে বড় বগার নাম ‘গ্রেট ইগরেট’। আমরা একে বলি ‘বড়-বগা’। মাটিতে দাঁড়ালে এ পাখি লম্বায় সাড়ে তিন ফুট এবং ডানা মেললে তার বিস্তার পাঁচ ফুট। এর গায়েই হয় সবচেয়ে সুন্দর এইগরেট। স্বাভাবিকভাবেই এ পাখিই হয়েছিল এইগরেট-শিকারিদের প্রধান টার্গেট।
বাংলাদেশের বড়-বগাগুলোও তাদের অজান্তে আজ যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের অবিস্মরণীয় সেই মহিলাদের একটি অনন্য উদ্যোগের সুফল ভোগ করছে। অ্যান্টার্কটিকা ছাড়া বিশ্বের সব মহাদেশেই এখন বড়-বগা ছড়িয়ে পড়েছে। বড়-বগার প্রথম প্রজনন কলোনি দেখা গেছে যুক্তরাজ্যে ২০১২ সালে, ডেনমার্কে ২০১৪ সালে এবং ফিনল্যান্ডে ২০১৮ সালে। বড়-বগার ছবি দিয়ে টাকা-পয়সা ছেড়েছে ব্রাজিল, নিউজিল্যান্ড, বেলারুশ ও হাঙ্গেরি।
যুক্তরাষ্ট্রে জাতীয় অডুবন সোসাইটির প্রতীক হয়েছে ডানামেলা সুদর্শন একটি বড়-বগা। তবে বাংলাদেশে বড়-বগা আজও সেই একটি তুচ্ছ বক ছাড়া আর কিছু নয়।