ঢাকা ১৬ বৈশাখ ১৪৩২, মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫
English
মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৬ বৈশাখ ১৪৩২

বুনো আমড়ার ঘ্রাণ

প্রকাশ: ২৩ আগস্ট ২০২৪, ১১:১২ এএম
আপডেট: ২৩ আগস্ট ২০২৪, ১১:১২ এএম
বুনো আমড়ার ঘ্রাণ
রাজধানীর গ্রিন রোডে বুনো আমড়ার ফল। ছবি: লেখক

বুনো আমড়ার সঙ্গে পরিচয় সেই ছোটবেলায়। বাড়িতে তখন কাঁসার বাসনের চল ছিল। কাঁসার থালায় ভাত খেতাম, কাঁসার গ্লাসে জল পান করতাম। খাওয়ার পর সেগুলো ধোয়ার আগে ঘষেমেজে পরিষ্কার করার জন্য সেকালে এখনকার মতো ডিশ ওয়াশিং পাউডার ছিল না। রোজই দেখতাম, মা হয় বুনো আমড়ার পাকা ফল বা পাকা তেঁতুলের শাঁস দিয়ে ঘষে ঘষে সেসব কাঁসার বাসনপত্র ঝকঝকে করতেন। 

আর ঠাকুরমাকে দেখতাম গ্রামের বন থেকে বুনো আমড়া কুড়িয়ে আনতে। গ্রামের বনে তখন এ গাছের কোনো অভাব ছিল না। ঘরে এনে রাখা পাকা সেসব ফল থেকে এক ধরনের মিষ্টি ঝাঁঝাল ঘ্রাণ বের হতো। এ ঘ্রাণের সঙ্গে যারা পরিচিত, তারা ঘরে ঢুকলেই বুঝতে পারত যে, ঘরে বুনো আমড়া আছে। পাকা সেসব ফলের খোসার রং সোনালি হলুদ, খোসা ছাড়ালে ভেতরে পিচ্ছিল রসাল শাঁস, বড় আঁটি, চুষতে বেশ মজা লাগত। স্বাদে খুব টক হলেও সেসব পাকা ফল নুন-কাসুন্দি দিয়ে মাখিয়ে খেতে চমৎকার লাগত। 

ঠাকুরমাকে দেখতাম সেসব বুনো আমড়ার কাঁচা ফল দিয়ে খাটা রাঁধতে, আচার বানাতে, টকডাল রান্নাও হতো সেসব বুনো আমড়া দিয়ে। এখন আর সেই বুনো আমড়ার ঘ্রাণ পাই না, স্বাদও ভুলে গেছি। এখন বুনো আমড়ার জায়গা দখল করে নিয়েছে বিলাতি আমড়া।

এ নিয়ে যুগপৎ আনন্দ ও খেদ দুই-ই আছে। আনন্দটা হলো সেই চুকা ও সামান্যশাঁসী বুনো আমড়া এখন আর খেতে হচ্ছে না। এখন খাচ্ছি মিষ্টি-টক স্বাদের অতিশাঁসী কচকচে বিলাতি আমড়া। খেদটা হলো, বিলাতি আমড়ার আগ্রাসনে বুনো আমড়াকে হারিয়ে ফেলা। কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিলাতি আমড়াকে নিয়ে একটি গানে সেই খেদ প্রকাশের ভাষাটা আবার ভিন্ন: ‘যীশুখ্রিস্টের নাই সে ইচ্ছা, কি করিব বল আমরা।/ চাওয়ার অধিক দিয়া ফেলিয়াছি ভারতে বিলিতি আমড়া।’ ভারতবর্ষে বুনো আমড়াকে সরাতে এই বিলাতি আমড়া যে এক বড় ভূমিকা রেখেছে, সে কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। আমরা বুনো আমড়া না সরাতে চাইলেও সে সরে গেছে।

বুনো আমড়ার কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। কিন্তু ঢাকা শহরে সেই গ্রামীণ গাছটির দেখা পাব ভাবিনি। অনেকবারই গ্রিন রোড দিয়ে ফার্মগেটের দিকে যাই-আসি। যাওয়া-আসার পথে রিকশা থেকে লক্ষ্য করি, গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ঠিক উল্টোদিকে গ্রিন রোড সরকারি স্টাফ কোয়ার্টারের সীমানাপ্রাচীরের বাইরে ফুটপাতের একপাশে একটি বড় গাছ ঘন সবুজ ঝাঁকড়া মাথায় পাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। প্রথম ভেবেছিলাম গাছটি হয়তো জিগাগাছ। কিন্তু বাকল ও পাতার গড়নে সন্দেহ জাগে। পরে শ্রাবণের এক সকালে হাঁটতে হাঁটতে সে গাছটির কাছে যাই। অনেকক্ষণ দেখার পরও তাকে বুনো আমড়ার গাছ বলে স্বীকার করে নিতে পারছিলাম না বা সন্দেহটা কিছুতেই দূর করতে পারছিলাম না। 

ছোটবেলায় দেখা বুনো আমড়া গাছের ছবি এখন স্মৃতিতে ঝাপসা। প্রকৃতিমাতা বোধ হয় আমার মনের এই দ্বন্দ্বের কথা বুঝতে পেরেছিলেন। উঁচু গাছটির পরতে পরতে যখন চোখ ঘুরাচ্ছি, তখন হঠাৎ প্রকৃতিমাতা যেন তার দৈবিক ইশারায় আমার চোখের সামনে এনে দর্শন পাইয়ে দিলেন এক থোকা ফলের। ফলগুলো দেখেই নিশ্চিত হলাম যে, ওটাই সেই বুনো আমড়াগাছ। 

ঢাকা শহরের এত রাস্তা, উদ্যান ও বাড়িতে এতদিন ধরে ঘুরছি। কিন্তু আর কোথাও বুনো আমড়াগাছের দেখা পাইনি। আর গাছটাও বেশ বড়, বয়স্ক। মনে হলো, ঢাকা শহরে এই একটাই বোধ হয় বুনো আমড়ার গাছ আছে। বুনো আমড়ার গাছ সিলেটের পার্বত্য অরণ্যে মাঝে মাঝে দেখা যায়। দেশের অন্যান্য অরণ্য বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ভাওয়াল ও দিনাজপুরের শালবনে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো বুনো আমড়াগাছের দেখা মেলে।

বুনো আমড়ার উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Spondias pinnata, গোত্র অ্যানাকার্ডিয়েসি। গাছ পাতাঝরা প্রকৃতির বৃক্ষ, ১০ থেকে ১৫ মিটার লম্বা হয়। এ গাছের পাতা পক্ষল ও পত্রক ডিম্বাকৃতি, অগ্রভাগ সুচালো। বিলাতি আমড়ার (Spondias dulcis) চেয়ে এর পাতা বড়, চওড়া ও শিরাবিন্যাস স্পষ্ট। বিলাতি আমড়ার পাতা চকচকে ও গাঢ় সবুজ, বুনো আমড়ার পাতা সেরকম চকচকে না। বসন্তকালে ডালের আগায় মঞ্জরিতে সাদা-সবুজ রঙে মেশানো পাপড়ির ক্ষুদ্র ফুল ফোটে, বর্ষা-শরতে ফল পাকে। বুনো আমড়ার ফলের আকার অনেকটা দেশি মুরগির ডিমের মতো, বিলাতি আমড়ার ফলের আকার হাঁসের ডিমের মতো। বুনো আমড়ার ফল বিলাতি আমড়ার চেয়ে বেশ ছোট ও টক। দুটি আমড়ার বীজই সাদাটে কোমল লম্বা কাঁটায় ভরা। বীজ থেকে চারা হয়। চারা তৈরি করে বুনো আমড়ার বংশ রক্ষা ও বিস্তারের উদ্যোগ নেওয়া উচিত।

ফুটে আছে অশোক ফুল

প্রকাশ: ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ১০:০৭ এএম
ফুটে আছে অশোক ফুল
ময়মনসিংহের শশীলজের অশোকগাছ। ছবি: লেখক

ময়মনসিংহ শহরের বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের বিপরীত দিকে মহারাজা শশীকান্ত আচার্যের স্মৃতিবিজড়িত শশীলজ। এটি এখন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীন একটি জাদুঘর। এর আঙিনার উত্তর-পূর্ব পাশে কয়েকটি অশোকগাছে ফুল ফুটে শোভা ছড়াচ্ছে। চলতি এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে গিয়েছিলাম সেখানে।

কাব্য-সাহিত্যে অশোকবন্দনা অনেক রয়েছে। রবিঠাকুর অশোককে নিয়ে লিখেছেন,
‘আসত তারা কুঞ্জবনে চৈত্র জ্যোৎস্না রাতে
অশোক শাখা উঠত ফুটে প্রিয়ার পদাঘাতে’  

অশোক মাঝারি আকৃতির চিরসবুজ বৃক্ষ। এটি এই অঞ্চলের নিজস্ব বৃক্ষ। অশোকগাছের বৈজ্ঞানিক নাম Saraca asoca, এটি Fabaceae গোত্রের Caesalpinioideae উপগোত্রের বৃক্ষ। উদ্ভিদের অন্যান্য নাম হেমাপুষ্প, অঞ্জনপ্রিয়া, মধুপুষ্প।
 এই বৃক্ষ পঁচিশ থেকে ত্রিশ মিটার উঁচু হয়। পাতা যৌগিক। একটি পাতায় দশটি পত্রক থাকে, পাতার রং গাঢ় সবুজ। পাতা লম্বা, চওড়া ও বর্শা ফলকাকৃতির। কচি পাতা নরম, ঝুলন্ত ও তামাটে। বসন্তকাল ফুল ফোটার সময়। আষাঢ়ের শুরু পর্যন্ত  গাছে ফুল থাকে। ফুল ছোট, মঞ্জরিতে অনেক ফুল জন্মায়, পুংকেশর দীর্ঘ।  

অশোকের ছায়াতেই গৌতম বুদ্ধের জন্ম। রামায়ণে সীতাকে হরণের পর রাবণ অশোক কাননেই রেখেছিল। গৌতম বুদ্ধ জন্মেছিলেন লুম্বিনী কাননে অশোকগাছের নিচে। ঢাকার রমনা পার্কে, বোটানিক্যাল গার্ডেনে অশোকগাছ রয়েছে। ময়মনসিংহে শশীলজের সামনে এবং আনন্দমোহন কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের বাগানে,  কিশোরগঞ্জে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনের বাগানে অশোক বৃক্ষ রয়েছে। হিন্দু এবং বৌদ্ধদের কাছে এই ফুল অত্যন্ত পবিত্র। কামদেবের পঞ্চশরের অন্যতম শর এই ফুলে সজ্জিত।

 এই বৃক্ষের ডালপালা ঘন পল্লবময়। কাণ্ডের গা থেকেও মঞ্জরি দণ্ড উৎপন্ন হতে পারে এবং তা থেকে ফুল উৎপন্ন হয়। ফুলের রং কমলা থেকে লাল। ফল শীমজাতীয়, মাংসল ও লাল। ফলে বেশ কিছু খয়েরি রঙের বীজ থাকে। অশোকের ভেষজ গুণও রয়েছে। শুকনো ফুল রক্ত আমাশয়ে এবং বীজ মূত্রনালির রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।

ফুল ফুটলে মিষ্টি গন্ধে চারপাশ ভরে যায়। শারদীয় দুর্গাপূজায় অশোকের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। অশোকের ডাল ছাড়া দুর্গাপূজার নবপত্রিকাকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়া যায় না। চৈত্র মাসের শুক্লা ষষ্ঠীতে মায়েরা পুত্রের মঙ্গল কামনা করে অশোক ফুল দিয়ে অশোক ষষ্ঠী পূজা করেন। আইইউসিএন অনুসারে এই বৃক্ষটি শঙ্কাকুল (vulnerable ) হিসেবে চিহ্নিত।

লেখক: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, উদ্ভিদবিজ্ঞান 
মুমিনুন্নিসা সরকারি মহিলা কলেজ, ময়মনসিংহ

রূপবতী জহর পোকা

প্রকাশ: ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ০৯:৩২ এএম
রূপবতী জহর পোকা
রংপুরে অড়বরইগাছে দেখা জহর পোকা। ছবি: লেখক

বগুড়া থেকে প্রকৃতিবন্ধু জিনিয়া নাসরিন সুমনের ফেসবুকে পোস্ট করা ভিডিওতে দেখলাম, লাল ছিটকিগাছের পাতার মধ্যে রূপবতী চকচকে নীল-সবুজ রঙের কালো ফোঁটাযুক্ত একটা পোকা ঘুরঘুর করছে। দেখে মনে পড়ে গেল কয়েক বছর আগে রংপুরে বুড়িরহাট হর্টিকালচার সেন্টারের ভেতরে এই ছিটকি গোত্রেরই আরেক গাছ অড়বরইয়ের ডালপালা ও পাতায় পাতায় হাঁটতে দেখেছিলাম এ পোকাটিকে। বেশ কিছুক্ষণ ধরে তার হাবভাব দেখছিলাম। তাই পোকাটিকে চিনতেই তার অনেক কথা মনে পড়ে গেল। পোকাটার নাম জুয়েল বাগ বা জহরপোকা। 

মিলনের আগে পুরুষ জহরপোকারা মেয়ে পোকার সঙ্গে সখ্য স্থাপনের চেষ্টা করে। ওদের সখ্যের ধরনটাও বেশ চমৎকার। পুরুষ পোকাটা কোনো মেয়ে জহরপোকাকে দেখলে তার চারপাশে ঘুরঘুর করতে থাকে। নানা ভঙ্গিমায় মেয়ে পোকাটাকে তার ইচ্ছেটা বুঝাতে চেষ্টা করে। এরপর মেয়ে পোকার সায় আছে কি না, তা বুঝার জন্য পুরুষ পোকাটা তার পেট পাতার সঙ্গে ছুঁইয়ে মেয়ে পোকার সামনে বসে পড়ে। তারপর নতজানু ভঙ্গিতে সে তার শুঁড় দিয়ে মেয়ে পোকার শুঁড়কে স্পর্শ করে। এতেই ওদের ভাবের আদান-প্রদান হয়। মেয়েটার সঙ্গে ভাব করার জন্য পুরুষটা একই রকম অঙ্গভঙ্গি কয়েক বার করে। মেয়ে পোকা রাজি না থাকলে পুরুষ পোকার শুঁড় স্পর্শ করে না। ভাব না হলে পুরুষ পোকারা সেখান থেকে সটকে পড়ে। 

আর তাদের ভাব হলে হয় মিলন। সাধারণত মার্চ থেকে অক্টোবরের মধ্যে এদের মিলন হয়। মিলনের পর মেয়ে পোকাটা অন্তঃসত্ত্বা হয়। গর্ভের ডিমগুলোকে পরিপুষ্ট করার জন্য মেয়ে জহরপোকাগাছের ফলের ভেতর শুঁড় বা মুখের নল ঢুকিয়ে বীজ থেকে রস চুষে খেয়ে উদরপূর্তি করে। এভাবে রস চুষে খাওয়ার কারণে সেসব বীজ অপুষ্ট বা চিটা হয়ে যায়। এর ফলে ফল বিকৃত হয়ে যায়। 

জহরপোকারা পাতার ওপর ডিম পাড়ে। ডিমগুলো কয়েক সারিতে গুচ্ছাকারে থাকে। ছোট ডিমগুলো দেখতে পিপা বা ব্যারেলের মতো দেখায়। ডিমের মুখে একটা ঢাকনা থাকে। ডিমের রং হয় সাদা ময়লাটে। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হলে সেই ঢাকনা খুলে যায়। বাচ্চারা বেরিয়ে কিছুদিন দল বেঁধে থাকে। শত্রুর হাত থেকে বাঁচতে বাচ্চা ও বড় পোকারা ওদের গা থেকে এক ধরনের তীব্র দুর্গন্ধযুক্ত রাসায়নিক পদার্থ ছাড়ে। এতে যদি শত্রু ভয় না পায় বা বিরক্ত না হয়, তখন বড় পোকারা ডানা মেলে সেখান থেকে সটকে পড়ে বা পা গুটিয়ে টুপ করে মাটিতে পড়ে যায় ও লুকিয়ে পড়ার চেষ্টা করে।

হেমিপ্টেরা বর্গের এ পোকার বৈজ্ঞানিক নাম বা প্রজাতি ক্রাইসোকোরিস স্টোল (Chysocoris stollii) ও গোত্র স্কুটেলেরিডি। বাংলাদেশে কয়েক প্রজাতির জুয়েল বাগ আছে। আগে এরা পেন্টাটমিডি গোত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু এদের কাঁধে থাকা ত্রিভুজাকার শক্ত স্কুটেলামের কারণে বর্তমানে এদের স্কুটেলেরিডি গোত্রভুক্ত করা হয়েছে। এরা গান্ধি বা বাগজাতীয় পোকা। এ পোকার রং চকচকে সবুজ বা নীল-সবুজ। মাথার মাঝ বরাবর কালো দাগ থাকে। শুঁড় লম্বা ও পাঁচটি খণ্ডে বিভক্ত। দুই চোখের পাশে কালো ছোপ, বুকের সামনে আটটি দাগ আছে। পাখার ওপর সাতটি কালো ফোঁটা থাকে। এর মধ্যে দুই পাশে তিনটি করে ছয়টি ও মাঝখানে একটি কালো ফোঁটা থাকে। 

ছাত্রজীবনে পড়ার সময় এ পোকাকে মেটালিক শিল্ড বাগ নামে চিনতাম। তবে এর কোনো বাংলা নাম কোথাও পাইনি। আগে ফুটবল খেলায় বিজয়ীদের শিল্ড উপহার দেওয়া হতো। এদের দেহের গড়নটা সেই শিল্ডের মতো বলেই হয়তো এর এরূপ নাম রাখা হয়েছে। তরবারি যোদ্ধারা যুদ্ধের সময় শত্রুদের আঘাত ঠেকানোর জন্য যে ধাতব ঢাল ব্যবহার করতেন, এই পোকার দেহের আকৃতি অনেকটা সে রকম। সে জন্য একে মেটালিক শিল্ড বাগ বলা হয়। আর এর ডানার রংটাও ধাতব দ্রব্যের মতো উজ্জ্বল ও চকচকে, বর্ণময়। দেখে মনে হয় ওদের দেহ থেকে যেন রংধনুর রং বিচ্ছুরিত হচ্ছে, ময়ূরকণ্ঠী সে রং। সাধারণত পুরুষ পোকারা হয় একবর্ণা। কিন্তু মেয়ে পোকারা হয় বহুবর্ণা। পতঙ্গজগতে এমন রূপবতী সুশ্রী পোকা খুব কমই দেখা যায়। 

এখন দেখি, ইংরেজি নাম জুয়েল বাগ আর বাংলা নাম জহরপোকা। এর মানে কি? জুয়েল মানে হীরে-জহরত, মণি-মাণিক্যর মতো উজ্জ্বল দ্যুতিময়। সে অর্থে এর বাংলা নামকরণ হতে পারে জহর পোকা। জহর পোকাদের সাধারণত খেতে, মাঠে, ঝোপঝাড়ে ও অরণ্যে দেখা যায়। বাংলাদেশ ছাড়াও নেপাল এবং ভারতেও জুয়েল বাগ আছে। বাংলাদেশে এ প্রজাতির পোকা অনেক দেখা যায়, বিলুপ্তির কোনো শঙ্কা নেই। এটি অড়বরই, আমলকী, লিচু, আঁশফল, সফেদা ইত্যাদি ফলের একটি ক্ষতিকর পোকা, তাই গবেষণার সুযোগ আছে।

সোনাকপালি হরবোলা

প্রকাশ: ২৬ এপ্রিল ২০২৫, ০৯:৪০ এএম
আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০২৫, ০১:০৯ পিএম
সোনাকপালি হরবোলা
সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে সোনাকপালি হরবোলা। ছবি: লেখক

গ্রীষ্মের দুপুরে বনের পাখিরা একটি বুনো বৃক্ষে পাকা ফল খেতে ভিড় করে। পাখিরা গরমের সময় রসালো ফল খেতে পছন্দ করে। রাঙামাটির কাপ্তাই জাতীয় উদ্যানের সেই গাছটির ফল পেকেছে। ফলগুলোর বর্ণ লাল। ফলগুলো দেখে মনে হয়েছিল আমাদের ছেলেবেলায় দেখা লোহাগাড়া ফল। কিছুটা জামের মতো, তবে তা দেখতে গোলাকার। বনের অনেক প্রজাতির পাখি সেদিন বনের সেই গাছটিতে ফল খেতে এসেছিল। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বুনো হরিয়াল, জলপাই বুলবুল, তেলশালিক, নীলপরি, ধলাচোখ, সিপাহি বুলবুল ও কমলাপেট ফুলঝুরি। সেই সব পাখির মধ্যে একটি সবুজ পালকের পাখি আমাকে মুগ্ধ করেছিল। পাখিটি তার সরু ঠোঁট দিয়ে ছোট ফল ঠুকরে খাচ্ছিল। পাখিটির নাম সোনাকপালি হরবোলা। কপালে তার সোনালি-কমলা পালক। প্রথম দেখায় সে নজর কেড়েছিল আমার।  

সোনাকপালি হরবোলা বাংলাদেশের চিরসবুজ বন, পাতাঝরা বন এবং বৃক্ষবহুল অঞ্চলে বিচরণ করে। প্রধানত ছোট দলে অথবা জোড়ায় থাকে। গাছের ঘন পাতা এবং উঁচু ডালে এরা খাবার খোঁজে। বনের মান্দারগাছে ফুল এলে তারা নিয়মিত মান্দার ফুলে বিচরণ করে ফুলের মধু পান করতে। সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে মান্দারগাছে ফুল ফুটলে সেই গাছে পাখিটি প্রতিদিন ভিড় করে এবং খুব সহজেই দেখা যায়। এ পাখি পোকামাকড়, বিশেষ করে শুঁয়োপোকাও খায়। অন্য পাখিদের সঙ্গে মিলে খাবারের জন্য গাছে গাছে ঘুরে বেড়ায়। 

গাছে গাছে বিচরণের সময় এরা মধুর সুরে ডাকে। এরা অন্য পাখির সুরও অনুকরণ করতে পারে। প্রজননকালে গাছের খাড়া ও সরু ডালে ঘাস, শেওলা, মাকড়সার জাল দিয়ে বাটির মতো বাসা বাঁধে। হালকা পীতাভ বর্ণের দুই থেকে তিনটি ডিম পাড়ে। জানুয়ারি থেকে আগস্ট এদের প্রজননকাল। এ সময় পাখি ডিমে তা দেয়। ডিম পাড়ার প্রায় দুই সপ্তাহ পরে ডিম ফুটে ছানা বের হয়। ডিম ফোটার ১৩ থেকে ১৫ দিন পর ছানারা বাসা ছাড়ে। 

প্রধানত সবুজ পালকের এ পাখির ঈষৎ বাঁকা কালো ঠোঁট থাকে। চোখের পেছন থেকে সারা বুকের জায়গাটাকে ঘিরে আছে প্রশস্ত হলুদ বন্ধনী। চোখ গাঢ় বাদামি। পা এবং পায়ের পাতা কালো। মেয়েপাখির কপালের পালক অনুজ্জ্বল। এ ছাড়া দেখতে উভয় পাখি একই রকম। দেহের  দৈর্ঘ্য ১৭ সেমি এবং ওজন ১৯ গ্রাম। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির দেহ পুরোপরি সবুজ, কেবল গালের নিচ নীলচে। 

বাংলাদেশে চার প্রজাতির হরবোলা দেখা যায়। তদের মধ্যে সোনাকপালি হরবোলা সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। অন্য তিন প্রজাতির হরবোলা বিরল। সোনাকপালি হরবোলা বাংলাদেশের সুলভ আবাসিক পাখি। দেশের সব বিভাগের বনে এদের দেখা যায়। এ পাখির ইংরেজি নাম গোল্ডেন ফ্রন্টেড লিফবার্ড। এদের  বিস্তৃতি ভারতীয় উপমহাদেশ এবং দক্ষিণ-পশ্চিম চীন থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং সুমাত্রা পর্যন্ত। সোনাকপালি হরবোলা বাংলাদেশে এবং বিশ্বের বিপদমুক্ত পাখি হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে পাখিটি সংরক্ষিত। 

প্রকৃতিবিষয়ক লেখক ও পরিবেশবিদ, জার্মান এরোস্পেস সেন্টার

জারুল ফুল ফুটলোরে

প্রকাশ: ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ০১:২০ পিএম
জারুল ফুল ফুটলোরে
চন্দ্রিমা উদ্যানে বৈশাখে ফোটা জারুল ফুল। ছবি: লেখক

বৈশাখ মাস পড়তে না পড়তেই জারুল এসে হাজির। জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, রমনা উদ্যান, চন্দ্রিমা উদ্যান, জাতীয় জাদুঘরের কোণে সবুজ ঝাঁকড়া মাথার জারুলগাছগুলোতে এখন বেগুনি রঙের ফুলের মাতামাতি। রমনায় জারুলগাছের বাগিচাটার নামই দেওয়া হয়েছে জারুল চত্বর। চন্দ্রিমা উদ্যানের পশ্চিম অংশে লাগানো জারুল বনটাকে বড়ই মনোরম মনে হয় বৈশাখের দিনে। তার ছায়াঘন পুষ্পময়ী বৃক্ষতলে বসে প্রকৃতিপ্রেমীরা বিদেশের চেরি উৎসবের মতো জারুল উৎসব করতে পারেন। নদীর তীরে, রাস্তার ধারে, হাওর বাঁওড়েও ফুটেছে এ ফুল। গ্রীষ্মের দিনে এ দেশে কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, কনকচূড়া ফুলের পাশাপাশি জারুল ফুলও রাঙিয়ে দেয় প্রকৃতিকে। গোটা গ্রীষ্মকাল থাকে সেই পুষ্পপ্রাচুর্য। 

নগরে তো বটেই, ঢাকা মহানগর ছেড়ে রাজপথে দূরে কোথাও যাওয়ার পথে, পথের ধারে থাকা জারুলগাছগুলো যেন রৌদ্রতপ্ত বৈশাখী দুপুরে এক প্রশান্তির ছায়া ও রঙে রঙে ঢলে পড়া কোনো তন্বী তরুণীর বুটিদার ওড়না, স্বর্গ থেকে খসে পড়া কোনো উর্বশীর দোপাট্টা। জারুল ফুলগুলোকে দেখে তাই মনে হয় কবি নজরুল লিখেছিলেন: ‘জারুল ফুল/ পারুল ফুল/ ফুটলরে,/ আসলো কে?’ সত্যিই তো কে এল? জারুল আর পারুল, দুটোই বৈশাখে ফোটে। কবির চোখে যেন কিছুই এড়ায় না। যে পারুল বাংলায় দুষ্প্রাপ্য, সেই পারুল ফুলেরও কবি দেখা পেয়েছেন বৈশাখে। এই বৈশাখেই মাঠ ভরে থাকে সবুজ ধানেরগাছ, শীষে ধরে হলদে রং। কবি সেই ধান খেতকে কল্পনা করেছেন সবুজ শাড়িরূপে, আর সে শাড়ির পাড় বানিয়েছেন জারুল ফুল দিয়ে: ‘সবুজ শাড়ির ধানি আঁচল জারুল ফুলে বেগুনি পাড়-/ উড়িয়ে কে ঐ আসল রে ভাই আকাশ-বীণায় বাজিয়ে তার!’ ঝড় কাব্যে মুকুলের উদ্বোধন কবিতায় জারুল ফুলের এ চিত্রকল্পটি আমাদের আন্দোলিত করে।

জারুল একটি বৃক্ষজাতীয় পাতাঝরা প্রকৃতির গাছ। এটি ১৫ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। কাঠবৃক্ষ হলেও জারুল ফুল ফোটার সময় যেন ফুলগাছ। ফুল, শুধু ফুল-অজস্র ফুলে ফুলে মেতে ওঠে ডালপালা, বন। সুন্দর সে দৃশ্য! জারুল জন্মে এ দেশের প্রায় সর্বত্র। তবে জারুলের আদি নিবাস ছিল চীন দেশে। ভারত, মায়ানমার, শ্রীলংকা, মালয়েশিয়াতেও গাছটি জন্মেছে। তবে এ দেশে সব জায়গায় জারুল থাকলেও চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটে বেশি রয়েছে। পাথুরে বালি মাটির মধ্যেও জারুল ঠিকই ঠাঁই করে নিতে পারে। জারুলগাছের কাণ্ড খাটো, সরল, মসৃণ। পাতা উপবৃত্তাকার, ওপরের দিক গাঢ় সবুজ, নিচের দিক হালকা সবুজ। বয়স্ক পাতার রং লাল। খাড়া লম্বা ছড়ায় ফুল ফোটে, ফুলের রঙ আকর্ষণীয় বেগুনি, খাড়া লম্বা ছড়ায় অনেকগুলো ফুল ফোটে, বোঁটা লম্বা, ছয়টি পাপড়ি। পাপড়িগুলো কুঁচকানো রঙিন কাগজের মতো। ফল ডিম্বাকৃতি। 

জারুলগাছ পানিসহিষ্ণু। তাই নিচু বা জলার ধারেও জারুলগাছ লাগানো যায়। জারুলের কাঠ শক্ত ও লাল। প্রধান কাণ্ড ও ডালপালা শক্ত বলে ঝড়-বাতাস এ গাছের সহজে ক্ষতি করতে পারে না। এমনকি বনে আগুন লাগলেও জারুলগাছ সে আগুনে সহজে পুড়ে না। কাঠ আর্দ্রতাসহিষ্ণু। চারা লাগানোর ২-৩ বছর পর থেকে ফুল ফুটতে শুরু করে। চারা লাগানোর পর প্রথম বছরে বৃদ্ধি ধীর থাকলেও পরে গাছ দ্রুত বাড়ে, তিন বছর বয়সেই গাছ প্রায় ৩ মিটার লম্বা হয়ে যায়। বীজ থেকে জারুলের চারা তৈরি করা যায়। বর্ষাকালের আগে চারা লাগানো ভালো। যেকোনো উদ্যান ও নগর পথের ধারে ছায়াবৃক্ষ হিসেবে জারুলগাছ অসাধারণ। যেসব শহরে বায়ুদূষণ বেশি হয়, খারাপ পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা, আটোসাঁটো ও শুকনো মাটি, শুষ্ক আবহাওয়া সেসব শহরের জন্য জারুলগাছ যেন সর্বংসহা, প্রকৃতির এক অপূর্ব দান। ভূমিক্ষয় রোধেও জারুলগাছ চমৎকার। কেননা, এর শেকড় বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে মাটিকে আটকে রাখে। পাহাড় ধস ঠেকাতে তাই পাহাড়েও জারুলগাছ লাগানো যায়।

ফুলপ্রেমিদের কেউ কেউ জারুলকে বসিয়েছেন একেবারে রানির আসনে, ইংরেজিতে ওর নাম দিয়েছেন ‘Queen’s Flowers’, ভারতীয়দের কাছে জারুলের পরিচয় Pride of India রূপে। জারুলের ইংরেজি নাম Giant crepe-myrtle, উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Lagerstroemia speciosa ও গোত্র Lythraceae. নামের শেষাংশ স্পেসিওসা অর্থ সুন্দর। যথার্থ সে নামের অর্থ। সৌন্দর্য ছাড়াও জারুলের আছে ঔষধি গুণ। ফিলিপিনসের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সে দেশের গুরুত্বপূর্ণ ৬৯টি ঔষধি গাছের মধ্যে জারুলকে ঠাঁই দিয়েছে। ভিয়েতনামে জারুলের কচি পাতা সবজি হিসেবে খাওয়া হয় এবং এর বয়স্ক বা পুরোনো পাতা ও পরিপক্ব ফল রক্তে শর্করার পরিমাণ কমাতে ব্যবহৃত হয়। এর বীজ নেশা উদ্রেককারী। ভারতে মহারাষ্ট্রে রাজ্য ফুলের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে জারুলকে। 

মৃত্যুঞ্জয় রায়: কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক

জাতিংগা: পাখিদের রহস্যময় আত্মহননের উপত্যকা

প্রকাশ: ২১ এপ্রিল ২০২৫, ০৯:১৬ পিএম
আপডেট: ২১ এপ্রিল ২০২৫, ১০:১৬ পিএম
জাতিংগা: পাখিদের রহস্যময় আত্মহননের উপত্যকা
প্রতীকী ছবি

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আসাম রাজ্যের ডিমা হাসাও জেলার পাহাড়ঘেরা এক ছোট্ট গ্রাম জাতিংগা। নামটি সাধারণ হলেও এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক ভয়াবহ, রহস্যে মোড়া ও বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের উপাদানে পূর্ণ ঘটনা। যা বহু বছর ধরে বিশ্বের নজর কেড়েছে।

এখানে বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে আকাশ থেকে হঠাৎ করে শত শত পাখি নেমে আসে, ঝাঁকে ঝাঁকে নিচে পড়ে যায়, মরে যায় কিংবা হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে থাকে। 

প্রতিবছর সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়, সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত, এই পাখিদের রহস্যময় দৃশ্য দেখা যায়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো- এ ঘটনা শুধু জাতিংগা গ্রামের মাত্র ১ দশমিক ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি নির্দিষ্ট এলাকাতেই ঘটে। এমনকি এই এলাকা পেরোলেই পাখিগুলোর ওপর এই 'আত্মঘাতী প্রভাব' আর কাজ করে না।

এই ঘটনায় প্রধানত যে সব পাখিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাদের মধ্যে রয়েছে- টাইগার বিটার্ন, ব্লু ব্রেস্টেড কিংফিশার, ইন্ডিয়ান পিট্টা, ব্ল্যাক ড্রংগো ইত্যাদি। পাখিগুলোর বেশিরভাগই পরিযায়ী এবং এদের অনেকেই বিলুপ্তপ্রায়।

প্রথমদিকে স্থানীয় মানুষজন এই ঘটনাকে ভৌতিক বা অতিপ্রাকৃত বলে মনে করত। তারা বিশ্বাস করত, জাতিংগা অভিশপ্ত, আর এই পাখিগুলো যেন অপদেবতা দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে আত্মহত্যা করছে। অনেক সময় পাখিগুলোকে ডাইনির চিহ্ন হিসেবে ধরে নিয়ে পিটিয়ে মারা হত।

তবে কালের পরিবর্তনে, আজকের বিজ্ঞান এই রহস্যের যুক্তিসম্মত ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, জাতিংগার ভৌগোলিক অবস্থান, হঠাৎ বৃষ্টির পর ঘন কুয়াশা, এবং গ্রামের আলো- এই তিনটি উপাদান একত্রে পাখিদের দিশেহারা করে তোলে। সন্ধ্যায় কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশে আলো দেখা মাত্র পাখিরা বিভ্রান্ত হয়ে নিচের দিকে নেমে আসে। আলো তাদের চোখে আকর্ষণ সৃষ্টি করে এবং তারা অবচেতনে আলোকে অনুসরণ করতে থাকে, যা শেষমেশ তাদের পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

আরও চমকপ্রদ বিষয় হলো- এই আলো যদি নিভিয়ে দেওয়া হয়, তবে এই 'আত্মহত্যা' বন্ধ হয়ে যায়। ফলে এটি প্রমাণিত হয় যে, প্রকৃতপক্ষে এটি আত্মহত্যা নয়, বরং একটি বিভ্রান্তিকর পরিবেশগত প্রতিক্রিয়া।

তবে প্রশ্ন থেকেই যায়, সব তথ্য ও যুক্তি থাকার পরও কেন এই নির্দিষ্ট এলাকা আর এই নির্দিষ্ট সময়েই এমন ঘটনা ঘটে? কেন অন্যান্য পাহাড়ি অঞ্চলে এমনটা হয় না? উত্তর এখনও পুরোপুরি নিশ্চিত নয়। এ বিষয়ে বিজ্ঞানের অনুসন্ধান এখনও চলমান।

বর্তমানে আসাম সরকারের উদ্যোগে এ ঘটনাটি নিয়ে ব্যাপক গবেষণা হচ্ছে এবং সচেতনতা বৃদ্ধির প্রচার চালানো হচ্ছে। পাখি সংরক্ষণ কর্মী ও পরিবেশবিদরা স্থানীয়দের বোঝাচ্ছেন, এটি কোনো অলৌকিক ঘটনা নয় বরং একটি বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা। ফলে এখন পাখি নিধনের ঘটনা অনেকাংশে কমেছে।

বর্তমানে জাতিংগা একটি বৈজ্ঞানিক ও পর্যটন আকর্ষণের স্থান। প্রতিবছর হাজারো পাখিপ্রেমী, বিজ্ঞানী ও পর্যটক এখানে ভিড় করেন এই রহস্যময় দৃশ্যের সাক্ষী হতে। এই আগ্রহ যেমন অর্থনৈতিক সম্ভাবনা বাড়াচ্ছে, তেমনি পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টাও জোরদার হচ্ছে।

এই রহস্যময়তা জাতিংগাকে ঘিরে রেখেছে এক অদ্ভুত মোহে। যেখানে প্রকৃতি তার নিজস্ব নিয়মে খেলে চলেছে।

মেহেদী/