বুনো আমড়ার সঙ্গে পরিচয় সেই ছোটবেলায়। বাড়িতে তখন কাঁসার বাসনের চল ছিল। কাঁসার থালায় ভাত খেতাম, কাঁসার গ্লাসে জল পান করতাম। খাওয়ার পর সেগুলো ধোয়ার আগে ঘষেমেজে পরিষ্কার করার জন্য সেকালে এখনকার মতো ডিশ ওয়াশিং পাউডার ছিল না। রোজই দেখতাম, মা হয় বুনো আমড়ার পাকা ফল বা পাকা তেঁতুলের শাঁস দিয়ে ঘষে ঘষে সেসব কাঁসার বাসনপত্র ঝকঝকে করতেন।
আর ঠাকুরমাকে দেখতাম গ্রামের বন থেকে বুনো আমড়া কুড়িয়ে আনতে। গ্রামের বনে তখন এ গাছের কোনো অভাব ছিল না। ঘরে এনে রাখা পাকা সেসব ফল থেকে এক ধরনের মিষ্টি ঝাঁঝাল ঘ্রাণ বের হতো। এ ঘ্রাণের সঙ্গে যারা পরিচিত, তারা ঘরে ঢুকলেই বুঝতে পারত যে, ঘরে বুনো আমড়া আছে। পাকা সেসব ফলের খোসার রং সোনালি হলুদ, খোসা ছাড়ালে ভেতরে পিচ্ছিল রসাল শাঁস, বড় আঁটি, চুষতে বেশ মজা লাগত। স্বাদে খুব টক হলেও সেসব পাকা ফল নুন-কাসুন্দি দিয়ে মাখিয়ে খেতে চমৎকার লাগত।
ঠাকুরমাকে দেখতাম সেসব বুনো আমড়ার কাঁচা ফল দিয়ে খাটা রাঁধতে, আচার বানাতে, টকডাল রান্নাও হতো সেসব বুনো আমড়া দিয়ে। এখন আর সেই বুনো আমড়ার ঘ্রাণ পাই না, স্বাদও ভুলে গেছি। এখন বুনো আমড়ার জায়গা দখল করে নিয়েছে বিলাতি আমড়া।
এ নিয়ে যুগপৎ আনন্দ ও খেদ দুই-ই আছে। আনন্দটা হলো সেই চুকা ও সামান্যশাঁসী বুনো আমড়া এখন আর খেতে হচ্ছে না। এখন খাচ্ছি মিষ্টি-টক স্বাদের অতিশাঁসী কচকচে বিলাতি আমড়া। খেদটা হলো, বিলাতি আমড়ার আগ্রাসনে বুনো আমড়াকে হারিয়ে ফেলা। কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিলাতি আমড়াকে নিয়ে একটি গানে সেই খেদ প্রকাশের ভাষাটা আবার ভিন্ন: ‘যীশুখ্রিস্টের নাই সে ইচ্ছা, কি করিব বল আমরা।/ চাওয়ার অধিক দিয়া ফেলিয়াছি ভারতে বিলিতি আমড়া।’ ভারতবর্ষে বুনো আমড়াকে সরাতে এই বিলাতি আমড়া যে এক বড় ভূমিকা রেখেছে, সে কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। আমরা বুনো আমড়া না সরাতে চাইলেও সে সরে গেছে।
বুনো আমড়ার কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। কিন্তু ঢাকা শহরে সেই গ্রামীণ গাছটির দেখা পাব ভাবিনি। অনেকবারই গ্রিন রোড দিয়ে ফার্মগেটের দিকে যাই-আসি। যাওয়া-আসার পথে রিকশা থেকে লক্ষ্য করি, গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ঠিক উল্টোদিকে গ্রিন রোড সরকারি স্টাফ কোয়ার্টারের সীমানাপ্রাচীরের বাইরে ফুটপাতের একপাশে একটি বড় গাছ ঘন সবুজ ঝাঁকড়া মাথায় পাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। প্রথম ভেবেছিলাম গাছটি হয়তো জিগাগাছ। কিন্তু বাকল ও পাতার গড়নে সন্দেহ জাগে। পরে শ্রাবণের এক সকালে হাঁটতে হাঁটতে সে গাছটির কাছে যাই। অনেকক্ষণ দেখার পরও তাকে বুনো আমড়ার গাছ বলে স্বীকার করে নিতে পারছিলাম না বা সন্দেহটা কিছুতেই দূর করতে পারছিলাম না।
ছোটবেলায় দেখা বুনো আমড়া গাছের ছবি এখন স্মৃতিতে ঝাপসা। প্রকৃতিমাতা বোধ হয় আমার মনের এই দ্বন্দ্বের কথা বুঝতে পেরেছিলেন। উঁচু গাছটির পরতে পরতে যখন চোখ ঘুরাচ্ছি, তখন হঠাৎ প্রকৃতিমাতা যেন তার দৈবিক ইশারায় আমার চোখের সামনে এনে দর্শন পাইয়ে দিলেন এক থোকা ফলের। ফলগুলো দেখেই নিশ্চিত হলাম যে, ওটাই সেই বুনো আমড়াগাছ।
ঢাকা শহরের এত রাস্তা, উদ্যান ও বাড়িতে এতদিন ধরে ঘুরছি। কিন্তু আর কোথাও বুনো আমড়াগাছের দেখা পাইনি। আর গাছটাও বেশ বড়, বয়স্ক। মনে হলো, ঢাকা শহরে এই একটাই বোধ হয় বুনো আমড়ার গাছ আছে। বুনো আমড়ার গাছ সিলেটের পার্বত্য অরণ্যে মাঝে মাঝে দেখা যায়। দেশের অন্যান্য অরণ্য বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ভাওয়াল ও দিনাজপুরের শালবনে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো বুনো আমড়াগাছের দেখা মেলে।
বুনো আমড়ার উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Spondias pinnata, গোত্র অ্যানাকার্ডিয়েসি। গাছ পাতাঝরা প্রকৃতির বৃক্ষ, ১০ থেকে ১৫ মিটার লম্বা হয়। এ গাছের পাতা পক্ষল ও পত্রক ডিম্বাকৃতি, অগ্রভাগ সুচালো। বিলাতি আমড়ার (Spondias dulcis) চেয়ে এর পাতা বড়, চওড়া ও শিরাবিন্যাস স্পষ্ট। বিলাতি আমড়ার পাতা চকচকে ও গাঢ় সবুজ, বুনো আমড়ার পাতা সেরকম চকচকে না। বসন্তকালে ডালের আগায় মঞ্জরিতে সাদা-সবুজ রঙে মেশানো পাপড়ির ক্ষুদ্র ফুল ফোটে, বর্ষা-শরতে ফল পাকে। বুনো আমড়ার ফলের আকার অনেকটা দেশি মুরগির ডিমের মতো, বিলাতি আমড়ার ফলের আকার হাঁসের ডিমের মতো। বুনো আমড়ার ফল বিলাতি আমড়ার চেয়ে বেশ ছোট ও টক। দুটি আমড়ার বীজই সাদাটে কোমল লম্বা কাঁটায় ভরা। বীজ থেকে চারা হয়। চারা তৈরি করে বুনো আমড়ার বংশ রক্ষা ও বিস্তারের উদ্যোগ নেওয়া উচিত।