ভোরের সোনালি আলোয় দেখি একজোড়া সবুজ সুইচোরা বসে আছে। পুরুষ পাখিটি লড়াকু এক মৌমাছি ধরে এনেছে। তার শক্ত চঞ্চুতে হুল ফোটানোর বৃথা চেষ্টা করছে মারমুখো মৌমাছি। সুইচোরা একসময় মাথা ঝুঁকিয়ে পায়ের তলায় ডালটির গায়ে মৌমাছিকে ঠেসে ধরল। ডালের নরম বাকলেই হুল ফুটিয়ে দিল মরিয়া মৌমাছি। তখন হুলহীন মৌমাছিটিকে সে এনে উপহার দিল স্ত্রী সুইচোরাকে। স্ত্রী পাখিকে পুরুষ সুইচোরা আহার্য দিলে প্রণয় প্রগাঢ় হয়। এ কাজে যে পুরুষ যত দক্ষ, তার সঙ্গে স্ত্রীর তত খাতির। স্ত্রী পাখিরা যে অলস, পেটুক কিংবা লোভী, তা কিন্তু নয়। ছানা হলে পরে বাবা-মায়ের আহার্য সংগ্রহের কাজ ১০ গুণ বেড়ে যাবে। সে কাজে পুরুষের দক্ষতাটা আগেই নিশ্চিত করতে চায় স্ত্রী পাখি। অদক্ষ পুরুষের সঙ্গে ঘর করে অবশেষে অভুক্ত ছানা কোটরে রেখে পাগলের মতো একা ছোটাছুটি করে সে মরতে চায় না।
সবুজ সুইচোরা সারা দিন গাছের মগডালে অথবা বিদ্যুতের তারে বসে থাকে। কোথায় কোন পতঙ্গ ওড়ে, সেদিকে চোখ রাখে। মৌমাছি, ফড়িং, প্রজাপতি ইত্যাদি পতঙ্গ চোখে পড়লেই তীরবেগে উড়ে গিয়ে ছোঁ মারে। হাজার চক্ষুর সতর্ক দৃষ্টি মেলে চললেও অনেক পতঙ্গই শিকারি সুইচোরার চঞ্চুতে ধরা পড়ে। সফল শিকারি তখন আগের আসনে ফিরে যায় এবং চঞ্চুতে পতঙ্গ নিয়ে বসে থাকে। সুইচোরার পতঙ্গ শিকার করাটা ঠিক সাপুড়ের সাপ ধরার মতোই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। অনেক পতঙ্গই হয় বিষধর, অথবা বিষাক্ত। মৌমাছি ও বোলতার মতো বিষধর পতঙ্গ হুল ফুটিয়ে দিলে বিষে সুইচোরার দেহ জর্জরিত হবে এবং প্রজাপতি ও গান্ধীপোকার মতো বিষাক্ত পতঙ্গ খেয়ে ফেললে সুইচোরার দেহ বিকল হবে। তাই মৌমাছি ও বোলতার হুল আর প্রজাপতির বিষাক্ত ডানা ভেঙে ফেলে তবেই তা পেটে চালান করে সুদক্ষ সুইচোরা।
আগে আমরা মনে করতাম যে এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশজুড়েই আমাদের সবুজ সুইচোরার বসবাস রয়েছে।
সম্প্রতি গবেষকেরা জানিয়েছেন যে, আমাদের ওই ধারণা সঠিক নয়। চেহারায় অনেক মিল থাকলেও এই দুই মহাদেশে তিনটি পৃথক প্রজাতির সবুজ সুইচোরা রয়েছে। সাহারা মরুর দক্ষিণে সোমালিয়া থেকে সেনেগাল পর্যন্ত বাস করে একটি প্রজাতি, যার নাম রাখা হয়েছে ‘আফ্রিকা সবুজ সুইচোরা’।
সৌদি আরব, ইয়েমেন এবং ওমানে বাস করে অপর এক প্রজাতি, যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘আরব সবুজ সুইচোরা’। আমাদেরটির নতুন নামকরণ হলো ‘এশিয়া সবুজ সুইচোরা’। এর বিস্তার বাংলাদেশের পশ্চিমে ইরান এবং পুবে ভিয়েতনাম পর্যন্ত। তবে সমতলের এই পাখি পাহাড়ি দেশ নেপাল ও ভুটানে খুবই বিরল।
সুইচোরার ইংরেজি নাম ‘বী-ইটার’। অর্থাৎ মৌমাছিভুক। বিশ্বের ৩১ প্রজাতির সুইচোরার মধ্যে মাত্র চারটি প্রজাতির দেখা মেলে বাংলাদেশে। তবে একমাত্র সবুজ সুইচোরাকেই সারা বছর বাংলাদেশের সর্বত্র দেখা সম্ভব। বাকি দুটি প্রজাতি চট্টগ্রাম বিভাগের পাহাড়ি বনে বাস করে। চতুর্থটি এ দেশের নদীচরে গ্রীষ্মের আগন্তুক। দেশের সর্বত্র থাকলেও এখন আমাদের সবুজ সুইচোরাকে আগের মতো ২০-৩০টির ঝাঁকে কমই দেখা যায়।
রাসায়নিক কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহারে দেশে কীটপতঙ্গ কমে গেছে। সেই সঙ্গে কমে গেছে সুইচোরার মতো পতঙ্গভুক পাখিরা। আবার গাছগাছালিতে বসে থাকলে সবুজ রঙের এই পাখি সহজে লোকের চোখেও পড়ে না। তাই ওরা সুযোগ পেলেই পথে-প্রান্তরে ঝুলন্ত বৈদ্যুতিক তারে এসে বসে এবং পতঙ্গ শিকারের পুরো পদ্ধতিটি আমাদের দেখার সুযোগ করে দেয়।