শরতের এক স্নিগ্ধ সকালে হাজির হলাম ঢাকার ওয়ারীতে বলধা উদ্যানের সিবিলি অংশে। ক্যামেলিয়া হাউসের পাশে একটি কানাঙ্গাগাছের দেখা পেলাম। গাছটি এর আগেও দেখেছি ছোট অবস্থায়। এখন সে গাছ বেশ বড় হয়েছে, ছোটখাটো বৃক্ষের রূপ ধরেছে। কানাঙ্গাগাছের কাণ্ডের গোড়া থেকে খানিকটা ওপর পর্যন্ত ডালপালা নেই, কিন্তু এরপর কাণ্ড থেকে ডালপালা বেরিয়ে গাছটিকে ঝোপালো করে ফেলেছে। ঘন সবুজ পাতা, পাতার ফাঁকে ফাঁকে ফুটে আছে অপরূপ ফুল, ফুলগুলোর কাছে গেলে সেগুলোর ঘ্রাণ পাচ্ছিলাম। সুঘ্রাণ আর ফুলের রূপে শরতের সকালটা অন্য রকম হয়ে উঠল। তবে সময়টা শরতের কোজাগরী জ্যোস্না প্লাবিত রাত হলেই ভালো হতো। কেননা, রাতের মতো এ ফুলের তীব্র ঘ্রাণ দিনে পাওয়া যায় না।
গাছে যখন কুঁড়ি আসে তখন এর কোনো ঘ্রাণ পাওয়া যায় না। এমনকি ফুল ফোটার পর যখন পাঁপড়িগুলো সবুজ থাকে, তখনো ঘ্রাণ পাওয়া যায় না। কিন্তু কিছু দিন পর পাঁপড়িগুলো যখন হলদে হতে শুরু করে, তখনই সেসব ফুল সুমিষ্ট ঘ্রাণ ছড়াতে শুরু করে। কুঁড়ি থেকে ফুল ফুটে শুকাতে বা ফল গঠনের আগ পর্যন্ত প্রায় দুই সপ্তাহ সময় লাগে। এ কদিন ফুলগুলো গাছের ডালেই ঝুলতে থাকে। তবে ফোটার পর থেকে ধীরে ধীরে ফুলগুলো ম্লান হতে শুরু করে। প্রায় সারা বছরই এর ফুল ফোটে।
কানাঙ্গাগাছের বাংলা নাম অপরূপ চাঁপা, ইংরেজি নাম কানাঙ্গা ট্রি (Cananga tree), উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম কানাঙ্গা ওডোরাটা (Cananga odorata) ও গোত্র অ্যানোনেসি (Annonaceae)। অর্থাৎ কানাঙ্গা আতা, শরিফা ও কাঁঠালিচাঁপা গোত্রের গাছ, ফুলের চেহারায় কাঁঠালিচাঁপা ফুলের কিছুটা মিল আছে, আতা ও শরিফার আদল আছে। তবে কানাঙ্গার ফুল কাঁঠালিচাঁপা ফুলের চেয়ে অনেক বড়, লম্বা ও সুগন্ধযুক্ত পাঁপড়ি, বৃতি ও পাঁপড়ির রঙের অনেকটা মিল আছে কাঁঠালিচাঁপা ফুলের সঙ্গে। উদ্ভিদ জগতে সবুজ রঙের ফুল খুব দুর্লভ। কানাঙ্গা ফুলগুলো যখন ফোটে তখন রঙটা সবুজ থাকে, এরপর ফিকে হতে শুরু করে ও শেষে হলুদ হয়ে যায়। ফুলে সুগন্ধ থাকায় বিদেশে এ ফুল থেকে সুগন্ধী বা পারফিউম উৎপাদন করা হয়। এ জন্য কানাঙ্গার আরেক ইংরেজি নাম পারফিউম ট্রি। প্রাকৃতিক সুগন্ধী উৎপাদনকারী শিল্পে কানাঙ্গার কদর রয়েছে অনেক বেশি, এ জন্য কানাঙ্গা ফুল তাদের কাছ থেকে খেতাব পেয়েছে ‘সুগন্ধের রানি’।
কানাঙ্গা একটি দ্রুতবর্ধনশীল চিরসবুজ ছোট বৃক্ষ। গাছটি বড়জোড় ১২ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। অনুকূল পরিবেশ ও পরিচর্যা পেলে গাছ বছরে কয়েক মিটার লম্বা হতে পারে। পাতা যৌগিক ও পক্ষল, পত্রফলক মসৃণ ও চকচকে, ডিম্বাকার, পাতার আগা সূচালো, কিনারা কিছুটা ঢেউ খেলানো। লম্বা চিকন বোঁটায় ফুল ফোটে, ফুল নিচের দিকে ঝুলে থাকে, ফুলের ছয়টি পাঁপড়ি সরু ও লম্বা, পাঁপড়ি আঁকাবাঁকা বা ঢেউ খেলানো, সবুজাভ রং, পাঁপড়িগুলোর মাঝে একটি ছোট্ট চাকতি থাকে, তা থেকে চারদিকে রশ্মির মতো ছড়িয়ে থাকে, দেখতে তারার মতো দেখায়। আবার ফুলকে অক্টোপাসের মতো বললেও ভুল হবে না, তবে অক্টোপাসের মতো আটটি বাহু না, বরং আছে বাহুর মতো ছয়টি পাঁপড়ি। পাঁপড়িগুলো সুগন্ধী গ্রন্থিতে ভরপুর, এসব গ্রন্থিতে থাকে সুগন্ধি তেল। ফুল শেষে থোকা ধরে ফল হয়। পাকা কালো ফলগুলো পাখিরা খায়। পাখিরাই এ গাছের বংশবৃদ্ধি ঘটায়। শাল-সেগুনের বনে প্রাকৃতিকভাবে কানাঙ্গাগাছ জন্মাতে পারে, কিন্তু এ দেশের কোনো শাল বা সেগুনের বনে কানাঙ্গাগাছকে কখনো দেখিনি। কয়েক বছর আগে কানাঙ্গাকে দেখেছিলাম ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ উদ্যানে।
কানাঙ্গার আদি নিবাস ফিলিপিন্স, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, নিউগিনি, সলোমন দ্বীপপুঞ্জ ও অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড। থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপেও এ গাছ দেখেছি। কী কারণে জানি না, সেসব গাছের ফুলগুলোকে আমাদের দেশের কানাঙ্গা ফুলের চেয়ে অনেক বড় দেখেছি, আর সুগন্ধও বেশি। বালিনিজদের কাছে শুনেছি, তারা এ ফুল বাসর রাতে নববিবাহিত যুগলের বিছানার ওপর ছড়িয়ে দেয়। গাছের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় কাঁঠালিচাঁপা ফুলের মতো ঘ্রাণ এসে নাকে লাগে। এবার ঢাকার বৃক্ষমেলায় লতানে স্বভাবের কয়েকটি কানাঙ্গাগাছ দেখেছিলাম, যেটা কানাঙ্গার ভিন্ন প্রজাতি বলে মনে হয়, সেসব ফুলের ঘ্রাণ বেশি মনে হলো। এসব গাছ যারা জাতীয় বৃক্ষমেলা থেকে কিনে নিয়ে নিজেদের বাগানে লাগিয়েছেন, তারাই ভালো বলতে পারবেন সে ফুল ও গাছ সম্পর্কে। বাগানের জন্য কানাঙ্গা এক শোভাময়ী ব্যতিক্রমী ফুলের গাছ। উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরাও কানাঙ্গা নিয়ে গবেষণা করতে পারেন।