শরতের নীল আকাশে ভেসে বেড়ায় সাদা মেঘ। বিলে হাসে টকটকে লাল শাপলা ফুল। এখানে বয়ে যায় নির্মল বাতাস। এতে শাপলার সবুজ পাতাগুলো প্রায়ই উল্টে যায়। আর ফুলগুলো দুলতে থাকে। সৃষ্টি হয় এক অপূর্ব দৃশ্যের। প্রকৃতির এই সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রতিদিন আসেন অনেকে। এই ফুলের মেলায় কিছুটা সময় আনন্দে কাটান। ছোট ছোট নৌকায় ঘুরে বেড়ান তারা। হাত বাড়িয়ে তোলেন শাপলা ফুল। কেউ কেউ মালা তৈরি করে গলায় পরেন। ছবি তোলেন।
এই লাল শাপলার বিলের অবস্থান কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার রৌমারী ইউনিয়নের মাদারটিলা এলাকায়। এর নাম পাটা ধোয়া বিল। বিলের অদূরে ব্রিটিশদের নীলকুঠি। এই নীলকুঠির পাশে দেওকুড়া বিল। নিচু এই এলাকায় একসময় প্রচুর পাট চাষ হতো। পাট জাগ দেওয়ার একমাত্র জায়গা ছিল বিলটি। পাটচাষিরা ওই বিলে পাট জাগ দিতেন। পাট নরম হলে আঁশ ছাড়ানো হতো। পাটের আঁশ ছাড়ানোকে এই অঞ্চলের মানুষরা বলেন পাটা ধোয়া। অনেকের ধারণা, এ থেকে বিলটির নাম হয় পাটা ধোয়া বিল। তবে এখন অনেকে লাল শাপলার বিল হিসেবেই একে চেনেন।
উপজেলা শহর থেকে বিলটির দূরত্ব সাত কিলোমিটার। রৌমারী-ঢাকা সড়কের কর্তিমারী বাজার। বাজারের শুরুতে পুব দিকে চরনতুনবন্দর সড়ক ধরে দুই কিলোমিটার এগোলে বাম পাশে চোখে পড়ে বিলটি। কৃষকদের শত একরের বিলটি এখন পর্যটন এলাকা। জুলাইয়ের শুরুতে লাল শাপলা ফুল ফুটতে শুরু করে বিলটিতে। অক্টোবরের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রচুর ফুল দেখা যায়। প্রতিদিন কাছের ও দূরের মানুষ আসেন লাল শাপলা দেখতে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আল আমিন স্থানীয় বন্ধুদের নিয়ে বিল দেখতে এসেছেন। নৌকায় ঘুরছেন। ছবি-সেলফি তুলছেন। হইহুল্লোড় করছেন। নৌকায় গলা ছেড়ে গানও গাইছেন তারা। আল আমিন জানান, একটু দূরে তাদের বাড়ি। হল বন্ধ হওয়ার পর ঢাকা থেকে এসেছেন। বন্ধুদের নিয়ে বিলে এসে তিনি অবাক। বলেন, ‘এখানে প্রকৃতি এত সুন্দর! বুঝতেই পারিনি। মন ভালো হওয়ার মতো জায়গা। সবার বেড়াতে আসা উচিত।’
কাউনিয়ার চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে তিনটি নৌকায় ঘুরছেন শিক্ষকরা। সবার হাতে গোছা গোছা শাপলা। শিক্ষকরা বলেন, ‘আশপাশের সবাই বিলের লাল শাপলা ফুল দেখতে আসে। যাওয়ার সময় হাতে শাপলা তুলে নিয়ে যায়। এসব দেখে শিক্ষার্থীরা বলছিল দেখতে আসবে। তাই নিয়ে এসেছি। তারা খুব আনন্দ করছে। আমাদের ভালো লাগছে।’
শিক্ষার্থী সুমাইয়া বলে, ‘সবাই মিলে এসেছি। অনেক ভালো লাগছে। আমরা আবার আসব।’ শিক্ষার্থী রাব্বী বলে, ‘খুব মজা হচ্ছে। এত সুন্দর জায়গায় কখনো আসিনি।’
রফিকুল ইসলাম এসেছেন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে। প্রায় ১ ঘণ্টা ধরে ঘুরছেন বিলে। রফিকুল বলেন, ‘প্রকৃতির রূপ সত্যিই অসাধারণ। আমি আগেও এসেছি। এবার স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে এসেছি। তারা খুব খুশি হয়েছে। বিলের পাশে একটু বসার জায়গা থাকলে আরও ভালো হতো। কিছু দোকানপাট দরকার।’
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, বিলটি অনেক পুরোনো। তবে পাঁচ বছর ধরে এখানে লাল শাপলা ফুল ফুটছে। ওমর আলী নামের একজন বলেন, গত বছরের তুলনায় এবার ফুলের সংখ্যা বেশি। প্রতিদিন শত শত লোক দেখতে আসছে। তিনি জানান, বিলের জমির মালিকরা লোকসান গুনছেন। এক মৌসুম ফসল ফলাতে পারছেন না। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
আনিছুর রহমান বলেন, কৃষকদের জন্য সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। কৃষকদের প্রণোদনা দিতে হবে। তবে ইতোমধ্যে বিল ঘিরে বাড়তি আয়ও করছেন অনেকে।
ভোরে নৌকা নিয়ে প্রস্তুত থাকেন মাঝি ফরহাদ আলী। তিনি বলেন, দিনে ৭০০ থেকে দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করেন একজন মাঝি। তবে শুক্র-শনিবার সরকারি ছুটি থাকায় লোকজন বেশি আসে। আয়ও বেশি হয়। গত শুক্রবার দর্শনার্থী ঘুরিয়ে তিনি আয় করেন ১ হাজার ৮০০ টাকা। ওই দিন ১৬টি নৌকার আয় হয়েছে ৩০ হাজার টাকা। মাঝি সুরুজ্জামান জানান, পরিবার-পরিজন নিয়ে বিলে ঘুরতে আসেন অনেক মানুষ। নৌকায় উঠে বিল ঘুরে ঘুরে শাপলা তোলেন।
স্থানীয় প্রশাসন বলছে, বিলটি দিনে দিনে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। আইনশৃঙ্খলা ঠিক রাখতে খেয়াল রাখছে পুলিশও।
রৌমারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) গোলাম মর্তুজা বলেন, ‘আমাদের লোকজন প্রায়ই ঘুরে আসেন। যাতে কোনো বিশৃঙ্খলা না ঘটে।’
রৌমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাহিদ হাসান খান বলেন, বিলটি নিয়ে প্রশাসন ভাবছে। যাতে পর্যটকের সংখ্যা বাড়ে, সে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।