বর্ষাকাল পেরিয়ে গেলেও বৃষ্টি পড়ছে। মাঝে মাঝে বৃষ্টিহীন সাদা মেঘ মাখা নীল আকাশ জানান দিচ্ছে শরতের আগমনী বার্তা। রোদ-বৃষ্টির এমন এক সকালে ফার্মগেট মেট্রোরেল স্টেশনের পাশে তুলা ভবনের পেছনে ছোট্ট একটা বাগানে দেখা হলো কয়েকটা নাগচম্পা ফুলগাছের সঙ্গে। আমার মাথা সমান উচ্চতার ছোট সেসব গাছের আগায় থোকা ধরে ফুটে আছে ধবধবে সাদা ফুল। ফুলের মাঝখানটায় হলদে আভা।
থোকা ধরে ফোটা সেসব ফুলকে মনে হচ্ছিল যেন ফুলের তোড়া। এ জন্যই হয়তো এ ফুলের ইংরেজি নাম রাখা হয়েছে ব্রাইডাল বুকে। নববধূকে প্রেম নিবেদনের ভাষা হলো ফুলের তোড়া, তা সে গোলাপ বা নাগচাঁপাই হোক। একটা একটা করে গোলাপ দিয়ে তোড়া বানাতে হয়, আর নাগচাঁপা ফুলগুলো নিজেরাই তোড়ার মতো করে ফোটে। তাই ওই ফুলগুলো দেখে বলতে ইচ্ছে করে, ‘একটি বাগান একটি ফুল, একটি ফুলের তোড়া/ তাহার মাঝে থাকবে তুমি পাপড়ি দিয়ে মোড়া।’প্রেম তো ফুলের সৌন্দর্য আর সৌরভের মতোই যাকে উপভোগ করা যায় কিন্তু ধরা যায় না।
নাগচাঁপা ফুলগুলো দেখতে অনেকটা কাঠচাঁপা বা কাঠগোলাপের মতো। তবু কোথায় যেন কাঠগোলাপের সঙ্গে নাগচাঁপার কিছু মিল ও অমিল রয়েছে। মিলটা হলো এ দুটি গাছই প্লুমেরিয়া গোনের অর্থাৎ এ দুটি গাছই এক গোত্রের। দুটি গাছের ডালপালা ও পাতা ভাঙলে সাদা দুধের মতো কষ বের হয়।
নাগচাঁপার চেয়ে কাঠচাঁপার গাছ বড় ও বৃক্ষ প্রকৃতির, নাগচাঁপা গুল্ম প্রকৃতির। দুটি গাছের ফুলও দেখতে প্রায় এক রকম, তবে কাঠচাঁপা ফুল শুধু সাদা হয় না- লাল ও মিশ্র বর্ণের আছে ও সুগন্ধও অনেক বেশি। নাগচাঁপা ফুলের কোনো ঘ্রাণ নেই।
তবে দুটি ফুলেরই পাপড়ি পাঁচটি, দুটি ফুলই ফোটে ডালের আগায় থোকা ধরে। ফোটার পর ফুলগুলো গাছে কয়েক দিন থাকার পর ঝরে পড়ে। নাগচাঁপাগাছের পাতার গড়নে কাঠচাঁপার সঙ্গে রয়েছে ভিন্নতা। কাঠচাঁপাগাছের পাতা বড়, পুরু, চওড়া, প্রজাতির ও জাতভেদে পাতার অগ্রভাগ তীক্ষ্ণ বা ভোঁতা। নাগচাঁপাগাছের পাতা কাঠচাঁপার চেয়ে ছোট, বোঁটার দিকের অংশ সরু, অগ্রভাগ হঠাৎ প্রশস্ত হয়ে চামচের বা সাপের ফণার আকৃতি ধারণ করে, এই কারণেই এ ফুলের বাংলা নাম রাখা হয়েছে নাগচাঁপা বা নাগচম্পা।
ব্রাইডাল বুকে নামের ভারতীয় বাংলা নামকরণ করা হয়েছে প্রেমনলিনী যা এদেশে প্রচলিত না। এর অন্য দুটি ইংরেজি নাম গোল্ডেন অ্যারো বা গিল্ডেড স্পুন। এদেশে ফুলটি নাগচাঁপা বা নাগচম্পা নামেই পরিচিত। এ নামকরণও যথার্থ কি না তা নিয়ে সন্দেহ জাগে। কেননা, চাঁপা নামের ফুলগুলোর বিশেষত্ব হলো তার সুমিষ্ট সৌরভ যা নাগচাঁপার নেই। গাছপালার বাংলা নামকরণগুলো যথার্থ ও গ্রহণযোগ্য করার জন্য এ দেশের উদ্ভিদবিদদের কাজ করা দরকার।
নাগচাঁপা গাছের উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম প্লুমেরিয়া পুডিকা (Plumeria pudica) ও গোত্র অ্যাপোসাইনেসি (Apocynaceae)। এ ফুলগাছের আদিনিবাস পানামা, কলম্বিয়া ও ভেনেজুয়েলায়। কোনো এক সৌখিন উদ্যানপ্রেমীর হাত ধরে বিদেশ থেকে কোনো এক সময় নাগচাঁপাগাছ হয়তো আমাদের দেশে চলে এসেছে।
বর্তমানে প্রায় সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে। শহরের ছাদবাগানে টবে ও বাড়ির বাগানে, নার্সারিতে এখন নাগচাঁপা এক সুলভ গাছ। রমনা পার্কে ও ঢাকার হেয়ার রোডে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনার সামনের বাগানে যেমন দেখেছি নাগচাঁপা ফুটতে তেমনি কক্সবাজারের উখিয়ার এক গ্রামের বাড়ির বাগানেও দেখেছি তাকে।
নাগচাঁপা দ্রুত বর্ধনশীল গাছ। ডাল কেটে মাটিতে পুঁতে দিলে সহজে সেখানে জন্মে। কাণ্ড নরম, ডালপালাও কম হয়। কাণ্ড সোজা ও খাড়াভাবে ওপরে উঠে যায়। গাছ দুই থেকে আড়াই মিটার লম্বা হয়। ডালের মাথার দিকে ঘনভাবে চারদিকে ছড়িয়ে লম্বা লম্বা পাতা জন্মে। পাতা ১৫ থেকে ২০ সেন্টিমিটার লম্বা ও ২ থেকে ৫ সেন্টিমিটার চওড়া। বোঁটা খাটো ও সবুজ, পাতাও সবুজ। পাতার শিরাবিন্যাস স্পষ্ট। ডালের আগায় থোকা ধরে সাদা রঙের ফুল ফোটে। সারা বছর ফুল ফুটলেও বর্ষা ও শরৎকালে বেশি ফুল ফোটে। রোদেলা জায়গায় ভালো হয় ও বেশি ফুল ফোটে।
নাগচাঁপা এ দেশে এক সুলভ প্রজাতির গাছ। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ সংস্থা আইইউসিএন-এর তালিকায় নাগচাঁপা একটি ন্যূনতম উদ্বেগজনক প্রজাতির উদ্ভিদ, তাই একে নিয়ে শঙ্কার কিছু নেই। যেভাবে নাগচাঁপা অনেকের আদরে এ দেশের ফুলের বাগানে ঠাঁই করে নিয়েছে তাতে সহজে সে হারিয়ে যাবে না।