মেরু সাগরের নীল জল। সাদা ও হালকা ধূসর পালকের একটি পাখি তার ঠোঁট জলে ডুবিয়ে, মাথা নত করে ডেকে ডেকে আরেকটি পাখির দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে। এই আবেদন নিরন্তর। তারপর দেখলাম ওই ঝাঁকের আরও কিছু পাখি একই ধরনের আচরণ করছে। আর কিছু পাখি চুপচাপ তা দেখছে। একপর্যায়ে একটি পাখি অন্য একটি পাখির আবেদনে সাড়া দিল। এতে দুটি পাখির মেলবন্ধন হয়ে গেল। এরপর ওদের প্রেম পর্বের কিছু অংশ পর্যবেক্ষণের সৌভাগ্য আমার হয়েছিল উত্তর নরওয়ের নানান বসতিতে ১২ দিনের এক সমুদ্র অভিযাত্রায়। জোড়া বাঁধার পর তাদের অফুরন্ত ডাকাডাকি ও ভালোবাসার দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। খুব কাছে গিয়েছি। ওরা উড়ে যায়নি।
মূলত এই পাখি সাগরের কাছে পর্বতের খাঁজে বাসা বানায়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে জনবসতির কাছাকাছি বাসা বাঁধার প্রবণতা বেড়েছে। নরওয়ের সুদূর উত্তরের শহরগুলো এবং ট্রমসো শহরের মানুষের কাঠামোতে এ পাখির বাসার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। তার কারণ হিসেবে গবেষকরা বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তন-সম্পর্কিত প্রজনন ব্যর্থতা এবং প্রাকৃতিক শিকারিদের অনুপস্থিতির কারণে তাদের ছানাদের বড় করার জন্য একটি নিরাপদ পরিবেশ উপহার দেয় উত্তর নরওয়ের উপকূলীয় শহরগুলো।
প্রতিবছরই বাংলাদেশে নতুন প্রজাতির পাখির দেখা মিলছে। দেশের পরিযায়ী পাখির তালিকায় ২০১৬ সালে যোগ হয়েছিল আর্কটিক মহাসাগর, উত্তর আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার পাখি কালো-পা কিডিওয়েক। প্রসঙ্গত, কিছু পরিযায়ী পাখি আমাদের দেশে খুবই অনিয়মিত। এমন হতে পারে, এক শ বছরে মাত্র একবার দেখা যেতে পারে কোনো প্রজাতির পাখির। পথভুলে কিংবা সাগর-মহাসাগরে ঝড় হলে সাগরচারী পাখিরা নিরাপদ আবাসের খোঁজে চলে আসে। ঝোড়ো বাতাসের গতিও তাদের দিক পরিবর্তন করে অন্যত্র উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে। তা ছাড়া ঠাণ্ডার প্রকোপে অনেক পাখি উষ্ণ এলাকায় পাড়ি জমায়।
২০১৬ সালে বাংলাদেশে কালো-পা কিডিওয়েক ভোলার নদীর ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় প্রথম দেখা যায়। ২০১৬ সালের পর পাখিটি আর দেখা গেছে কি না আমার জানা নেই। তবে সম্প্রতি উত্তর নরওয়ের আর্কটিক মহাসাগর এলাকায় গিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে কালো-পা কিডিওয়েকের দেখা পেয়েছি। মূলত উত্তর নরওয়ের উপকূলবর্তী এলাকার পোতাশ্রয়, নৌবন্দর এবং বন্দর এলাকার জনবসতির কাছাকাছি এদের দেখেছি। ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি তখন জোড়া বেঁধে বাসা বানানোর জন্য নৌবন্দরের কাছে এবং মানববসতির কাছে জড়ো হয়েছে। খুব ডাকাডাকি করছে। সাগরে গিয়ে পুরুষ পাখিটি মাছ ধরে নিয়ে এসে মেয়ে পাখিকে দেয়।
এ পাখির ইংরেজি নাম The black-legged kittiwake (Rissa tridactyla)। এরা গাঙচিল পরিবারের পাখি। এরা বেশির ভাগ সময় সাগরে বসবাস করে এবং সামুদ্রিক এলাকার খোলা পর্বতে বাসা বানায়। এ পাখি যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, কোরিয়া, জাপান, নরওয়ে, কানাডা এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জে দেখা যায়। তবে মাঝে মাঝে এরা অন্যান্য গাঙচিলের সঙ্গে ভারতীয় উপমহাদেশের উপকূলে চলে আসে। ২০০৫ ও ২০১২ সালে এটি ভারতের কেরালা ও মহারাষ্ট্রের সৈকত এলাকায় এবং আসামের মাজুলি দ্বীপে দেখা গিয়েছিল।
এ পাখি সাধারণত নিজেদের ঝাঁকে থাকে। তবে কখনো অন্য সামুদ্রিক পাখির সঙ্গে যোগ দেয়। খাবার তালিকায় আছে মাছ, স্কুইড, চিংড়ি, পাখির ডিম, সামুদ্রিক শৈবাল ইত্যাদি। প্রজননকালে এরা উপনিবেশ তৈরি করে বসবাস করে এবং সমুদ্র উপকূলের পর্বতে বাসা বানিয়ে ডিম পাড়ে। একটি উপনিবেশে এক লাখ কিডিওয়েক পাখি থাকতে পারে। পাখির পালক ও সামুদ্রিক আগাছা দিয়ে উভয় পাখি মিলেমিশে বাসা বানায়। মেয়ে পাখি এক-তিনটি ডিম পাড়ে। পালা করে ডিমে তা দেয়। ২৪-২৮ দিনে ডিম ফেটে ছানা বের হয়ে আসে। ছানা উড়তে শিখে বাসা ছাড়ে প্রায় ৩৪-৫৮ দিনে। প্রজননের পর এরা সাগরে ফিরে যায়। নবাগতরা প্রায় তিন-পাঁচ বছর একটানা সমুদ্রে কাটায়। তারপর ডিম পাড়তে আগের জায়গায় ফিরে আসে। এরা সাধারণত সমুদ্রের যে অংশে ঢেউ ও পুষ্টি উপাদান বেশি থাকে সেদিকে খাবার খোঁজে। একটি পাখি প্রায় ১৩ বছর বাঁচে। শিকার, ডিম সংগ্রহ ও সমুদ্র তেলদূষণের কারণে এ পাখির সংখ্যা কমে যেতে শুরু করেছে। সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থান পর্যবেক্ষণের জন্য কিডিওয়েক একটি নির্দেশক পাখি হিসেবে বিশ্বে ও পরিবেশবিদদের কাছে বিবেচিত।
প্রকৃতিবিষয়ক লেখক ও পরিবেশবিদ, জার্মান অ্যরোস্পেস সেন্টার