জয়পুরহাট শহর থেকে প্রায় সোয়া কিলোমিটার দূরে গৌরীপাড়া এলাকা। সেখানে একটি বাঁশঝাড়ে এক ঝাঁক পরিযায়ী পাখি বাসা বেঁধেছে। পাখিগুলো দেখতে অনেকটা বকের মতো। কিন্তু এরা বক নয়। এরা হলো খয়রা কাস্তেচরা পাখি। এদের ঠোঁট কাস্তের মতো বাঁকা। তাই এদের বলা হয় কাস্তেচরা।
সাধারণত শীতকালে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিল ও হাওরে এসব পাখির উপস্থিতি দেখা যায়। কিন্তু দেশে এই প্রথম এদের বাসার সন্ধান মিলল। বাসাগুলোতে ডিম ফুটে ছানা বেরিয়েছে। এই কলোনিতে ৫০টির মতো খয়রা কাস্তেচরা পাখি আছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, পাখিগুলো গৌরীপাড়ার একটি বাঁশঝাড়ে প্রায় সাত বছর ধরে বসবাস করছে। তারা এর নাম জানতেন না। পরে একজন পাখি বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে জেনেছেন এরা খয়রা কস্তেচরা পাখি।
স্থানীয় বাসিন্দা সোহেল রানা বলেন, ‘পাখিগুলো দীর্ঘদিন ধরে আমাদের গ্রামের বাঁশঝাড়ে দেখছি। গ্রামের মানুষ পাখিগুলোকে ভালোবাসে। কেউ পাখিগুলোকে উপদ্রব করে না।’
মানিক নামের একজন বলেন, ‘পাখিগুলো দেখতে অনেক সুন্দর। এরা দিনের বেলায় খাবার সংগ্রহের জন্য দূরে কোথাও উড়ে যায়। আবার সন্ধ্যার আগে ফিরে আসে। পাখিগুলোর কিচিরমিচির আমাদের খুব ভালো লাগে।’
একই এলাকার রানা নামে একজন বলেন, ‘পাখির প্রজনন যাতে বাধাগ্রস্ত না হয়, সে ব্যাপারে দেখভালের পাশাপাশি এদের রক্ষায় সরকারিভাবে উদ্যোগ নেওয়ার আহবান জানাচ্ছি।’
এই পাখি কলোনির প্রথম সন্ধান পান আক্কেলপুরের বাসিন্দা বন অধিদপ্তরের পাখি বিশারদ শিবলি সাদিক সাদমান। তিনি বলেন, ‘বিরল পাখি আবিষ্কার নেশায় আমি বিভিন্ন জেলায় ঘুরে বেড়াই। সেই নেশা থেকে ঘুরতে ঘুরতে জয়পুরহাটের গৌরীপাড়ায় এসে খয়রা কাস্তেচরা পাখির সন্ধান পাই। এর আগেও পাখিটি দেখেছি। কিন্তু বাচ্চা তোলা এখানেই প্রথম দেখলাম। পরে ছবি তুলে আমার স্যারকে পাঠাই। তখন স্যার আমাকে জানান, এই পাখি বাংলাদেশে এই প্রথম বাসা বেঁধেছে। ডিম থেকে বাচ্চা হয়েছে। এটি অতি দুর্লভ ঘটনা। কলোনিটি সংরক্ষণের জন্য আমরা বন বিভাগের পক্ষ থেকে একটি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছি।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এম মুনিরুল এইচ খান বলেন, ‘সাদমানের কাছ থেকে আমি খবর পেয়ে গৌরীপাড়া পাখি কলোনি দেখতে গিয়েছিলাম। সেখানে ৫০টির মতো খয়রা কাস্তেচরা পাখি রয়েছে। কয়েকটি বাসা করেছে। ছানাও দেখলাম। কয়েকটি ছানা বেশ বড় হয়ে গেছে। বাংলাদেশের অনেক জায়গায় এই পাখি দেখা গেলেও বাসা বানানোর রেকর্ড এটিই প্রথম। বিলুপ্তপ্রায় পাখিটি সংরক্ষণ জরুরি বলে মনে করছি।’
খয়রা কাস্তেচরা পাখির বৈজ্ঞানিক নাম প্লেগাডিস ফ্যালসিনিলাস। এদের স্থায়ী আবাস পশ্চিম ভারতে। শীত মৌসুমে এরা ঝাঁকে ঝাঁকে বাংলাদেশে আসে। মৌসুম শেষে ফিরে যায়। পাখিটির দৈর্ঘ্য সাধারণত ৪৮ থেকে ৬৬ সেন্টিমিটার হয়ে থাকে। এদের ডানা ৮০ থেকে ১০৫ সেন্টিমিটার লম্বা হয়। ওজন ৪৮৫ থেকে ৯৭০ গ্রাম হয়। এদের মাথায় পালক থাকে এবং সরু ঠোঁট নিচের দিকে বাঁকানো। খাল, বিল, হ্রদ, নদী, খাড়ি ও লবণাক্ত জলাভূমিতে এরা বিচরণ করে। এরা খাল-বিল-পুকুর আর ফসলের মাঠ থেকে পোকামাকড়, শামুক, কাঁকড়া খেয়ে জীবনধারণ করে।