আমেরিকা এসেছি বেশ কিছুদিন। প্রথম ৭ দিনই আকাশ ঢেকে ছিল ছাইরঙা মেঘে। থেকে থেকে সেসব মেঘ থেকে পুষ্পবৃষ্টির ঝরেছে। পহেলা অক্টোবরে আবহাওয়ার পূর্বাভাস বলল, আগামী দুই দিন বৃষ্টি হবে না। সে পূর্বাভাসকে শিরোধার্য করে তিন তারিখে বেরিয়ে পড়লাম পেনসিলভানিয়ার পিটসবার্গ শহর থেকে আপার নিউইয়র্কের ওয়াটকিনস গ্লেনের উদ্দেশে। কিন্তু বেরোনোর পর এবার আর ঝিরঝিরে না, নামল আকাশ ভেঙে বৃষ্টি। তবু তাকে উপেক্ষা করে এগিয়ে চললাম ওয়াটকিনস গ্লেন স্টেট পার্কের পথে। মনে মনে বৃষ্টিকে যেন আহ্বানই করলাম। আশা, বৃষ্টির জলে হয়তো ঝরনার বেগ বাড়বে। কেননা, যেখানে যাচ্ছি সেটা যুক্তরাষ্ট্রের একটি জনপ্রিয় পার্ক, যেখানে রয়েছে একটি দীর্ঘ গিরিখাত, ১২টি ট্রেইল আর ১৯টি ঝরনা।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৬ হাজার পার্কের ভেতর জনপ্রিয়তায় এ পার্কের র্যাঙ্কিং প্রথম ৫টির মধ্যে। অতএব, দূরের দেশে এসে এমন একটি পার্কে বৃষ্টি, ঝরণার উৎসবে মাতব না তো আর কোথায় মাতব? একেই বলে বৃষ্টিবিলাস।
যাওয়ার পথেই চোখে পড়েছে অসংখ্য পার্কের সাইনবোর্ড আর পাহাড়ি দৃশ্য। আলো, মেঘ, ছায়া প্রকৃতিকে যে ক্ষণে ক্ষণে কী রকম বদলে দিতে পারে, তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। পাহাড়ি পথ, বেশ উঁচু উঁচু পাহাড়, কিন্তু সেসব পাহাড়ে গাড়ি ছুটে চলছে বেশ দ্রুতগতিতে। তাই জানালার কাচ দিয়ে কেবলই দেখে যাচ্ছি দ্রুতবেগে সরে যাওয়া প্রকৃতির নানা ইজেল। পাহাড়ের উপত্যকাজুড়ে ঘন বন, ছোট বড় নানা রকমের বনবৃক্ষ। শরৎকাল হওয়ায় সেসব বৃক্ষের পাতার সবুজ রঙ বদলে হলদে, কমলা ও লাল হতে শুরু করেছে। ভারি সুন্দর সেসব দৃশ্য। আমরা চলেছি মাউন্টেন রেঞ্জ পেরিয়ে ফাউন্টেন রেঞ্জে। বৃষ্টি পড়ছে, মেঘ উড়ছে, সেই সঙ্গে মনও যেন উড়ে চলেছে। অধীর হয়ে অপেক্ষা করছি কখন আবহাওয়ার পূর্বাভাস সত্যি হয়। ছেলে জানাল, দুপুর ১২টার পর রোদ ওঠার কথা। কিন্তু আমরা ওয়াটকিনস গ্লেনে পৌঁছে গেলাম বেলা সাড়ে ১১টায়। তাই তখনো বৃষ্টি ঝরছে। সেখানে প্রবেশ করতেই এক অদ্ভুত মোহের ঘোরে পড়ে গেলাম। দুপাশে সুউচ্চ পাহাড়। মাঝখানে গভীর গিরিখাত। গিরিখাতের নিচ দিয়ে বয়ে চলেছে ঝরনার জল, পাশে ধাপে ধাপে অসংখ্য সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠা। শুধুই ওপরে ওঠা আর একটার পর একটা ঝরনা দেখা। বৃষ্টি থেমেছে, ছাতা লাগছে না, পাহাড়ের কোল দিয়ে পাহাড়কেই ছাতা করে এগিয়ে চলেছি আর পাহাড়ের ওপরের দিকে তাকিয়ে গিরিখাতের ওপরে নিচ থেকে দেখছি নানা রকম বৃক্ষের পাথুরে পাহাড়ে টিকে থাকার দুর্মর বাসনা। শিকড়ের অর্ধেক মাটি সরে গেছে, তবু বিশাল দেহ নিয়ে বড় বড় বৃক্ষরা খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কোনো বৃক্ষতলে, গোড়ায় সবুজ মখমলের মতো জন্মেছে মস, মরা ডালপালার ওপর রিকশিয়া ও লাইকেন। কত রকমের গাছ, চিনি না। শুধু ছবি তুলে রাখছি সেগুলোর।
একে একে ঝরনাগুলো দেখতে দেখতে উঠে পড়লাম গিরিখাতের মাঝামাঝি, সেন্টার ক্যাসকেডে। সেটা পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম ৭ নম্বর ঝরনাটার কাছে। উনিশটা ঝরনা দেখতে হলে শেষ পর্যন্ত যেতে হবে, সে জন্য না কি প্রায় ১০ মাইল হাঁটতে হবে। যতই ওপরে উঠব, ঝরনার দেখা মিলবে বাঁকে বাঁকে। লোভ হলো। কিন্তু সময় ও সামর্থ্য পারমিট করল না বলে ফিরে এলাম সেই মাঝপথ থেকেই।
স্মরণ করতে চেষ্টা করলাম ওয়াটকিনস গ্লেন স্টেট পার্কের গিরিখাত ও জলার্দ্র অরণ্যের বুনো ফুলগুলোকে। কোনোটা সাদা, কোনোটা গোলাপি, কোনোটা বেগুনি, নীল ও খয়েরি লাল। কোনো ফুলই নিশ্চিতভাবে চিনি না। কত যে ঘাস ফুল! বিষকাটালির গোলাপি বুনোফুল থেকে শুরু করে বুনো ডেইজি ও বুনো অ্যাস্টার। শেষে এক অপরূপ বুনো ফুলে চোখ আটকে রইল। অদ্ভুত গড়ন ফুলটার। পুষ্পমঞ্জরিতে ফুটে রয়েছে অসংখ্য ছোট ছোট গোলাপি ফুল। বৃষ্টিতে ভিজে সেগুলো হয়েছে আরও সতেজ।
অন্তর্জাল ঘেঁটে গাছের নামটা পাওয়া গেল রেড ক্লোভার, উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Trifolium pratense ও গোত্র Fabaceae. অর্থাৎ গাছটা শিমগোত্রীয়। বহুবর্ষজীবী বিরুৎ প্রকৃতির এ গাছ আমেরিকায় আগাছার মতো যেখানে-সেখানে জন্মে ও খুব বাড়ে। পাথুরে কাঁকুড়ে মাটিতে জন্মাতেও তার আপত্তি নেই। গাছ বড়জোড় ২০ থেকে ৮০ সেন্টিমিটার লম্বা হয়। পাতা চিনাবাদামের পাতার মতো তিনটি পত্রকবিশিষ্ট। এ গাছ চেনার সহজ উপায় হলো, এর পাতায় বিশেষ ‘ভি’ আকৃতির হালকা সবুজ রঙের চিহ্ন থাকে। ভ্রমর আর মৌমাছিদের আকর্ষণ করে এ ফুল। গোলাপি ছাড়া সাদা রঙের ফুলও আছে। রেড ক্লোভার গাছ উত্তম পশুখাদ্য, আগাছা হলেও এর শিকড় মাটির উর্বরতা বাড়ায়। আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়া এর আদিনিবাস।