পাখির নাম ছাতিঘুরুনি! এ নাম শুনে শহুরে মানুষ অবাক হলেও গাঁয়ের লোকের কাছে নামটি বেশ পরিচিত এবং পাখিটিও চেনা। গ্রামের বাঁশঝাড়ে ঢুকলে মশা, জাবপোকা, হাতিপোকা, অশ্রুচোষা ইত্যাদি কীটপতঙ্গ যদি আপনাকে ঘিরে ওড়াউড়ি করতে থাকে তো দুদণ্ড স্থির থাকুন। দেখবেন, পতঙ্গের টানে ছাতিঘুরুনি পাখি এসে আপনার মাথার ওপরে কঞ্চিতে বসেছে। যেসব উড়ুক্কু পোকামাকড় উষ্ণ রক্তের প্রাণির পিছু নেয়, তা শিকার করাই এ পাখির প্রতিদিনের কাজ। তবে কাছে এসে বসলেও পাখিটিকে ঠাহর করা অনভিজ্ঞ দর্শকের জন্য কঠিন এক কাজ। চোখের সামনে এসেও অদৃশ্য থাকার সব ব্যবস্থা রয়েছে এ পাখির। কিন্তু দেখতে না পেলেও পাখিটির তীক্ষ্ণকণ্ঠ ‘চিক-চিক-চি-চি-হুইচ’ গানটি আপনি নিশ্চয়ই শুনতে পাবেন।
বন, বাগান ও ঝোপঝাড়ের অন্ধকারে মিশে থাকলে পতঙ্গ শিকারে সুবিধা হয় বলে ছাতিঘুরুনির গায়ের প্রায় সব পালকই কালো। অন্ধকার বনকোণে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পোকামাকড় খুঁজে পাওয়ার জন্য এর কালো, বিস্ফারিত ও বিশাল একজোড়া চোখ আছে। মিশকালো এই পাখির দর্শনীয় সাজসজ্জার মধ্যে আছে শুধু সরু একজোড়া সাদা ভ্রু ও ধবল একটি গলাবন্দ। এই গলাবন্দের জন্যই পাখিটির পোশাকি নাম ‘ধলাগলা ছাতিঘুরুনি’ এবং ইংরেজি নাম ‘হোয়াইট-থ্রোটেড ফ্যানটেইল’। ছাতিঘুরুনি পাখির দেহের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ হলো এর লেজ- ৭ ইঞ্চি লম্বা দেহের ৪ ইঞ্চিই লেজ। লম্বা-চওড়া ১২টি পালকে গড়া এই লেজ সে বারবার মেলে ধরে আর গুটিয়ে নেয় জাপানি পাখার মতো। এক মুহূর্ত কোথাও স্থির থাকে না। অতি চঞ্চল এই পাখি। এক দণ্ড দাঁড়ালেও সে দেহটিকে অনবরত ডানে-বাঁয়ে ঘোরাতে থাকে। এ জন্যই ছাতিঘুরুনির অহমীয়া নাম ‘নাচনি চড়াই’। ভারতের আসাম, মেঘালয়, পশ্চিমবঙ্গ ও বিহার এবং বাংলাদেশ, মায়ানমার, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় এ পাখির বসবাস সীমিত।
‘ছাতিঘুরুনি’ বা ‘ফ্যানটেইল’ কিন্তু একটিমাত্র পাখির নাম নয়, ৬৬ প্রজাতির একটি বৃহৎ পরিবারের নাম। এ পরিবারের পাখিরা ভারতবর্ষ থেকে শুরু করে পুবে চীন ও দক্ষিণে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড হয়ে ভানুয়াটুর মতো প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপে বসবাস করে। কিন্তু এই একটি অঞ্চল ছাড়া বিশ্বের অপর পাঁচটি মহাদেশের কোথাও কোনো প্রজাতির ছাতিঘুরুনি পাখির চিহ্নমাত্র নেই। দুঃখের কথা, আমাদের দেশেও ‘ধলাগলা ছাতিঘুরুনি’ নামে এই একটিমাত্র প্রজাতি ছাড়া আর কোনো ছাতিঘুরুনি নেই। দক্ষিণ ভারতে আবার ‘ধলাগলা ছাতিঘুরুনি’ নেই, আছে অপর একটি প্রজাতি, যার নাম ‘ধলাবুটি ছাতিঘুরুনি’। এ পরিবারের যে সদস্য ম্যানগ্রোভ বা নোনাবনে বাস করে তার নাম ‘নোনাবন-ছাতিঘুরুনি’। এ ক্ষেত্রে আবার দুঃখ করে বলতে হচ্ছে যে, এই প্রত্যাশিত প্রজাতিটিও সুন্দরবনে অনুপস্থিত। উত্তর অস্ট্রেলিয়ার নোনাবনে গিয়ে সম্প্রতি আমরা এই প্রজাতির দেখা পেয়েছি। তবে বাংলাদেশে একটিমাত্র প্রজাতির বসবাস হলেও এখনো দেশের সর্বত্র এ পাখির দেখা পাবেন। এককালে গ্রামের খোলা শৌচাগারগুলোই ছিল ছাতিঘুরুনির জন্য অন্তহীন আহার্যের ভাণ্ডার। গ্রামাঞ্চলে স্যানিটারি শৌচাগার জনপ্রিয় হওয়ায় আহার্যের সেই সাপ্লাই-চেইন এখন ভেঙে পড়েছে। ফলে এ পাখির সংখ্যা কিছুটা কমেছে বটে কিন্তু শঙ্কিত হওয়ার মতো কিছু নয়। এ দেশে যত দিন মশা, জাবপোকা ইত্যাদি খুদে পতঙ্গের বসতি টিকে আছে ছাতিঘুরুনি পাখিরা ততদিন অভুক্ত থাকবে না।