গ্রামগঞ্জে গেলে ‘কুরা’ নামে সুদর্শন এক পাখি দেখতে পাবেন। খুঁজলে শহর ও নগরের কলুষিত জলাশয়ের পাশেও এ পাখির দেখা মেলে। নদীনালা ও খানাডোবার পাশে সারা দিন একাকী বসে থাকে এ পাখি। মাছ শিকার করে জীবন চালায় বলে জলাশয় ঘিরেই গড়ে উঠে এর জীবন। জলাশয়ের ওপর ঝুঁকে পড়া বৃক্ষশাখায় এ পাখি নিশ্চল বসে থাকে। মানুষের আনাগোনা কম থাকলে জলার পাড়ে মাটিতেও সে এসে বসে। পানির দিকেই সারাক্ষণ তার দৃষ্টি থাকে। অসুস্থ অথবা অসতর্ক কোনো মাছ পানির ওপরে ভেসে উঠলেই সে উড়ে গিয়ে থাবা মারে।
মাছের পিচ্ছিল শরীর আঁকড়ে ধরার জন্য এ পাখির শক্তিশালী নখরে বাড়তি নানা ব্যবস্থা আছে। কুরার থাবা থেকে কোনো দিন কেউ মাছ ফসকে যেতে দেখেছে বলে শুনিনি। তবে কুরা এসে পুকুরের মাছ খেয়ে সর্বনাশ করছে, এ অভিযোগটিকেও অতিরঞ্জিত আখ্যা দেওয়া যায় অনায়াসে। কুরা পাখিরা সচরাচর ছোট, দুর্বল ও অসুস্থ মাছই ধরে খায়। এর ফলে পুকুরের সুস্থ মাছগুলো দ্রুত বড় হওয়ার সুযোগ পায়; এবং মাছের খামারির সম্ভবত তাতে লাভই বেশি হয়।
সাধারণত অক্টোবর মাসেই এ পাখির প্রজননকাল শুরু হয়। এখন এ পাখি সহজেই লোকের চোখে পড়বে। চোখে দেখতে না পেলেও বহুদূর থেকে এর জোরালো কণ্ঠ শুনতে পাবেন। পূর্বরাগে প্রহরে প্রহরে এ পাখি উচ্চস্বরে ডাকে: ‘ও-অঅক, ও-অঅক, ও-অঅক...। ‘অধিকাংশ শিকারি পাখির মতো পুরুষ কুরা পাখিটি স্ত্রীর চেয়ে আকারে ও ওজনে অনেকটা ছোট হলেও হাঁকডাকটা তারই বেশি। এই ডাকের জন্যই এদেশে অনেকে একে ‘ওকপাখি’ বলেন। সম্ভবত একই কারণে এর অহমীয়া নাম ‘উকাহ’। এর চেয়ে আমাদের গ্রামের ছোট্ট ‘কুরা’ নামটিই ভালো; যদিও হৈমন্তী ফসলের খেতে বাসা বাঁধতে আসা এদেশের অতিপরিচিত ‘কোড়া’ পাখির সঙ্গে নামের সাদৃশ্য থাকায় অনেকে বিভ্রান্ত হয়ে থাকেন।
ছোট, সুন্দর ও জনপ্রিয় হলেও ‘কুরা’ নামটি নিয়ে আমাদের অনেক অতৃপ্তি ছিল। ‘কুরা’ যে ডাকসাইটে একটি ঈগল পাখি, সে কথাটা উহ্য ও অজানা থেকে যায় ওই ক্ষুদ্র নামে। তাই আমরা এর নতুন নামকরণ করেছি ‘কুরাঈগল’। ‘বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ’ প্রণীত বাংলাদেশের ৬৫০ প্রজাতির পাখির প্রমিত নামের তালিকায় এ পাখির পোশাকি নাম হয়েছে ‘মেটেমাথা কুরাঈগল’। বাংলাদেশে একাধিক প্রজাতির কুরাঈগল আছে বলেই এর নামে ‘মেটেমাথা’ উপাধিটি জুড়ে দিতে হয়েছে। এ পাখির ইংরেজি নাম ‘গ্রে-হেডেড ফিশঈগল’। বিশ্বে মাত্র পাঁচ প্রজাতির পাখির ইংরেজি নামে ‘ফিশঈগল’ কথাটি রয়েছে। এখন বাংলায় আমরা এদের সবাইকে ‘কুরাঈগল’ বলি। এদেশের অপর ফিশঈগলটির নাম ‘পালাসি কুরাঈগল’।
মেটেমাথা কুরাঈগল পাখির বসতি ভারত থেকে পূর্বদিকে ফিলিপাইন পর্যন্ত বিস্তৃত। একদা বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গই ছিল এ পাখির মূল ঘাঁটি। তবে এখন আর তা নয়। এ অঞ্চলের জলাধারগুলো সংকীর্ণ, কলুষিত ও জনাকীর্ণ হয়ে ওঠায় এই কুরাঈগলের সংখ্যা ক্রমাগত কমে যাচ্ছে। সাভার, ইকুরিয়া ও উত্তরায় আগে আমরা প্রায়ই এ পাখি দেখতে পেতাম; এখন আর তা পাইনি। বুড়িগঙ্গার ওপারে আগে এ পাখির বাসা ও ছানা দেখেছি অনেকবার। এখন তার দেখা মহাভাগ্যে মেলে।