ঢাকা ২২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, শনিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪

নদীর প্রাণ ডলফিন-শুশুক, নিরাপদে বেঁচে থাকুক

প্রকাশ: ২৩ অক্টোবর ২০২৪, ০৭:৩৩ পিএম
আপডেট: ২৩ অক্টোবর ২০২৪, ০৭:৩৩ পিএম
নদীর প্রাণ ডলফিন-শুশুক, নিরাপদে বেঁচে থাকুক

ডলফিন বা শুশুক  নদী ও সমুদ্রের সৌন্দর্য বৃদ্ধির পাশাপাশি পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে এক অসাধারণ ভূমিকা পালন করে। ডলফিন আমাদের পরিবেশের এক গুরুত্বপূর্ণ সূচক। জলজ বাস্তুসংস্থানের স্বাস্থ্য ও স্থিতিশীলতা নির্ভর করে এই প্রজাতির ওপর। বিশেষ করে মিঠা পানির ডলফিন জলজ প্রাণীদের খাদ্য শৃঙ্খল সুরক্ষিত রাখে। জলবায়ু পরিবর্তন ও দূষণ যখন আমাদের নদী, হ্রদ ও সাগরকে বিপর্যস্ত করে তুলছে, তখন ডলফিন একধরনের প্রাকৃতিক 'সতর্ক বার্তা' দেয়। যদি ডলফিনের সংখ্যা কমতে থাকে বা তাদের মধ্যে রোগ দেখা দেয়, তা সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রে দূষণ বা অন্যান্য পরিবেশগত সমস্যার ইঙ্গিত দেয়। তাই ডলফিনের অবস্থান এবং সংখ্যা পরিবেশের সঠিক অবস্থা জানার অন্যতম প্রধান মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত। তারা শিকারি হিসেবে দুর্বল ও অসুস্থ মাছ খায়, যা পানির জীববৈচিত্র্যকে স্বাস্থ্যকর রাখে। ডলফিনের এই শিকার করার প্রবণতা সমুদ্রের মাছের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখে, যা সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রে ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। ডলফিনের সংরক্ষণ সামুদ্রিক জীবনের অন্যান্য প্রজাতির জন্যও উপকারী, কারণ তাদের অনুপস্থিতি বা সংখ্যার হ্রাস সামুদ্রিক পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করতে পারে।

বিশ্বের অন্যান্য ডলফিন সমৃদ্ধ দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও মিঠাপানির ডলফিন সংরক্ষণে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রতিবছর বন অধিদপ্তর কর্তৃক এ দিবসটি পালন করা হয়। 'নদীর প্রাণ ডলফিন-শুশুক, নিরাপদে বেঁচে থাকুক' প্রতিপাদ্যে ২৪ শে অক্টোবর আন্তর্জাতিক মিঠাপানির ডলফিন দিবস পালিত হবে। এ বছর দিবসটি উদযাপন উপলক্ষ্যে বন ভবন, আগারগাঁও, ঢাকা এর পাশাপাশি পাবনা, রাজশাহী, চট্রগ্রাম, খুলনা বাগেরহাটেও বিভিন্ন জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।

বন অধিদপ্তরের তথ্য মতে, আমাদের দেশে যে দুটি নদীর ডলফিন আছে তা হলো শুশুক ডলফিন আর ইরাবতী ডলফিন। আই.ইউ.সি.এন এর গ্লোবাল রেড লিস্ট ক্যাটাগরিতে দুটোই ঝুঁকিপূর্ণ ‘এন্ডেঞ্জার্ড এনিম্যাল’। ইরাবতীদের বাস আমাদের ৭২০ কি:মি: উপকূলীয় নদী কিংবা সাগরমূখে আর শুশুক ডলফিন বিচরণ করছে দেশে বিদ্যমান ৭০০ নদীর ২৪ হাজার কি:মি: এর একটি বড় অংশ জুড়ে। যদিও বর্ষামৌসুম ব্যতিরেকে শুষ্ক মৌসুমে এদের আবাসস্থল কমে বেশ সংকুচিত হয়ে যায়।

এই নদীর ডলফিন সংরক্ষণে বিশ্বের ডলফিন রেঞ্জ দেশগুলোর অনেক দেশের চেয়ে বাংলাদেশ এর পদক্ষেপ কিন্তু অনেকটাই অগ্রগামী। আশার কথা হলো আমাদের ডলফিনের আবাসের জন্য বিস্তীর্ণ জলরাশি রয়েছে। আমাদের প্রমত্তা পদ্মা, যমুনা, মেঘনাসহ, ব্র্রহ্মপুত্র, হালদা, বলেশ্বর, গড়াই-মধুমতী, ডাকাতিয়া প্রভৃতি নদীই রিভার ডলফিনের উপযুক্ত আবাসস্থল। বেশ কয়েক বছর ধরেই আমরা ডলফিন ও নদী বাঁচাতে মানুষের সচেতনতা বাড়াতে নানাবিধ কার্যক্রম গ্রহণ করে যাচ্ছি।

বাংলাদেশে গঙ্গা নদীর ডলফিনসহ অন্যান্য প্রজাতির ডলফিন বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে। এর প্রধান কারণ হলো নদীর দূষণ, অপ্রয়োজনীয় মাছ ধরার জাল, জলবিদ্যুৎ বাঁধ, এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নদীর প্রবাহে পরিবর্তন। এদের সংখ্যা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে, যা আমাদের বাস্তুসংস্থানকে ঝুঁকিতে ফেলছে। ডলফিন সংরক্ষণ কেবল একটি প্রজাতি সংরক্ষণ নয়, বরং আমাদের পরিবেশের সার্বিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার এক গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। যখন ডলফিনকে রক্ষা করা হয়, তখন তা জলজ পরিবেশের অন্যান্য প্রাণীদের জন্যও উপকার বয়ে আনে।

বাংলাদেশ সরকার এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে ডলফিন সংরক্ষণে বেশ কিছু কার্যক্রম শুরু করেছে। গঙ্গা নদীর ডলফিন সংরক্ষণে বিশেষ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে ডলফিনের বাস্তুসংস্থান উন্নত করার পাশাপাশি তাদের সংখ্যা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ডলফিনের আবাসস্থল সংরক্ষণ এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির কার্যক্রম নেয়া হয়েছে। ২০১২ সালে গাঙ্গেয় ডলফিনকে সংরক্ষিত প্রজাতির মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে, যা এদের রক্ষার প্রচেষ্টায় গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

সুন্দরবন ডলফিনের নিরাপদ আবাসস্থল হওয়ায় ২০১২ সালের জানুয়ারিতে দেশের প্রথম তিনটি ডলফিন অভয়ারণ্য ঘোষিত হয়। সুন্দরবনের চাঁদপাই, ঢাংমারী এবং দুধমূখী ডলফিন অভয়ারণ্যে যে কোন সময় গেলেই ডলফিন দেখা যায়। সুন্দরবন এবং এর আশেপাশের এলাকায় ২০২০ সাল পর্যন্ত ডলফিন এবং জলজ প্রতিবেশ রক্ষায় সরকারের প্রথম প্রকল্পটি সত্যিকার অর্থেই একটি সফল প্রকল্প। যে প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে সুন্দরবন নির্ভর জনসাধারণ বিশেষ করে জেলে সম্প্রদায়ের মধ্যে ডলফিনের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বেড়েছে।

ডলফিন সংরক্ষণ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে হালদা নদীতে ডলফিনের সংখ্যা নির্ণয় এবং ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। বন অধিদপ্তরের টেকসই বন ও জীবিকা (সুফল) প্রকল্পের আওতায় ‘ডলফিন কনজারভেশন প্রোগ্রামস ইন যমুনা, হালদা এন্ড আদার ইম্পর্টেন্ট রিভারস’ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে, ডব্লিউসিএস বাংলাদেশ গাঙ্গেয় ডলফিনের উপর ব্যাপক পর্যালোচনা ও গভীরতার সমীক্ষা পরিচালনা করে। বাংলাদেশ মেঘনা ও এর শাখা নদী, পদ্মা, যমুনা, কর্ণফুলী এবং হালদা নদীর ১ হাজার ৯০৫ কিমি এলাকাজুড়ে নদীর ডলফিনের ভিজ্যুয়াল বোট-ভিত্তিক সমীক্ষা পরিচালনা করা হয়। দুটি স্বাধীন পর্যবেক্ষক দল দ্বারা সমীক্ষা চালানো হয়। এই সমীক্ষার ফলে প্রায় ৬৩৬টি দল বা ১ হাজার ৩৫২টি গাঙ্গেয় ডলফিনের উপস্থিতি নির্ধারণ করা হয়।

নদীর চ্যানেল, গভীরতা ও পানির গুণগত মান সম্পর্কেও তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এসব তথ্য বিশ্লেষণ করে ১৬টি হটস্পট চিহ্নিত করে যেখানে গাঙ্গেয় ডলফিনের উপস্থিতি বেশি দেখা যায়। এর মধ্যে সাতটি হটস্পটকে স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণে সংরক্ষণ প্রকল্পের জন্য অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। এ পর্যন্ত, ডব্লিউসিএস সাতটি হটস্পটের মধ্যে পাঁচটি এবং একটি ডলফিন অভয়ারণ্যে গাঙ্গেয় ডলফিনের প্রয়োজনীয় সংরক্ষণ সম্পর্কিত কেএপি সমীক্ষা পরিচালনা করেছে। কেএপি সমীক্ষার সময়, ডলফিন রেসপন্স টিমের সদস্যদেরও চিহ্নিত করা হয় যারা জড়ানো বা আটকে পড়া জীবিত ডলফিনকে উদ্ধার, মৃত্যুর ঘটনা রিপোর্ট এবং স্থানীয় জনগণকে সচেতন করতে প্রশিক্ষণ পাবেন। স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ ও সচেতনতা বাড়ানোর জন্য, ডব্লিউসিএস স্টিকার, পোস্টার, টি-শার্ট, ক্যাপ এবং সাইনবোর্ডসহ শিক্ষামূলক উপকরণ তৈরি করেছে, যা গাঙ্গেয় ডলফিন সংরক্ষণের বার্তাগুলোকে ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করছে।

দেশব্যাপি ডলফিন সংরক্ষণ কার্যক্রম আরো জোরদার করার জন্য এবং বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বন অধিদপ্তর কর্তৃক শুশুক বা গাঙ্গেয় ডলফিনকে জাতীয় জলজ প্রাণী হিসেবে ঘোষণা করার প্রস্তাব করা হয়েছে।  এই প্রস্তাবটি বাস্তবায়িত হলে ডলফিন সংরক্ষণ আরও গুরুত্ব পাবে বলে আশা করা যায়। এর বাইরে, মিঠা পানির ডলফিন সংরক্ষণে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে কাজ করছে বাংলাদেশ সরকার। গবেষণা, ডলফিনের গতিবিধি ও স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ এবং প্রজনন সংক্রান্ত উদ্যোগও গ্রহণ করা হচ্ছে। এ ছাড়া, বিভিন্ন নদীতে পর্যটন নিয়ন্ত্রণ ও নদী দূষণ রোধে আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ বাড়ানো হয়েছে।

ডলফিন সংরক্ষণে সফলতা পেতে হলে সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণ ও সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। প্লাস্টিক, রাসায়নিক পদার্থ, এবং অপ্রয়োজনীয় বর্জ্য নদীতে ফেলার ফলে ডলফিনের আবাসস্থল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমাদের প্রতিটি ব্যক্তির দায়িত্ব হলো নদী ও সমুদ্র দূষণ বন্ধে সচেতন হওয়া। প্লাস্টিকের ব্যবহার কমিয়ে পুনর্ব্যবহারযোগ্য পণ্যের ব্যবহারকে উৎসাহিত করা উচিত। জেলে সম্প্রদায়কে সচেতন করা প্রয়োজন, যাতে তারা ডলফিনদের সংরক্ষণের লক্ষ্যে জাল ব্যবহার করার সময় সতর্ক থাকেন। ডলফিন সংরক্ষণের জন্য নিরাপদ ও আইনসম্মত মাছ ধরার পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। নদী ও উপকূলীয় এলাকায় নৌযান চালানোর সময় ডলফিনদের প্রতি বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে, যাতে তারা দুর্ঘটনার শিকার না হয়। 

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম, সামাজিক মাধ্যম ও স্থানীয় কমিউনিটির মাধ্যমে ডলফিন সংরক্ষণের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন। বিভিন্ন সচেতনতামূলক প্রোগ্রাম, কর্মশালা, এবং প্রচারণার মাধ্যমে মানুষের মাঝে এ বিষয়ে ধারণা দেয়া যেতে পারে। নৌকাভ্রমণ বা পর্যটনের ফলে ডলফিনের স্বাভাবিক চলাচলে বাধা সৃষ্টি হতে পারে। পর্যটকদের ডলফিন দেখার ক্ষেত্রে দূরত্ব বজায় রাখা ও নির্দিষ্ট নিয়মাবলী মেনে চলা উচিত। বাংলাদেশে মিঠা পানির ডলফিন সংরক্ষণের জন্য বেশ কিছু আইন ও বিধিনিষেধ রয়েছে, কিন্তু এর সঠিক প্রয়োগ প্রয়োজন। আইন লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে শাস্তির ব্যবস্থা আরও জোরদার করতে হবে।

ডলফিন শুধু সমুদ্র ও নদীর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে না, বরং আমাদের পরিবেশের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ডলফিন শুধুমাত্র পরিবেশগত ভারসাম্য বজায় রাখে না, তারা আমাদের সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যগত জীবনের অংশ। বাংলাদেশের সুন্দরবন ও উপকূলীয় অঞ্চলের জীববৈচিত্র্যের সঙ্গে ডলফিন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমাদের দায়িত্ব শুধু নিজেদের জন্য নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও ডলফিনের এই সুন্দর প্রজাতিকে সংরক্ষণ করা।

ডলফিন আমাদের জীববৈচিত্র্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং তাদের রক্ষা করা আমাদের পরিবেশগত দায়িত্ব। ডলফিন সংরক্ষণে আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন। জনসচেতনতা, সরকারের কঠোর উদ্যোগ, এবং পরিবেশ বান্ধব আচরণের মাধ্যমে আমরা ডলফিনদের রক্ষা করতে পারি। বিশ্ব ডলফিন দিবস উপলক্ষ্যে আসুন আমরা সবাই প্রতিজ্ঞা করি, আমাদের নদী ও সাগরের এই অমূল্য প্রজাতিকে রক্ষা করে আমাদের পরিবেশকে নিরাপদ ও সমৃদ্ধ রাখবো।

লেখক: জনসংযোগ কর্মকর্তা, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়

মনোমুগ্ধকর গোলাপি দোলনচাঁপা

প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:৩৪ এএম
আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:৩৫ এএম
মনোমুগ্ধকর গোলাপি দোলনচাঁপা
মানিকগঞ্জের হরিরামপুরে সুলতানপুর গ্রামে ফোটা গোলাপি দোলনচাঁপা। ছবি: লেখক

বাংলা সাহিত্যের কোথায় না দোলনচাঁপা আছে? জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থের নামটাই ছিল দোলনচাঁপা, আজ থেকে ১০১ বছর আগে সেটি প্রকাশিত হয় কলকাতার আর্য পাবলিশিং হাউস থেকে। শরৎ-হেমন্তের বৃষ্টি আর শিশিরে ভেজা দোলনচাঁপার শুভ্র-স্নিগ্ধ রূপ আর সুগন্ধ প্রকৃতিমনাদের যেমন বিমোহিত করে, তেমনি প্রেমিকদের করে ব্যথিত। কাজী নজরুল ইসলামের অভিশাপ কবিতায় দোলনচাঁপা ফুটে আছে সেই ব্যথার ফুল হয়ে- ‘ফুটবে আবার দোলন চাঁপা চৈতী-রাতের চাঁদনী, আকাশ-ছাওয়া তারায় তারায় বাজবে আমার কাঁদ্নী।’ দোলনচাঁপা ফুলগুলো যেন জ্যোৎস্নাধোয়া বিধবার সাদা শাড়ি পরা কোনো বিরহী প্রেমিকা, যার নিশ্বাসে মেখে আছে বিরহের আতরগন্ধ। ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি দোলনচাঁপা ফুলের সেই সাদা স্বরূপ। হঠাৎ দেখলাম এক বাগানে ফুটেছে গোলাপি রঙের দোলনচাঁপা।

কয়েক দিন আগে মানিকগঞ্জের হরিরামপুরের সুলতানপুর গ্রামে গিয়েছিলাম। সেখানে তরুরসিক তানভীর আহমেদের বাগানে গিয়ে চিরচেনা বিধবা দোলনচাঁপাকে দেখলাম বর্ণিল সাজে। যেন সে হঠাৎ করে কোনো জাদুর ছোঁয়ায় পেয়ে গেছে প্রেমের রং। গোলাপি পাঁপড়িগুলো যেন প্রজাপতির মতো ডানা মেলে উড়তে চাইছে নীল আকাশে। প্রথম দেখাতেই মুগ্ধতা, কেননা বিরল রঙে রাঙানো এই দোলনচাঁপা আমাদের দেশে এসেছে বিদেশ থেকে অতিথি হয়ে। তানভীর বললেন, ২০১৬ সালে তিনি নেটে এই গোলাপি দোলনচাঁপার ছবি দেখে তার খোঁজ শুরু করেন। নানা দেশ ও স্থান থেকে নতুন নতুন গাছপালা সংগ্রহ করা তার নেশা। খুঁজতে খুঁজতে তিনি থাইল্যান্ড থেকে এই গোলাপি রঙের দোলনচাঁপাসহ ১০ জাতের দোলনচাঁপা সংগ্রহ করেন। এর মধ্যে সোনালি হলুদ ফুলের জাতটিও চমৎকার! তার সংগ্রহে ছিল লাল দোলনচাঁপার জাতটিও। দুর্ভাগ্য যে সে গাছটি চুরি হয়ে গেছে। তার পরও তিনি দমে যাননি। তার বাগানে বর্তমানে প্রায় ২০০ প্রজাতির প্রায় সাড়ে ৭০০ গাছ রয়েছে। এর মধ্যে তার সংগ্রহে আছে প্রায় ৪০ জাতের বাহারি কচু ও ৫০ জাতের জলজ ফুলগাছ। তবে এই গোলাপি দোলনচাঁপা তার কাছে অত্যন্ত প্রিয়। যেমন এর রং, তেমনি মিষ্টি সুগন্ধ।

আফসোস যে তানভীর আহমেদের বাগানে গিয়ে যখন সেই দুই ঝাড় গোলাপি দোলনচাঁপা ফুলগাছের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম, তখন তার যৌবন ঢলে গেছে। হেমন্ত শেষে ফুল ফোটাও শেষের পথে। কয়েকটা গোলাপিরঙা দোলনচাঁপা ফুল কেবল সে গাছের সাক্ষ্য হয়ে আছে। শীতে সেসব গাছে আর ফুল ফুটবে না, অনেক ফোটা ফুল শুকিয়ে গেছে, গাছও মরে যাবে। পরের বর্ষায় সেসব গাছ আবার ঝোপালো ও তাগড়া হয়ে বর্ষা থেকে হেমন্ত পর্যন্ত ফুল দেবে।

গোলাপি দোলনচাঁপা গাছ দেখতে অনেকটা আদাগাছের মতো, গাছ দেখতে হুবহু সাদা দোলনচাঁপা গাছের মতোই। এ গাছ প্রায় ৯০ থেকে ১২০ সেন্টিমিটার লম্বা হয়, ঝোপ দেখতে বেশ সুন্দর। এর ফুল বড় আকারের ধবধবে সাদা এবং মিষ্টি সুগন্ধযুক্ত। গাছ যখন বেশ ঝাড়ালো হয়, তখন প্রতিটি গাছ থেকে ডাঁটির মাথায় অনেকগুলো ফুল ফোটে। দোলনচাঁপা প্রধানত বর্ষা ও শরৎকালের ফুল, বিকেলের দিকে ফুল ফোটে এবং সারা রাত বহুদূর থেকেও ফুলের মধুর গন্ধ পাওয়া যায়। শীতকালে মাটির ওপরে গাছ যখন শুকিয়ে যায়, তখন এর কন্দ বা রাইজোম তুলে সংরক্ষণ করা যায় অথবা মাটির নিচেই রেখে দেওয়া যায়। প্রতিবছর নতুন নতুন জায়গায় গাছ রোপণ করা ভালো। দোলনচাঁপা চাষের জন্য বেশি পানির দরকার হয়। তাই রোপণের পর নিয়মিত পানির ব্যবস্থা করতে হয়। এ গাছ আবার অতিরিক্ত পানি বা জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। 

সাধারণত জুলাই থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত ফুল ফোটে, তবে নভেম্বরের শেষ পর্যন্তও এর কিছু ফুল দেখা যায়। দোলনচাঁপার আদি নিবাস ভারতবর্ষ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও মাদাগাস্কার। আদাগোত্রীয় গাছ, গোত্র জিঞ্জিবারেসি। দোলনচাঁপার ইংরেজি নাম বাটারফ্লাই লিলি বা জিঞ্জার লিলি। দোলনচাঁপা হেডিকিয়াম গণের একটি গাছ। সারা পৃথিবীতে হেডিকিয়াম গণের ৭০ থেকে ৮০টি প্রজাতির গাছ আছে, বাংলাদেশে এ গণের আছে ১৫ প্রজাতির গাছ। ধবধবে সাদা ফুলের প্রজাতি হলো Hedychium coronarium, হলুদাভ সাদা রঙের ফুলের প্রজাতি Hedychium flavum, যার নাম রাঙা আদা। এ দেশে লাল বা গোলাপি ফুলের দোলনচাঁপার মতো ফুল লাল বা কমলা রঙের ফুল ফোটে ভুঁই আদাগাছেও, তার প্রজাতি Hedychium coccineum. লাল, কমলা ও গোলাপিরঙা দোলনচাঁপার আদি নিবাস দক্ষিণ চীন।

শোভাময় দুপুরমণি ফুল

প্রকাশ: ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:৫১ এএম
আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:৫২ এএম
শোভাময় দুপুরমণি ফুল
বাসার টবে ফোটা দুপুরমণি। ছবি: লেখক

দুপুরে ফোটে এবং পরের দিন সকালে ঝরে পড়ে দুপুরমণি ফুল। এ জন্যই হয়তো এই ফুলের নাম ‘দুপুরমণি’। এর বৈজ্ঞানিক নাম Pentapetes phoenicea, এটি Malvaceae পরিবারের একবর্ষজীবী গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ। Pentapetes-দের একমাত্র প্রজাতি এটি। এর ইংরেজি নামগুলোর মধ্যে Midday Floower, Scarlet Mallow, Copper Cups, Noon Flower, Scarlet Pentapetes, Scarlet Phoenician ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এর অন্য বাংলা নামগুলো হলো কটলতা, বন্ধুলী, বন্ধুক, দুপুরচণ্ডী, বনদুলি, বন্দুকা, বাধুলিপুষ্প, দুপুর মালতি ইত্যাদি। 

দুপুরমণি ফুল খুব সুন্দর। শ্রীলঙ্কা ও ভারত থেকে উত্তর অস্ট্রেলিয়া ও ফিলিপিন্স পর্যন্ত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দক্ষিণ এশিয়ার বিস্তৃত অঞ্চল উদ্ভিদটির আদি নিবাস। পরে এটি সারা বিশ্বে বিস্তার লাভ করেছে। এটি বর্ষার মৌসুমি ফুল। তবে হেমন্ত পর্যন্ত ফুল ফোটা অব্যাহত থাকে। গাছ লম্বা, খাড়া হয়। ডালপালা থাকে কম। পাতা বেশ লম্বা, মরিচ পাতার মতো। পাতার কিনারা করাতের মতো খাঁজকাটা ও আগা সরু। পাতার কক্ষে ফুল ফোটে। ফুল দুই সেন্টিমিটার চওড়া হয়। ফুলে পাপড়ি পাঁচটি, চ্যাপ্টা। পাপড়ির রং সিঁদুরে লাল, কখনো হালকা গোলাপি বা সাদা হতে পারে। ফুল ২ দশমিক ৩ থেকে ৩ দশমিক ৫ সেন্টিমিটার প্রশস্ত হয়। পাপড়িগুলো নরম আর কোমল। ফুলের কেন্দ্র থেকে কয়েকটি উপাঙ্গ পরাগদণ্ডকে ঘিরে পাপড়ির বাইরে বেরিয়ে থাকে। সেগুলোয় রঙের পরাগরেণু লেগে থাকে। সব মিলিয়ে ফুলটির রূপ যেন আরও বেড়ে যায়। এই ফুলে কোনো গন্ধ নেই, দেখতে জেলি ফিশের মতো। 

এর কাণ্ড অর্ধকাষ্ঠল, উদ্ভিদ শূন্য দশমিক ৫ থেকে এক মিটার পর্যন্ত উচ্চতাবিশিষ্ট হয়। শাখাগুলো লম্বা এবং ছড়ানো। পাতাগুলো ৬ থেকে ১০ সেন্টিমিটার লম্বা হয়। এই উদ্ভিদে পাঁচ প্রকোষ্ঠবিশিষ্ট গোলাকৃতি ফল হয়। ফল গোলাকার, লোমযুক্ত ক্যাপসুল। প্রতিটি প্রকোষ্ঠে ৮-১২টি করে বীজ থাকে। বীজ থেকে খুব সহজেই চারা জন্মে। আগস্ট থেকে নভেম্বর মাসে এতে ফুল ফোটে। এটি টবে ও বাগানের শোভাবর্ধনের জন্য লাগানো হয়। 

তবে অনেক দেশে এই ফুল ভেষজ চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হয়। ভেষজ চিকিৎসায় দুপুরমণি গাছের পাতা, মূল, ফুল ব্যবহার হয়। উদ্ভিদের কাণ্ড, পাতা এবং মূলের নির্যাসের ফাইটোকেমিক্যাল বিশ্লেষণে অ্যালকালয়েড, ফ্ল্যাভোনয়েড, স্যাপোনিন, স্টেরয়েড, ফেনোলিকস, কুমারিন এবং ট্রাইটারপেনয়েড পাওয়া যায়। পাতার নির্যাসে ট্যানিন, ফ্ল্যাভোনয়েড, স্টেরল, স্যাপোনিন, কার্বোহাইড্রেট এবং অ্যালকালয়েডের চিহ্ন পাওয়া যায়। দুপুরমণির মূলে জীবাণুনাশক, কামোদ্দীপক, সংকোচক, পাকস্থলীর বায়ুনাশক, প্রশান্তিদায়ক, বিষমুক্তকারী, রেচক ও বিশোধক, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ও ডায়াবেটিসরোধী গুণাগুণ রয়েছে। 

লেখক: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ, মুমিনুন্নিসা সরকারি মহিলা কলেজ, ময়মনসিংহ

ভরত পাখির সুরেলা গান

প্রকাশ: ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৩৬ এএম
ভরত পাখির সুরেলা গান
বাংলা ঝাড়ভরত, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠ থেকে তোলা। ছবি: লেখক

‘ভোরের বেলায় তুমি আমি
নীল আকাশের ভরত পাখির গানে
কবে যে এই ধুলোমাটির পৃথিবীতে
প্রথম দেখেছিলাম’

-    জীবনানন্দ দাশ

বসন্তের দুপুর, খোলা মাঠে বসন্তের হাওয়া বইছে। আকাশে ঝলমলে রোদ। এমন সময় মাঠের ওপর ছোট্ট এক পাখি ডানা ঝাপ্টাচ্ছে অনবরত, সেই সঙ্গে গাইছে সুরেলা কণ্ঠে। এমন গানের সুর আকুল করে তোলে মানুষের মন। বসন্তের বাতাসে তার মিষ্টি ও সুরেলা গানের সুরের মূর্ছনা ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। পাখিটি অনবরত ডেকে যাচ্ছে কয়েক মিনিট ধরে। একসময় গাইতে গাইতে সে ঘাসের মাঠে নেমে গেল। নামার গতির সঙ্গে সঙ্গে গানের সুরও নরম হতে থাকে। গানের শেষ পর্যায়ে প্যারাস্যুটের মতো ডানা মেলে ধরে ভূমিতে ল্যান্ড করে পাখিটি। ভূমিতে নামার পর হেঁটে হেঁটে ঘাসের মধ্যে পোকা খোঁজে। ঘাসের মাঠে ভরত পাখিটি হাঁটতে পারে। তবে বিপদ বুঝলে থেমে গিয়ে অনড় হয়ে বসে থাকে। বাংলার মেঠো ফসলের মাঠে, ঘাসের মাঠে হেঁটে বেড়ানো এ পাখিটির পোশাকী নাম ‘বাংলা ঝাড়ভরত’। তবে এরা গ্রাম-বাংলায় ভরত পাখি নামেই সর্বাধিক পরিচিত। পাখিটি তার গায়কীর জন্য বিখ্যাত। কবিরাও করেছেন ভরত পাখির জয়গান। 

ছেলেবেলায় ভরত পাখির বাসা খুঁজেছি। কিন্তু কখনোই খোঁজ পাইনি তাদের বাসার। বিশাল ঘাসের মাঠে বাসা খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তা ছাড়া ভরত পাখি বাসার কাছাকাছি পৌঁছে গেলেও হয়তো আমাদের দিকভ্রান্ত করে অন্যদিকে নিয়ে যেত আকাশে ডেকে ডেকে। কিছুটা হট্টিটি পাখির মতো কৌশলে। ছোট্ট এ পাখির দৈর্ঘ্য মাত্র ১৪ সেন্টিমিটার এবং ওজন ২৯ গ্রাম। পেট ও ডানার পালক লাল। বুকে কালচে তিলা থাকে এবং চোখের রং বাদামি। ভরত ছোট আকারের ভূচর গায়ক পাখি। বাংলাদেশে সাত প্রজাতির ভরত পাখি আছে, তার মধ্যে ‘বাংলা ঝাড়ভরত’ ও ‘বালি ভরত’ আমাদের আবাসিক পাখি। 

বাংলা ঝাড়ভরত পোকা শিকারি পাখি। প্রধানত আবাদি ভূমি, মুক্ত তৃণভূমি ও পতিত জমিতে বিচরণ করে। সচরাচর একা কিংবা জোড়া বেঁধে চলে এই পাখি। দেশের সব বিভাগের প্রত্যন্ত এলাকায় পাখিটি দেখা যায়। সিলেট ও সুনামগঞ্জের হাওরে শুষ্ক মৌসুমে গেলে চারদিকে এ পাখির গান শোনা যায়। বাংলা ঝাড়ভরতের ইংরেজি নাম ‘বেঙ্গল বুশলার্ক’। এই সুরেলাকণ্ঠী পাখিটি ভারতীয় উপমহাদেশ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ভুটান, মায়ানমার ও নেপালে দেখা যায়।

লেখক: নিসর্গী ও পরিবেশবিদ, জার্মান অ্যারোস্পেস সেন্টার

গাঁয়ের পথে তেউড়ি লতা

প্রকাশ: ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১০:০৫ এএম
গাঁয়ের পথে তেউড়ি লতা
মানিকগঞ্জের হরিরামপুরে ফোটা তেউড়ি ফুল। ছবি: লেখক

হেমন্ত ফুরিয়ে আসছে, মাঠগুলোও ধানশূন্য হয়ে পড়েছে। এ রকম শূন্যতার মাঝেও পূর্ণতার খোঁজে ঢাকা থেকে মানিকগঞ্জে চলেছি প্রকৃতি দর্শনে। বাংলাদেশ নেচার কনজারভেশন কাউন্সিলের একদল প্রকৃতিপ্রেমিক, আমরা চলেছি হরিরামপুর থেকে ঘিওরে। পথে ভাটুরা গ্রামের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আব্দুর রহিম ভাই হঠাৎ গাড়ি থামাতে বললেন। কারণ কী? বললেন, কী একটা গাছ দেখলাম, মনে হলো তেউড়ি। নেমে ভালো করে দেখতে হবে। সে গাছের ঝোপ পেরিয়ে গাড়ি কিছুটা সামনে গিয়ে দাঁড়াল। রাস্তার ঢালে নানা রকমের ঝোপঝাড়, এরপর দিগন্তবিস্তৃত ধানখেত, শূন্য মাঠ। ঝোপঝাড়ে কয়েকটা ডুমুরগাছকে চেপে ধরেছে সে গাছের লতাপাতা।

আশ্রয়দাতা গাছগুলো কী তা ভালো করে না দেখলে বোঝা যাচ্ছে না। সাদা দুধরঙা ফুল ফুটে রয়েছে বেশ কয়েকটা। দূর থেকে ভেবেছিলাম তেলাকুচা ফুল। কাছে গিয়ে রহিম ভাই নিশ্চিত হয়ে জানালেন, এটাই সেই গাছ, যেটা আমরা দেখব বলে ভেবে রেখেছিলাম, এটাই সেই তেউড়িগাছ। এ পথে বেশ কয়েকবার যাওয়ার সময় এ গাছ দেখছি, আরও একটা গাছ চোখে পড়ে, তার নাম মুন ফ্লাওয়ার। তার ফোটা ফুল দেখতে হলে আসতে হবে রাতের বেলায় বা খুব ভোরে। তেউড়িগাছের ফুলগুলো দেখে কলমি বলে মনে হলো, আবার কখনো মনে হলো মর্নিং গ্লোরি। 

রহিম ভাই পাশের বাড়ি থেকে একটা লম্বা কুটা এনে ফুলসমেত লতা টেনে নামিয়ে বললেন, এ গাছকে সঠিকভাবে শনাক্তকরণের চাবিকাঠি হলো এর লতা। কলমির লতা নলাকার ও বেলুনাকার, ফাঁপা। আর তেউড়ি মূলের লতা তিনটি শিরবিশিষ্ট, মোচড় খাওয়া। সাদা কলমির মতোই ফুল, তাই এর আরেক নাম দুধকলমি। পাতা দেখতে অনেকটা পানপাতার মতো, বোঁটার কাছে হৃৎপিণ্ডের মতো খাঁজকাটা, অগ্রভাগ ক্রমশ সরু হয়ে সুচালো। কলমির চেয়ে এর পাতা বড়। ফলগুলো দেখতে অনেকটা গম্বুজের মতো, পেট ফোলা, মাথা চোখা, গোলাপি-বাদামি রং।

গাছ-দর্শন শেষে ঢাকায় ফিরে এসে বইপত্র নিয়ে বসলাম ওর তেউড়ি নামের রহস্য খুঁজতে। বাংলাদেশে উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষের সপ্তম খণ্ডে গাছটির বর্ণনা পেলাম তার প্রজাতিগত নামের সূত্র ধরে। তবে সেখানে কোথাও এর নাম তেউড়ি বলে উল্লেখ করা হয়নি, স্থানীয় নাম হিসেবে এর নাম লেখা হয়েছে দুধকলমি। দুধের মতো সাদা ফুলের রং, তাই এরূপ নাম। লতা ও পাতার বোঁটা ভাঙলেও সেখান থেকে সাদা দুধের মতো আঠালো পাতলা কষ বের হয়। অন্য আরও বইপত্র ও অন্তর্জাল ঘেঁটে কোথাও এর তেউড়ি নামটা পেলাম না। শেষে আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্যের চিরঞ্জীব বনৌষধি বইয়ের পঞ্চম খণ্ডে পেলাম এই তেউড়ি নাম, যার প্রজাতিগত নাম Operculina turpethum ও গোত্র কনভলভুলেসি। তার মানে গাছটা কলমি গোত্রীয়। তেউড়ি নামটা ওর আয়ুর্বেদিক নাম, সংস্কৃত নাম ত্রিবুৎ থেকে এর নাম হয়েছে তেউড়ি। 

প্রাচীনকালে চিকিৎসক বা কবিরাজরে বলা হতো বৈদ্য। বৈদ্য হলো সে, যার মধ্যে বেরে তথা অথর্ববেদের জ্ঞান থাকে। সেই বেদে তেউড়িকে সম্বোধন করে লেখা হয়েছে ‘তুমি ত্রিবৃৎ, অর্থাৎ ত্রি স্বভাবে বর্তমান ঔষধি। তেজ, জল ও অন্নের প্রকৃতি বিকারে আক্রমণ হলে তুমি তেজ প্রকাশ করে আক্রমণ করো জলের স্বভাবের মতো, সংক্রমিত হয়ে আবার সংশমন করো ক্ষুৎ পিপাসা সংশমনে।’ তিন মহাগুণের অথর্ববেরে তেজী ত্রিবৃৎ বাংলাদেশে এসে নাম ধারণ করেছে তেউড়ি, যার অভিজাত নাম দুধকলমি। হিন্দু ধর্মে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবকে বলা হয় ত্রিদেব। তারা একটি ত্রিকোণ মুদ্রা উদ্ভাবন করেছিলেন, যা সৃষ্টি করেছিল অনেক সমস্যার, সেই পৌরাণিক কাল থেকে দেবতা ও অসুরদের যুদ্ধ, রামের সঙ্গে রাবণের যুদ্ধ, পাণ্ডবদের সঙ্গে কৌরবদের যুদ্ধ। ভাবি, তেউড়ির বীজটাও তো ত্রিকোণ। এই বীজ আবার কোন সমস্যা তৈরি করে তা কে জানে?

তেউড়ি ভূমিতে ও অন্য গাছের ওপর লতিয়ে চলা লতা। এ লতার কাণ্ড তিন থেকে পাঁচটি শিরবিশিষ্ট। লতায় কোনো পশম নেই, শাখা আছে। ফুল দেখতে অনেকটা মাইকের চোঙের মতো, পাঁপড়ি পাঁচটি যুক্ত ও সাদা। ফুল ফোটে অক্টোবর থেকে মে মাস পর্যন্ত। ফল ক্যাপসিউল প্রকৃতির, চাপা গোলাকার, মসৃণ। বীজ ত্রিকোণাকার বা গোলাকার, কালচে। রহিম ভাই বললেন, তেউড়ি এক দারুণ ভেষজগুণের প্রাচীন ঔষধি গাছ। অম্লপিত্ত, জন্ডিজ, আমবাত, কোষ্ঠকাঠিন্য, খোসপাঁচড়া, এমনকি মনোরোগের চিকিৎসাতেও তেউড়ির মূল ব্যবহার করা হয়। এ দেশে ঘন ঝোপ ও রাস্তার ধারে এ গাছ চোখে পড়ে।

চা-বাগান লেকে শাপলার মুগ্ধতা

প্রকাশ: ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:৫৭ এএম
আপডেট: ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৫৮ এএম
চা-বাগান লেকে শাপলার মুগ্ধতা
হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার দেওন্দি চা-বাগানে লেকটি স্থানীয়ভাবে ‘লাল শাপলা বিল’ নামে পরিচিত। ছবি: খবরের কাগজ

কুয়াশায় মোড়া সবুজ চা-বাগানের মাঝে এক মনোমুগ্ধকর লেক। এর বুকে ফুটে থাকা লাল শাপলার অপূর্ব সৌন্দর্য। এ যেন প্রকৃতির নিজস্ব ক্যানভাসে আঁকা এক শিল্পকর্ম। লেকের পানিতে সাদা বকের ডানার ঝাপট আর হাঁসের দল যোগ করেছে রাজসিক আভিজাত্য। এমন মনোমুগ্ধকর পরিবেশ যেকোনো প্রকৃতিপ্রেমীর হৃদয় ছুঁয়ে যাবে

হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার দেওন্দি চা-বাগানে অবস্থিত এই লেকটি স্থানীয়ভাবে ‘লাল শাপলা বিল’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। ভোরের আলো ফুটতেই লেকের সৌন্দর্য উপভোগে ভিড় জমাচ্ছেন প্রকৃতিপ্রেমীরা। তরুণ-তরুণী, শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে নানা বয়সের মানুষের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠেছে লেকের চারপাশ। পরিবার-পরিজনের সঙ্গে প্রকৃতির এই মোহনীয় রূপ উপভোগে সবাই মুগ্ধ।

সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান ও রঘুনন্দন গভীর অরণ্যের কাছাকাছি হওয়ায় লেকটি সহজেই পর্যটকদের নজর কাড়ে। গত বছর এই লেকের খবর প্রথমবারের মতো প্রকাশ্যে আসে। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে লেকের সৌন্দর্যের খবর ছড়িয়ে পড়ায় এবার ভ্রমণপিপাসুদের আগমন বেড়েছে অনেক। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হাজার হাজার পর্যটক এই লেকে ভিড় করছেন।

মাধবপুর থেকে পরিবার নিয়ে লেকে ঘুরতে আসছেন আব্দুল মতিন। তিনি বলেন, ‘চা-বাগানের মধ্যে লেক থাকলে এমনিতেই এর সৌন্দর্য অনেক বেশি থাকে। তার মধ্যে লাল শাপলা থাকায় এখানখান পরিবেশ যেমন স্বর্গের মতো। কিছুদিন ধরেই ফেসবুকে এটিকে দেখছি। তাই আজ পরিবারের সবাইকে নিয়ে এলাম।’
বাহুবলের শাবানা আক্তার বলেন, ‘অনেক শাপলা বিল দেখেছি। কিন্তু এর সৌন্দর্য অন্যগুলোর চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। কারণ এর চারপাশে সবুজ চা-বাগান। দিনের চেয়ে সকালে এর সৌন্দর্য বেশি থাকে। কারণ তখন চা-বাগানের চারপাশে কুয়াশা থাকে।’

হবিগঞ্জ সদর উপজেলা থেকে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে যাওয়া নার্গিস আক্তার বলেন, ‘কুয়াশায় ঢাকা চা-বাগান দেখতে দেখতে আঁকাবাঁকা পথ ধরে এখানে এলাম। এখানে আসার পর আমি মুগ্ধ হয়ে গেছি। কী নেই এখানে? চা-বাগান, লাল শাপলা, সাদা বক, হাঁসের পালের ছুটাছুটি। এক কথায় অসাধারণ!’

এদিকে পর্যটকদের এমন ভিড়ের মাঝে লেকের পরিবেশ রক্ষায় কিছু সমস্যাও দেখা দিচ্ছে। অনেকেই শাপলা ফুল ছিঁড়ে নিয়ে যাচ্ছেন, পাশাপাশি প্লাস্টিকের বোতল ও খাদ্যপণ্যের মোড়ক ফেলে লেকের পরিবেশ দূষিত করছেন। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন প্রকৃতিপ্রেমীরা। শায়েস্তাগঞ্জ জহুরচাঁন বিবি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘বাড়ির পাশে এমন সুন্দর লেক। তাই দেখতে এলাম। তবে একটা জিনিস খুব খারাপ লাগল। অনেকেই যাওয়ার সময় ফুল ছিঁড়ে নিয়ে যাচ্ছেন। এ ছাড়া যাতায়াতব্যবস্থা ভালো নয়, নিরাপত্তাও কম। প্রশাসনের উচিত এটিকে পর্যটনবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলা।’

স্থানীয় প্রশাসন লেকটিকে পর্যটনবান্ধব করে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিচ্ছে বলে জানিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আয়েশা আক্তার। তিনি বলেন, ‘লেকের পরিবেশ রক্ষা ও পর্যটকদের নিরাপত্তা জোরদারে আমরা কাজ করছি। এরই মধ্যে সেখানে গ্রামপুলিশ নিযুক্ত করা হয়েছে। বাগান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা হয়েছে। তাদের সঙ্গে মিলে পরিবেশ স্বাভাবিক রাখতে কাজ শুরু হবে।’

লাল শাপলা প্রতীক হতে পারে ভালোবাসা, পবিত্রতা ও নির্মলতার। এটি একদিকে প্রকৃতির প্রতি মানুষের মুগ্ধতা বাড়াচ্ছে, অন্যদিকে পর্যটন খাতকে সমৃদ্ধ করছে।