শরৎ এলেই মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের গান- ‘শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি/ ছড়িয়ে গেল ছাপিয়ে মোহন অঙ্গুলি/ শরৎ তোমার শিশির-ধোওয়া কুন্তলে,/ বনের-পথে-লুটিয়ে-পড়া অঞ্চলে/ আজ প্রভাতের হৃদয় ওঠে চঞ্চলি/’ ঢাকা শহরে সেই বন আর শিশিরার্দ্র স্নিগ্ধ সবুজ ঘাস কোথায়? বনপথে তাই শরতের বন্দনা কেবলই লেখায় লেখায় রয়ে যায়। তবু তার খানিকটা রূপসুধা যেন খুঁজে পেলাম অনেক দিন পর এক শরৎ প্রভাতে বলধা উদ্যানে গিয়ে। বলধা উদ্যানের সাইকি অংশে একটি বড় গাছকে ছড়িয়ে-ছাপিয়ে উঠে গেছে একটি লতানো গাছ, পারলে সে গাছ যেন আকাশে উঠে পড়ে।
গাছটি হচ্ছে কনকসুধা। সাইকির ভেতরে বাগানপথের ওপরেও খিলান করে একটি কনকসুধা গাছ সেখানে তুলে দেওয়া আছে, সেটাতে ফুল ফুটেছে। লতায় লতায় ছেয়ে গেছে সেই আশ্রয়দাতা গাছটি। লতানো সে গাছের লতায় লতায় রচিত হয়েছে যেন শারদসংগীত। অসংখ্য ঘণ্টাকৃতির ফুল ফুটে আছে, ভোরের নরম আলোয় যেন হীরে-মানিক জ্বলছে, ফুলের পাপড়িতে মেখে আছে শিশিরের হীরককুচি। গাছের তলায় বাতাসে ভেসে ভেসে ছড়িয়ে পড়ছে ঝরা ফুলগুলো। একটা ফুল কুড়িয়ে শারদ-প্রভাতে তার রূপসুধা পান করে নিলাম আকণ্ঠ। কনকসুধা ফুলের রূপের সুধায় যেন দেখতে পেলাম সোনার ঝিলিক ‘মানিক-গাথা ওই যে তোমার কঙ্কনে/ ঝিলিক লাগায় তোমার শ্যামল অঙ্গনে।’
সোনার আর এক নাম কনক। ফুলের পাপড়ির মধ্যে ছড়িয়ে রয়েছে সেই নরম সোনালি-হলদে আভা, মাঝখানটায় মধুর মতো কমলাটে রঙ যেন চুইয়ে পড়ছে। এ জন্যই কি বলধা গার্ডেনের প্রতিষ্ঠাতা জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী এ ফুলটার বাংলা নাম রেখেছিলেন কনকসুধা?
এ দেশে কনকসুধার আগমন নিয়ে রয়েছে এক মজার ইতিহাস। বিশ শতকের গোড়ার দিকে গাজীপুরের বলধা এস্টেটের জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী ঢাকার ওয়ারীতে এই মনোরম উদ্যান গড়ে তোলেন। প্রকৃতিপ্রেমী নরেন্দ্র নারায়ণের ছিল গাছপালার শখ, বিশ্বের বহু দেশ থেকে তিনি অনেক বিদেশি গাছ এনে বলধা বাগানে লাগিয়েছিলেন। ধারণা করা হয়, তিনি বিশ্বের অন্তত পঞ্চাশটি দেশ থেকে দুই শরও বেশি প্রজাতির গাছ এনে লাগিয়েছিলেন সেখানে। জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী কনকসুধা গাছটি সংগ্রহ করেছিলেন শ্রীলঙ্কা থেকে। সংগ্রহ করার পর এক জাহাজে তুলে দেন। কিন্তু সেটি ছিল ভুল জাহাজ, ওই জাহাজ চলে যায় অস্ট্রেলিয়ায়। এ নিয়ে জমিদারের মন খুব খারাপ হয়ে যায়। বহুদিন পর সেই জাহাজ এসে ভিড়ে এ দেশে। তিনিও সেই গাছটি পেয়ে আশ্বস্ত হন, লাগান বলধা বাগানে। সে বাগানেই ঠাঁই হয় কনকসুধার। বছরের পর বছর ধরে শরৎ-হেমন্তে সে গাছ কনকসুধা ফুল ফুটিয়ে চলেছে। প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে সে বিলিয়ে চলেছে তার রূপের সুধা।
কনকসুধা এক লতানে ফুলের শোভাময়ী গাছ। কনকসুধার ইংরেজি নাম Brayilian Edelweiss বা Bluebird Vine এবং উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Odontodenia macrantha ও গোত্র অ্যাপোসাইনেসি (Apocynaceae)। এ গাছের লতা অনেক লম্বা হয়, কোনো কোনো লতা ৬ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়, লতা নলাকার ও কাষ্ঠল। পাতা মসৃণ, ডিম্বাকার থেকে উপবৃত্তাকার, ৭ থেকে ২২ সেন্টিমিটার লম্বা ও ৪ থেকে ৮ সেন্টিমিটার চওড়া, পত্রফলক সবুজ, পাতার হালকা সবুজ শিরাগুলো স্পষ্ট, বোঁটা প্রায় ২ সেন্টিমিটার লম্বা, পাতা ও লতা ছিঁড়লে দুধের মতো কষ ঝরে। লতার দুপাশে বিপরীতমুখীভাবে পাতাগুলো সাজানো থাকে। ফুল ঘণ্টাকৃতির। দেখতে অলকানন্দা ফুলের মতো মনে হলেও ভালো করে লক্ষ্য করলেই এ দুটি ফুলের পার্থক্য ধরা পড়ে। অলকানন্দা বা অ্যালামন্ডা ফুলের রং প্রধানত হলুদ, আর কনকসুধা ফুলের পাপড়ির রং কমলা আভায় ঘিয়ে-হলদে, অলকানন্দা ফুলের পাপড়ির কিনারা মসৃণ আর কনকসুধা ফুলের পাপড়ির কিনারা কিছুটা ঢেউ খেলানো। পাঁচটি পাপড়ি ঘড়ির কাঁটা যে দিকে ঘোরে সে দিকে আবর্তিত। ফুলে হালকা মিষ্টি গন্ধ রয়েছে। ফল ও বীজ হয়, বীজ মসৃণ ও পালকযুক্ত। তবে গুটিকলমের দ্বারাই সাধারণত এর চারা তৈরি করা হয়। রোদেলা জায়গায় গাছ ও ফুল ভালো হয়। গাছ দ্রুতবর্ধনশীল চিরসবুজ লতানো প্রকৃতির বিরুৎ বা লতানে গুল্ম।
কনকসুধার আদি নিবাস মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা। মধ্য আমেরিকার উত্তরের গুয়াতেমালা থেকে দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিল পর্যন্ত এ ফুলের দেখা মেলে। তবে বাংলাদেশে কনকসুধা গাছ খুব একটা দেখা যায় না। এ দেশে জানা মতে, কনকসুধা গাছ আছে বলধা উদ্যান, জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান ও ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ উদ্যানে। এত সুন্দর ফুলের গাছটি কেন আরও অনেক বাগানে ছড়াল না, সেটিই অবাক লাগে।