গ্রীষ্মের দুপুর। জার্মানির ছোট্ট শহর গড়লিজে পাখি দেখতে বের হয়েছি। গড়লিজ শহরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ছোট্ট নদী। নদীটির নাম নিজে। নদীর ওপারে পোল্যান্ডের শহর গর্জালেগ। এক প্রজাতির পাখি দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি অনেক বছর। সে এক প্রজাতির শালিক। আমাদের দেশে পরিযায়ী হয়। চট্টগ্রাম শহরসংলগ্ন ফইল্লাতলী জাহাজঘাট এলাকায় দেখা গিয়েছিল। ঢাকা থেকে সেখানে তাদের দেখতে গিয়েছিলাম ২০১৫ সালে। কিন্তু অনেক খোঁজাখুঁজি করেও দেখা মেলেনি তাদের। অবশেষে দেখা পেয়েছি জার্মানির নিজে নদীর তীরে। ওক গাছ থেকে উড়ে এসে ঘাসের মধ্যে খাবার খুঁজছিল। ডিম গড়নের পাখি। পালকে চিত্র-বিচিত্র দাগ। রোদের আলো পড়লে রঙগুলো দারুণ উজ্জ্বল হয়। সবুজ ও বেগুনি আভা ফুটে ওঠে। শীতকালে ঝাঁকে ঝাঁকে পাতি কাঠশালিক অপেক্ষাকৃত উষ্ণ এলাকায় চলে যায়। একটি ঝাঁকে ১০ হাজারের বেশি পাতি কাঠশালিক থাকতে পারে। বসন্তে ওরা গাছের অথবা পাকা বাড়ির ফোকরে বাসা করে। ছানারা বাসা ছাড়লে তাদের নিয়ে শহরের পার্কে অথবা খোলা জায়গাতে ঘুরে বেড়ায়।
পাতি কাঠশালিক ইউরোপের পত্রঝরা বনে, শহর ও গ্রামে বসবাস করে। ঝাঁক বেঁধে খাবারের সন্ধান করে। বিপদসংকেত পেলে পুরো ঝাঁক অন্যত্র উড়ে যায়। দলবদ্ধ হয়ে নিজেরা কখনো অন্য প্রজাতির পাখিদের সঙ্গে রাত্রিযাপন করে। চাষাবাদের জমি, তৃণভূমি, তুঁতগাছ এলাকায় বিচরণ করে ও কীটপতঙ্গময় মাঠে ঘুরে বেড়ায়। কণ্ঠ মোটামুটি সুরেলা। শন শন ও ঘ্যাঁস ঘ্যাঁস করে শিস দেয়। অন্য পাখির ডাক অনুকরণ করতে পারে। মাকড়সা, কেঁচো, উচ্ছিষ্ট, ফল, শস্যবীজ, ফুলের মধু, পোকামাকড় খায়। ভূমিতে ও ঘাসের মাঠে খাবার খেতে নামে। শীত মৌসুমে পাতি কাঠশালিক আমাদের দেশে আসে কখনো কখনো। ভারত, নেপাল, পাকিস্তানে শীত মৌসুমে পাতি কাঠশালিক দেখা যায়।
পাতি কাঠশালিকের পালক বৈচিত্র্যময় রঙে সাজানো। দেহ লম্বায় ২১ সেন্টিমিটার। পালক তেলতেলা কালো, তাতে সাদাটে ছিট। ডানা, লেজ ও চোখ পাটকিলে। নিচের ঠোঁট হলদেটে। মাথা, গলা ও কান পাটকিলে। গায়ের কয়েক জায়গায় বেগুনি-সবুজ পালক আছে। ছেলে ও মেয়ে পাখি দেখতে একই রকম। শরৎকালে দেহে নতুন করে পালক এলে এরা দেখতে উজ্জ্বল কালো রঙের। তখন বেগুনি রক্তিম সবুজাভ পালক এবং তাতে সাদা ছিট ছিট থাকে। তখন ঠোঁট কালচে ও পা বাদামি থাকে। ধীরে ধীরে ঠোঁট ও পা হলুদ বর্ণ ধরলে দেহের সাদা রঙের ছিট ছিট ফোঁটা চিহ্নগুলো হারিয়ে যায়।
শীতের প্রজনন সময়ে বড় ঝাঁক থেকে শালিকরা আলাদা হয়ে যায়। জোড়া ও ছোট দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। প্রজননে অঞ্চলভেদে তারতম্য ঘটে। ঘরের চালের ফাঁক, সিলিং, কাঠঠোকরার ফোকরে পরিপাটিহীনভাবে পাতা, খড়, শুকনো ঘাস দিয়ে বাসা বানায়। ডিম পাড়ে ৫-৬টি। ডিমের রং নীল। ১০ থেকে ১২ দিন দুজন পাখি পালা করে ডিমে তা দেয়।
নিসর্গী ও পরিবেশবিদ, জার্মান অ্যারোস্পেস সেন্টার