ময়মনসিংহ জেলার তারাকান্দা উপজেলার কোদালধর বাসস্ট্যান্ডের পূর্ব পাশে কয়েক দিন আগে একটি কানাইডিঙ্গাগাছের দেখা পেলাম। গাছের কাণ্ড বা শাখার গা থেকে উৎপন্ন লম্বা মঞ্জরিদণ্ডের শীর্ষে মাঝে মাঝে ঝুলছে তলোয়ারের মতো ফল।
কানাইডিঙ্গা ছোট থেকে মাঝারি আকৃতির পাতাঝরা বৃক্ষ। এই উদ্ভিদের বৈজ্ঞানিক নাম Oroxylum indicum, এটি Bignoniaceae পরিবারের সদস্য। কানাইডিঙ্গার অন্যান্য বাংলা নাম শোনা, প্রিয়জীব, পীতপাদপ ইত্যাদি। শোনাক ও শুকনাশ এদের সংস্কৃত নাম। মগদের কাছে খামা এবং চাকমাদের কাছে বাইলা নামে পরিচিত। ইংরেজিতে Midnight horror tree, Indian trumpet flower নামে পরিচিত। উদ্ভিদ ২০ থেকে ৩০ ফুট উঁচু হতে পারে। তলোয়ারের মতো লম্বা ফলের জন্য ছোটবেলা থেকেই এর প্রতি আমার আকর্ষণ।
এই বুনো গাছ বিক্ষিপ্তভাবে সারা দেশেই স্বল্প পরিমাণে দেখা যায়। বৃহত্তর সিলেট, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রামে এর উপস্থিতি বেশি। ফোটা ফুল খুব সকালে দিনের আলো বের হওয়ার আগে ঝরে পড়ে, তাই গাছতলাতেই এদের দেখা মেলে। ইউরোপ কিংবা আমেরিকার ভৌতিক গল্পে রক্তচোষা বাদুড় ভ্যাম্পায়াররা মানুষের রক্ত খায় আর রক্তের সন্ধানে ঘুরে বেড়ায়। কানাইডিঙ্গার ফুলে ফুলে ঘুরে বেড়ায় নিরীহ বাদুড়রা। এর ফলে পরাগায়নের কাজটিও হয় রাতের পাখি বাদুড়ের মাধ্যমে। একটু খেয়াল করলেই ঝরেপড়া ফুলে বাদুড়ের নখের আঁচড় দেখা যায়। এসব কারণে ইংরেজি নাম ‘মিডনাইট হরর ট্রি’, যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় ‘মধ্যরাতের ভৌতিক গাছ’।
দুটি লম্বা ফালির মধ্যে এই বীজগুলো সাজানো থাকে। বীজগুলো কাগজের মতো পাতলা। হালকা বাতাসের দোলায় দূর-দূরান্তে উড়ে গিয়ে সর্বত্র বংশবিস্তার করে। ফল শুকিয়ে গেলে ফালি দুটি আলাদা হয়ে ক্ষুদ্রকায় ডিঙির আকার ধারণ করে। দুই মাথা চৌকা ও মাঝখানে প্রশস্ত হওয়ার কারণে এটির সঙ্গে ডিঙি নৌকার চেহারার খাপ খায়। তাই এটিকে কানাইডিঙ্গা বলা হয়। ফুলটি মোটেও সুগন্ধি নয়, বরং দুর্গন্ধযুক্ত। প্রস্ফুটনকাল দীর্ঘ, বর্ষার শেষভাগ থেকে প্রায় হেমন্ত অবধি। লম্বাটে মঞ্জরিদণ্ডের আগায় আঙুলের ডগার মতো অসংখ্য কলি সামান্য ঝুলে থাকে। দিনের আলোয় ফুল ফোটার কোনো প্রস্তুতিই চোখে পড়ে না, রাতের অন্ধকারে খুব তাড়াতাড়ি তা শেষ হয়। গুচ্ছবদ্ধ ফুল বেশ বড়, ঈষৎ হলুদ-বেগুনি রঙের, পাঁচটি পাপড়িই গভীরভাবে মোড়ানো, পরাগকেশর স্পষ্ট।
কানাইডিঙ্গা ঢাকায় কিছুটা দুষ্প্রাপ্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার প্রাঙ্গণ, কার্জন হলের উদ্যান এবং মিরপুরে অবস্থিত জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে কানাইডিঙ্গা দেখতে পাওয়া যায়। বগুড়ার মহাস্থানগড়ে পাশাপাশি দুটি কানাইডিঙ্গাগাছ দেখেছিলাম কয়েক বছর আগে।
কানাইডিঙ্গার তলোয়ার বা ডিঙির মতো লম্বা ফল পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের একটি অত্যন্ত প্রিয় সবজি। মৌসুমে পার্বত্য জেলাগুলোর বাজারে এটি সবজি হিসেবে পাওয়া যায়। স্বাদ তেঁতো এবং পিচ্ছিল। কিছুটা ‘করলা’ এবং ‘কচুর লতি’র মিশ্রণে যে স্বাদ হয়, তার কাছাকাছি। তবে বেশি খাওয়া যাবে না, কারণ এটি রেচক।
কানাইডিঙ্গা আমাদের কাছে সাধারণ বুনো ফুল হলেও গাছটি ঔষধিগুণে ভরা। এই গাছের ছাল, মূলের ছাল, ফল ও পাতা জন্ডিস, শরীর ব্যথা, অণ্ডকোষের সমস্যায় ওষুধ হিসেবে কাজে লাগে। জন্ডিসে ছাল বেটে গুড়ের সঙ্গে মিশিয়ে শরবত করে খেলে উপকার পাওয়া যায়। শরীরে সাধারণ ব্যথায় শিকড়ের রস স্বল্পমাত্রায় সেবন করলে সেরে যায়। কুকুরের কামড়ে গাছের ছাল গোলমরিচসহ পিষে বড়ি বানিয়ে দিনে তিনটি খেলে এবং বাইরে প্রলেপ দিলে ভালো হয়। অজীর্ণ, ডায়রিয়া, আমাশয়, কোষ্ঠকাঠিন্য, ব্যথা, বাতজ্বর, বাত, রসবাত ও কর্ণশূল রোগ নিরাময়ে কানাইডিঙ্গার ব্যবহার রয়েছে।
লেখক: অধ্যাপক, উদ্ভিদবিজ্ঞান ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক