উঁচু নিচু পাহাড়ি পথ দিয়ে দ্রুত বেগে ছুটে চলেছে গাড়ি। আমাদের গন্তব্য পেনসিলভানিয়ার পিটসবার্গ শহর থেকে ১১৩ কিলোমিটার দূরের ওহিওপাইল স্টেট পার্ক। অরণ্যময় সে পার্কটির মধ্য দিয়ে বয়ে চলেছে ইংঘিওঘেনি নদী ও সে নদীর জলপ্রপ্রাত। শুনেছি সেখানে সেটি বাদেও রয়েছে আরও পাঁচটি ঝরনা। সকালের মিঠে রোদে চারদিক ঝকঝক করছে। মসৃণ রাস্তার দুপাশের বনগুলোর ঝাঁকড়া মাথার গাছে গাছে যেন ছড়িয়ে পড়েছে মুঠো মুঠো অরুণ আলোর অঞ্জলি। চকচকে সবুজ, হলুদ, কমলা, লাল মিশেলে চলছে গাছে গাছে পত্রপল্লবের রং বদলের খেলা।
সে পার্কে পৌঁছে নদীর ওপরের সেতুটা পার হতেই চোখ জুড়িয়ে গেল। আহ্ কী সুন্দর দৃশ্য! নদীটার জল গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে প্রায় ২০ ফুট নিচে, বিশাল বিশাল পাথরের চাঁইয়ের ওপর দিয়ে প্রচণ্ড বেগে ধাবমান শুভ্রনীল জলধারা যেন স্বর্গীয় সুন্দরের সুধা! সেটিকে বাঁয়ে রেখে রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে আমরা হাজির হলাম একটা ভিউ পয়েন্টে। চোখ ভরে সে জলপ্রপাতের স্বর্গসুধা পান করছি। রবীন্দ্রনাথের কথায় বলতে ইচ্ছে করছে, ‘অমলধারা ঝরনা যেমন স্বচ্ছ তোমার প্রাণ, পথে তোমার জাগিয়ে তুলুক আনন্দময় গান।’ হঠাৎ সে ভিউ পয়েন্টের পাশে ঝোপের মধ্যে চোখ পড়তেই একটা অদ্ভুত ফুলের ছড়াছড়ি চোখে পড়ল। ফুলগুলো উজ্জ্বল কমলা-হলুদ রং যেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষায় হীরে মানিকের মতো জ্বলছে। ঘন পাতার ঝোপালো গাছগুলোয় ফুটে আছে শত শত ফুল, মানে শত শত মণি-মানিক্য। ঝরনার আকর্ষণ ছেড়ে এবার সেই ফুলের রূপের টানে ছুটে গেলাম তার কাছে। বেশ কয়েকটা ছবি তুলে নিলাম সে ফুল ও গাছের।
ফুলগুলোর চেহারার সঙ্গে খানিকটা মিল খুঁজে পেলাম আমাদের দেশের দোপাটি ফুলের। ফিরে এসে ঘাঁটাঘাঁটি করতেই ফুলটির নাম বেরিয়ে এল। অনুমান মিথ্যা নয় ও তো দোপাটিরই আর এক বোন। ইংরেজি নাম জুয়েলউইড। সার্থক নাম, জুয়েলের মতোই ওর রূপ। বিরুৎ জাতীয় সে গাছ তিন-চার ফুট লম্বা হয়, নরম ডালপালা। ডালপালা নলাকার, মসৃণ ও রসাল, খানিকটা অর্ধস্বচ্ছ, কাণ্ডের গিঁটগুলো ফোলা ফোলা। ডালের গিঁট থেকে দুপাশে পাতা বের হয়। নিচের দিকের পাতাগুলো বিপরীতমুখীভাবে থাকলেও ডালের ওপরের দিকের পাতারা থাকে একান্তরভাবে। পাতা উপবৃত্তাকার বা বল্লমাকার, কিনারা করাতের মতো অগভীর খাঁজকাটা, অগ্রভাগ সুচালো।
পাতার বোঁটার কোল থেকে ফুলগুলো ফুটে আছে। ফুল দেখে মনে হচ্ছে সেগুলো যেন কেউ আংটা বা হুক দিয়ে গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে রেখেছে। উজ্জ্বল রক্তিম তিন খাঁজযুক্ত কমলা পাপড়ির রং আলো ছড়াচ্ছে। বৃতির রংটাও প্রায় একই। কোনো কোনো ফুলে উড়ে বেড়াচ্ছে ক্ষুদে মৌমাছিরা। ফুল থেকে তারা মধু আহরণে ব্যস্ত, থিতু হওয়ার সময় ওদের নেই। মৌমাছিরা মধু লুটে চলে গেলেও ফুলগুলোর অবশ্য তাতে বিশেষ কোনো উপকার হচ্ছে না। কেননা, ওরা স্বপরাগী। নিজেরাই নিজেদের পরাগায়নে সমর্থ। পরাগায়ন ও নিষেকের পর গাছগুলোয় যে ফল গঠিত হয় তার বীজ থেকেই আবার এ গাছ জন্মে। ফল পাকলে আপনা আপনি ফেটে যায়। এ জন্য দোপাটিদের আর এক ইংরেজি নাম ‘টাচ-মি-নট’। অর্থাৎ কেউ যদি ওদের পাকা ফলে আঙুল ছোঁয়ায় তাহলে সে আপনা আপনি ফেটে যায়, এমনই লাজুক ওরা। কমলা রঙের ফুল ফোটে বলে কেউ কেউ এ বুনো দোপাটির নাম রেখেছে ‘অরেঞ্জ বালসাম’। বালসাম দোপাটির সাধারণ নাম, সব দোপাটিকেই এ নামে ডাকা হয়। আবার পাপড়ির রং একভাবে শুধু কমলা না, তার ভেতরে লাল লাল ফুটি বা দাগ আছে। এ জন্য এর আরেক নাম স্পটেড জুয়েলউইড, উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Impatiens capensis, পরিবার বালসামিনেসী।
বর্ষজীবী এ গাছ ফুল-ফল ধরা শেষে মরে যায়, বীজ থেকে সেখানে পরের বছর আবার গাছ জন্মায়। ওহিওপাইল থেকে ফিরে এসে পিটসবার্গ শহরের শেনলি পার্কের লেকের ধারে দেখলাম আগাছার মতো হোগলা, মুথা ও অন্যান্য গাছের সঙ্গে জংলাভাবে জন্মে আছে এ গাছ। জুয়েলউইড উত্তর আমেরিকার গাছ, সে দেশই ওর জন্মভূমি ও আদিনিবাস। আমেরিকায় এ গাছ আগাছা। উত্তর আমেরিকায় বসন্তের শেষ থেকে শুরু করে শরৎ-হেমন্ত অবধি ফুলগুলো ফোটে। উনিশ ও বিশ শতকে এ ফুল উত্তর আমেরিকা থেকে ছড়িয়ে পড়ে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, পোল্যান্ড, সুইডেন ও ফিনল্যান্ডে। আমাদের দেশে সাত প্রজাতির দোপাটি থাকলেও এ প্রজাতির দোপাটি নেই।