অক্টোবরে শুরু হয় টিয়াপাখির পূর্বরাগ। প্রায়ই এখন পথতরুতে আর দালানের কার্নিসে জোড়ায় জোড়ায় প্রেমাতুর টিয়া আপনার চোখে পড়বে। সব টিয়া দম্পতির দীর্ঘ প্রণয়পর্ব শেষ হওয়ার আগেই শীত নেমে আসবে। শীত এলে গাছের কোটরে কিংবা দেয়ালের ফোকরে টিয়াপাখিরা ডিম দেবে। ডিম ফুটে ছানা হতে হতে শীত শেষ হয়ে বসন্তের বাতাস বইবে উত্তর গোলার্ধে। গাছের পাতা আর ফল খেয়ে বেঁচে থাকে বলে বসন্তকালেই ছানা পালতে বেশি আগ্রহী ছাপোষা টিয়াপাখিগুলো। টিয়ার বাড়ন্ত ছানাদের জন্য বসন্তেই তো বিস্ফোরণ ঘটে পুষ্টিকর পত্রপল্লব ও বুনোফলের।
কোটরের সীমাবদ্ধ সূতিকাগার থেকে বেরিয়ে আনকোরা টিয়া-ছানাগুলো গ্রীষ্মের তপ্ত বাতাসে ভর করে উড়ে যায় দূর-দূরান্তে। আহার্য নিয়ে মা-বাবার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় না নেমে অধিকাংশ ছানাই অজানা এলাকা খুঁজে নিয়ে নতুন জীবন শুরু করতে চায়। অজ্ঞাত জগতের সন্ধানে চ্যাংড়া পাখিদের সুদীর্ঘ এই একমুখী যাত্রার ইংরেজি নাম ‘ডিস্পার্শান’। বাংলায় আমরা বলতে পারি ‘বিক্ষেপ’। শত বছর ধরে চ্যাংড়া টিয়াপাখির সেই বিক্ষেপ সীমানাও ছাড়িয়ে গেছে এ দেশের তো বটেই, এ মহাদেশেরও। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এই পাখি আদিতে ভারতবর্ষ ছাড়া শুধু মধ্য-আফ্রিকার দু-একটি বনের প্রান্তে বাস করত। ক্রমে এ পাখির বসবাস পুরো এশিয়া ও আফ্রিকায় বিস্তৃত হয়েছে। বিশ শতকে ওরা ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডেও ছড়িয়ে পড়েছে।
টিয়াপাখির এই বিশ্বজয়ের পেছনে মানুষের অবদান অনেক। চমৎকার গড়ন, মনমাতানো রং আর নির্ভীক আচরণের জন্য আদিকাল থেকে মানুষ টিয়াপাখি পছন্দ করে। আলেকজান্ডারের আমলেও পোষা পাখি হিসেবে রোমে টিয়াপাখির বেশ কদর ছিল। ধারণা করা হয়, প্রথমত পোষা পাখি হিসেবেই টিয়া এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে গেছে। তারপর টিয়া নিগড় ভেঙে বেরিয়ে গিয়ে নাতিশীতোষ্ণ ও শীতপ্রধান দেশের বৈরী প্রকৃতিতে বসবাস করার দক্ষতা অর্জন করেছে। ইট, সিমেন্ট, বিটুমিন, ধোঁয়া, ধুলা ও হট্টগোল অগ্রাহ্য করে লোকালয়ে বাস করতে টিয়া যে কত পটু তা আমরা জানি। টিয়াপাখির অনুকূলে গেছে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন। নতুন দেশে তার শত্রু নেই বলেও টিয়ার বাড়বাড়ন্ত বেশি হয়েছে। ১৯৭৪ সালে চিড়িয়াখানা থেকে কয়েক জোড়া টিয়া ছাড়া হয়েছিল ব্রাসেলস শহরে, এখন সেখানে টিয়ার সংখ্যা পাঁচ হাজার। গত দশকে নেদারল্যান্ডসে টিয়ার সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে ২০ হাজারে পৌঁছায়। হাওয়াই দ্বীপে টিয়াপাখিকে ইনভেসিভ বা আগ্রাসী প্রজাতি আখ্যা দেওয়া হয়েছে। টিয়ার সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য সেখানে দুই বছরের প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। সংরক্ষণের স্বার্থেই সেখানে এখন টিয়াপাখিকে সম্পূর্ণ নির্মূল করতে হবে।
সর্বত্রগামী এই পাখিটি এ দেশে শুধু টিয়া নামে পরিচিত হলেও এর পোশাকি নাম সবুজ-টিয়া। ইংরেজি নাম রোজ-রিংড প্যারাকিট। বাংলাদেশে আরও ছয় প্রজাতির টিয়া আছে। কিন্তু লোকালয়ে টিকে থাকতে কেউই ততটা সফল হয়নি, যে সাফল্য সবুজ-টিয়ার জন্য অবশেষে কাল হয়ে উঠেছে হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে। আগ্রাসী প্রজাতি আখ্যায়িত হওয়া এবং নির্মূল অভিযানের টার্গেট হওয়া যেকোনো জীবের জন্যই অত্যন্ত দুঃখজনক। তবে অনেকের মতে, এটাই অতি-সাফল্যের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি এবং হয়তো তা হোমো সেপিয়েন্স নামক প্রাণির জন্যও প্রযোজ্য।