আমাদের গ্রামের বাড়ির দক্ষিণে ছিল উঠান। সেই উঠানের দক্ষিণে ছিল নানা রকমের গাছপালায় সমৃদ্ধ বাগান। সেই বাগানেই ছিল স্থলপদ্মগাছ। যখন ফুল ফুটত শোভা বেড়ে যেত বাগানের। ছুটির দিনে অনেক সময় কাটিয়ে দিতাম স্থলপদ্মগাছের কাছে। মা আমাদের এই ফুলের বড়া ভেজে খাওয়াতেন। এর বড়া খুব সুস্বাদু। খুব মনে পড়ে ছোটবেলার সেই স্মৃতি।
স্থলপদ্ম সৌন্দর্যে অনন্য। কবি কালিদাস তার মেঘদূত কাব্যে যাকে বিরহী যক্ষের প্রিয়ার চোখের পাপড়িকে তুলনা করেছেন স্থলপদ্মের আধখোলা ও আধবোজা চোখের পাপড়ির সঙ্গে।
গত ১ নভেম্বর ২০২৪ গিয়েছিলাম ব্রহ্মপুত্র তীরের শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন সংগ্রহশালায়। এর আঙিনায় দেখা পেলাম স্থলপদ্মের। আর ছবি তুলে ফেললাম ঝটপট। এ ছাড়া ময়মনসিংহ শহরের জয়নুল উদ্যানের উল্টোদিকে সিভিল সার্জনের বাসভবনের সামনে, আনন্দমোহন কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের বাগানে এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেনে স্থলপদ্মগাছ রয়েছে।
পদ্ম কিন্তু স্থলে জন্মায় না। সারা বছর পানি থাকে এমন জায়গায় পদ্ম জন্মায়। তার পরও ফুলটির নাম স্থলপদ্ম। পদ্ম আর স্থলপদ্ম পুরোপুরি আলাদা পরিবারের। স্থলপদ্ম মাঝারি ধরনের ঝোপালো গুল্ম। রক্তজবাফুলের সঙ্গেই এর বেশি মিল। কারণ রক্তজবা আর স্থলপদ্ম একই গোত্র আর একই গণের উদ্ভিদ। এই উদ্ভিদের বৈজ্ঞানিক নাম Hibicus Mutabilis (হিবিসকাস মিউটাবিলিস), এটি Malvaceae (মালভেসী) পরিবারের উদ্ভিদ। এর ইংরেজি নাম Cotton Rose (কটন রোজ)। এই ফুলকে হিন্দিতে স্থলকমল, শলগড়, গুলিয়াজেব, সংস্কৃতে পদ্মচারিণী বলে। সাধারণত তিন-চার মিটারের মতো উঁচু হয়। পাতাগুলো অনেকটা ঢেঁড়স পাতার মতো। তবে এর পাতা ঢেঁড়স পাতার চেয়ে নরম। কান্ড খসখসে, রোমশ। ফুলের গঠন রক্তজবার মতো কিন্তু অপেক্ষাকৃত বড়। ফুলের রঙ সকালের দিকে সাদাটে লাল এবং বিকেলে রক্তের মতো লাল রঙের হয়।
চীন স্থলপদ্মের আদি বাসস্থান। মাঝারি ধরনের গুল্মজাতীয় গাছ। ইংরেজিতে কটন রোজ নামে পরিচিত। সাধারণত ৩-৪ মিটার উঁচু হয়। পাতাগুলো অনেকটা ঢেঁড়স পাতার মতো কিন্তু কোমল ,ঢেঁড়স পাতার মতো খসখসে নয়। কাণ্ড খসখসে, লোমশ। ফুলের গঠন অনেকটা পঞ্চমুখী জবার মতো। জবা ও স্থলপদ্ম মালভেসী পরিবারের উদ্ভিদ। স্থলপদ্ম রক্তজবা ফুলের চেয়ে বড়। স্থলপদ্ম সকালের দিকে সাদাটে লাল এবং বিকেলে কুঞ্চিত হয়ে রক্তের মতো লাল হয়। গ্রীষ্মের শুরু থেকে শুরু করে শরৎ ও হেমন্তজুড়ে সাদা বা গোলাপি ফুল ফোটে। উদ্ভিদটি পুরো রোদে বা আংশিক ছায়ায় ভালো জন্মে এবং ভালো মাটি পছন্দ করে।
কাটিং দ্বারা এর বংশ বিস্তার সবচেয়ে সহজ হয়। তবে বীজের মাধ্যমেও খুব সহজে বংশ বিস্তার করে, যদিও বীজের গাছে ফুল আসতে অনেক বেশি সময় লাগে, যেখানে কাটিং করা গাছে এক বছরেই ফুল ফোটে। শীতকালে গাছ ছেঁটে দেওয়া ভালো।
স্থলপদ্ম মূলত চীন এবং সংলগ্ন দেশগুলোর স্থানীয় গাছ হলেও বর্তমানে এটি অ্যান্টার্কটিকা ছাড়া সব মহাদেশে পাওয়া যায়। কোমরে ও যন্ত্রণা হলে স্থলপদ্ম গাছের শিকড়ের ছাল বেঁটে স্থলপদ্ম ফুলের রস চিনিসহ ২-৩ বার করে ৩-৪ দিন খেলে প্রস্রাবের বেগ ভালো হয়। মেয়েদের কোমরে ও তলপেটে যন্ত্রণা হলে স্থলপদ্ম গাছের শিকড়ের ছাল বেঁটে সরবত করে মাসিক হওয়ার ৭-৮ দিন আগে থেকে ২-৩ মাস খেলে উপকার পাওয়া যায়। স্থলপদ্ম ফুলের বড়াও সুস্বাদু।
লেখক: অধ্যাপক, উদ্ভিদবিজ্ঞান ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক