হেমন্ত ফুরিয়ে আসছে, মাঠগুলোও ধানশূন্য হয়ে পড়েছে। এ রকম শূন্যতার মাঝেও পূর্ণতার খোঁজে ঢাকা থেকে মানিকগঞ্জে চলেছি প্রকৃতি দর্শনে। বাংলাদেশ নেচার কনজারভেশন কাউন্সিলের একদল প্রকৃতিপ্রেমিক, আমরা চলেছি হরিরামপুর থেকে ঘিওরে। পথে ভাটুরা গ্রামের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আব্দুর রহিম ভাই হঠাৎ গাড়ি থামাতে বললেন। কারণ কী? বললেন, কী একটা গাছ দেখলাম, মনে হলো তেউড়ি। নেমে ভালো করে দেখতে হবে। সে গাছের ঝোপ পেরিয়ে গাড়ি কিছুটা সামনে গিয়ে দাঁড়াল। রাস্তার ঢালে নানা রকমের ঝোপঝাড়, এরপর দিগন্তবিস্তৃত ধানখেত, শূন্য মাঠ। ঝোপঝাড়ে কয়েকটা ডুমুরগাছকে চেপে ধরেছে সে গাছের লতাপাতা।
আশ্রয়দাতা গাছগুলো কী তা ভালো করে না দেখলে বোঝা যাচ্ছে না। সাদা দুধরঙা ফুল ফুটে রয়েছে বেশ কয়েকটা। দূর থেকে ভেবেছিলাম তেলাকুচা ফুল। কাছে গিয়ে রহিম ভাই নিশ্চিত হয়ে জানালেন, এটাই সেই গাছ, যেটা আমরা দেখব বলে ভেবে রেখেছিলাম, এটাই সেই তেউড়িগাছ। এ পথে বেশ কয়েকবার যাওয়ার সময় এ গাছ দেখছি, আরও একটা গাছ চোখে পড়ে, তার নাম মুন ফ্লাওয়ার। তার ফোটা ফুল দেখতে হলে আসতে হবে রাতের বেলায় বা খুব ভোরে। তেউড়িগাছের ফুলগুলো দেখে কলমি বলে মনে হলো, আবার কখনো মনে হলো মর্নিং গ্লোরি।
রহিম ভাই পাশের বাড়ি থেকে একটা লম্বা কুটা এনে ফুলসমেত লতা টেনে নামিয়ে বললেন, এ গাছকে সঠিকভাবে শনাক্তকরণের চাবিকাঠি হলো এর লতা। কলমির লতা নলাকার ও বেলুনাকার, ফাঁপা। আর তেউড়ি মূলের লতা তিনটি শিরবিশিষ্ট, মোচড় খাওয়া। সাদা কলমির মতোই ফুল, তাই এর আরেক নাম দুধকলমি। পাতা দেখতে অনেকটা পানপাতার মতো, বোঁটার কাছে হৃৎপিণ্ডের মতো খাঁজকাটা, অগ্রভাগ ক্রমশ সরু হয়ে সুচালো। কলমির চেয়ে এর পাতা বড়। ফলগুলো দেখতে অনেকটা গম্বুজের মতো, পেট ফোলা, মাথা চোখা, গোলাপি-বাদামি রং।
গাছ-দর্শন শেষে ঢাকায় ফিরে এসে বইপত্র নিয়ে বসলাম ওর তেউড়ি নামের রহস্য খুঁজতে। বাংলাদেশে উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষের সপ্তম খণ্ডে গাছটির বর্ণনা পেলাম তার প্রজাতিগত নামের সূত্র ধরে। তবে সেখানে কোথাও এর নাম তেউড়ি বলে উল্লেখ করা হয়নি, স্থানীয় নাম হিসেবে এর নাম লেখা হয়েছে দুধকলমি। দুধের মতো সাদা ফুলের রং, তাই এরূপ নাম। লতা ও পাতার বোঁটা ভাঙলেও সেখান থেকে সাদা দুধের মতো আঠালো পাতলা কষ বের হয়। অন্য আরও বইপত্র ও অন্তর্জাল ঘেঁটে কোথাও এর তেউড়ি নামটা পেলাম না। শেষে আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্যের চিরঞ্জীব বনৌষধি বইয়ের পঞ্চম খণ্ডে পেলাম এই তেউড়ি নাম, যার প্রজাতিগত নাম Operculina turpethum ও গোত্র কনভলভুলেসি। তার মানে গাছটা কলমি গোত্রীয়। তেউড়ি নামটা ওর আয়ুর্বেদিক নাম, সংস্কৃত নাম ত্রিবুৎ থেকে এর নাম হয়েছে তেউড়ি।
প্রাচীনকালে চিকিৎসক বা কবিরাজরে বলা হতো বৈদ্য। বৈদ্য হলো সে, যার মধ্যে বেরে তথা অথর্ববেদের জ্ঞান থাকে। সেই বেদে তেউড়িকে সম্বোধন করে লেখা হয়েছে ‘তুমি ত্রিবৃৎ, অর্থাৎ ত্রি স্বভাবে বর্তমান ঔষধি। তেজ, জল ও অন্নের প্রকৃতি বিকারে আক্রমণ হলে তুমি তেজ প্রকাশ করে আক্রমণ করো জলের স্বভাবের মতো, সংক্রমিত হয়ে আবার সংশমন করো ক্ষুৎ পিপাসা সংশমনে।’ তিন মহাগুণের অথর্ববেরে তেজী ত্রিবৃৎ বাংলাদেশে এসে নাম ধারণ করেছে তেউড়ি, যার অভিজাত নাম দুধকলমি। হিন্দু ধর্মে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবকে বলা হয় ত্রিদেব। তারা একটি ত্রিকোণ মুদ্রা উদ্ভাবন করেছিলেন, যা সৃষ্টি করেছিল অনেক সমস্যার, সেই পৌরাণিক কাল থেকে দেবতা ও অসুরদের যুদ্ধ, রামের সঙ্গে রাবণের যুদ্ধ, পাণ্ডবদের সঙ্গে কৌরবদের যুদ্ধ। ভাবি, তেউড়ির বীজটাও তো ত্রিকোণ। এই বীজ আবার কোন সমস্যা তৈরি করে তা কে জানে?
তেউড়ি ভূমিতে ও অন্য গাছের ওপর লতিয়ে চলা লতা। এ লতার কাণ্ড তিন থেকে পাঁচটি শিরবিশিষ্ট। লতায় কোনো পশম নেই, শাখা আছে। ফুল দেখতে অনেকটা মাইকের চোঙের মতো, পাঁপড়ি পাঁচটি যুক্ত ও সাদা। ফুল ফোটে অক্টোবর থেকে মে মাস পর্যন্ত। ফল ক্যাপসিউল প্রকৃতির, চাপা গোলাকার, মসৃণ। বীজ ত্রিকোণাকার বা গোলাকার, কালচে। রহিম ভাই বললেন, তেউড়ি এক দারুণ ভেষজগুণের প্রাচীন ঔষধি গাছ। অম্লপিত্ত, জন্ডিজ, আমবাত, কোষ্ঠকাঠিন্য, খোসপাঁচড়া, এমনকি মনোরোগের চিকিৎসাতেও তেউড়ির মূল ব্যবহার করা হয়। এ দেশে ঘন ঝোপ ও রাস্তার ধারে এ গাছ চোখে পড়ে।