কার্তিকের মধ্য দিন। প্রকৃতিবন্ধু রুবাইয়াত রবিন প্রস্তাব দিল, মন ভালো করতে ঢাকার কাছে এক শালবনে যাওয়ার। জিজ্ঞেস করতেই সে জানাল, কাছেই পূর্বাচলে। ভাবলাম, পূর্বাচল তো ভবিষ্যতে ঢাকার এক অভিজাত সমৃদ্ধ উপশহর হতে চলেছে, তাই তার ইতিহাসের সঙ্গে এসব প্রাকৃতিক ইতিহাসের কিছু কথা থাকা দরকার। জায়গাটা কেমন ছিল, এখন কেমন তা কয়েক দশক পরের লোকরাও যেন জানতে পারেন। চার-পাঁচ দশক আগে উত্তরা আর জোয়ার সাহারাকে যেমন দেখেছি, এখন কি আর সে কথা ও ছবি কারও মনে আছে? ধানমন্ডি থেকে বাসে করে গিয়ে নামলাম কুড়িল বিশ্বরোড।
ওভারব্রিজ পার হয়ে সেখান থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে প্রথমে ল্যাংটামাজার মোড়, সেখান থেকে আটোতে গিয়ে নামলাম ওয়েস্টার্ন মোড়। ল্যাংটামাজার থেকে ওয়েস্টার্ন মোড় যেতেই পথের দুধারে যেন গ্রামের গন্ধ পেলাম। চওড়া ও পাকা রাস্তার দুই পাশে বিক্ষিপ্তভাবে দুই-একটা বাড়িঘর, কিন্তু ঝোপঝাড় ও গাছপালাই বেশি, সেই সঙ্গে হিমেল বাতাস। বিকেলে পশ্চিমের মিঠে রোদ এসে চলকে পড়েছে গাছপালার ওপর। ওখানেই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন সেখানকার দুজন গ্রামবাসী- কামাল হোসেন ও শাহ আলম। তাঁদের সঙ্গে নিয়েই ধীরে ধীরে এগিয়ে চললাম শালবনের দিকে।
লালমাটির টিলা কেটে সমান করে রাস্তা বানানো হয়েছে, খাল কেটে তার ওপর সেতু বানানো হয়েছে, কিন্তু রাস্তার দুই ধারে গা ছমছম করা আঁধারের চাপ মিশানো শালবন, গহিন সে বন। ভেতরে প্রবেশের রাস্তা পাওয়াই মুশকিল। ওয়েস্টার্ন মোড় থেকে জয়নাল মোড় পর্যন্ত অর্থাৎ পূব দিকের এক রাস্তা থেকে আর এক রাস্তা পর্যন্ত বিস্তৃত সে শালবন। ওখানকার গ্রামবাসীদের পূর্বপুরুষদের কাছে শোনা কথা যে, একসময় সেসব শালবন ছিল অনেক বড়, এমনকি বাঘও থাকত সেখানে। এখন কমতে কমতে এই ছিটেফোঁটাটুকু অবশিষ্ট আছে, সেটাও কতদিন থাকতে পারে কে জানে? পূর্বদিকের নির্জন রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে বনের প্রান্তে জন্মানো নানারকমের ঝোপঝাড় আর বুনো গাছপালা দেখতে দেখতে চলেছি। দাতই, দাঁতরঙা, ফুলকুড়ি, বন ওকড়া, বন অতসী, চুকাই, জটাশালপান, বননীল, আসাম লতা, লতাপলাশ- কত যে বুনো গাছপালা সেখানে! ওখানকার গ্রামবাসীরা এখনো পূর্বাচলকে বলেন পূর্বাঞ্চল।
আমরুলীপাড়ার বাসিন্দা কামাল হোসেন বললেন, যেখানে এসেছেন সেখানে ছিল পারাবর্ত গ্রাম, আজ পূর্বাচলে ঢাকা পড়েছে অতীতের সে নাম।
হাঁটার সময় বনের কোলে ছোট্ট ঝোপে ফোটা হলদে ফুলগুলোর দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠলাম। এটা তো এ দেশের এক বিপন্ন উদ্ভিদ, সচরাচর দেখা মেলে না। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ’ গ্রন্থের অষ্টম খণ্ডে বর্ণিত বন কুলাথা গাছটিকে বিপন্ন উদ্ভিদ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। অবশ্য সে বইয়ে বন কুলাথার কোনো বাংলা বা স্থানীয় নামের উল্লেখ নেই, শুধু উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম ও বি এম রিজিয়া খাতুনের তোলা গাছের ছবি দেখে এ গাছ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। বইটিতে এ গাছের বর্ণনা শেষে গাছটি সংরক্ষণের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। সেই বিপন্ন উদ্ভিদের দেখা ঢাকার এত কাছে পাব ভাবিনি। গাছটির নাম বন কুলাথা, অন্য বাংলা নাম বন কুর্তি বা বন কুলথি।
বন কুলাথার নেপালি নামটা বেশ। নেপালি ভাষায় এ গাছকে বলা হয় ‘মাস লহরী’। লতানো গাছটির লতানো ডগা যেন নৃত্যরতা লহরীর ছন্দে বায়ুকম্পিত। ইংরাজি নাম Showy Pigeon pea, Peanut Grass, Tropical Clover ইত্যাদি। উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Cajanus scarabaeoides. Syn: Atylosia scarabaeoides, গোত্র ফ্যাবেসি। গাছটি শিমগোত্রীয়, তাই ফুল-ফলের চেহারায় শিমের আদল স্পষ্ট। ঝোপঝাড়পূর্ণ আগাছা ও ঘাসে ভরা জায়গায় এ গাছ জন্মে। যেখানে জন্মে দ্রুত এরা সে স্থানে অন্য গাছগুলোর ঘাড়ে চেপে বসে ও ছেয়ে ফেলতে চায়। লতানো স্বভাব বলে এরা অন্য গাছকে অবলম্বন করে লতিয়ে বাড়ে।
বন কুলাথা বহুবর্ষজীবী লতানো বা ধাবক প্রকৃতির উদ্ভিদ। শিকড় কাষ্ঠল। কাণ্ড ও লতা মরিচা লাল সূক্ষ্ম পশমে আবৃত। একটি পাতার বোঁটায় তিনটি পত্রক থাকে তিন দিকে ছড়ানো, লতার আগার পত্রকগুলো ছোট, গোড়ার দিকেরগুলো বড়। পত্রকের আগা কৌণিক হলেও ভোঁতা। পত্রক মখমলের মতো কোমল। ফুল হলদে, মটরশুঁটি বা বরবটির ফুলের মতো দেখতে। ফলগুলো ইঞ্চিখানেক লম্বা, ঘন পশমাবৃত, শিমের মতো, ৩ থেকে ৬টি বীজ থাকে একটি ফলের ভেতর। জুন থেকে নভেম্বর ফুল ফোটা ও ফল ধরার সময়। পাকা ফল ফেটে বীজ ছড়িয়ে পড়ে, সেখানেই বীজ থেকে গাছ জন্মে।