ঈশ্বরদী থেকে এক আত্মীয় ফোন করে জানতে চাইলেন ঈশ্বর মূলগাছের দরকার। কোথায় পাওয়া যাবে? মুশকিলে পড়লাম। গাছটি চিনি। কিন্তু কোথায় পাওয়া যাবে সে গাছ? বছর চারেক আগে এর একটা লতানো ঝোপ দেখেছিলাম ময়মনসিংহে, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেনে। ঢাকায় চোখে পড়েনি। আর পাবনায় কোথায় কোন জঙ্গলে তাকে পাওয়া যাবে, জানি না।
জানতে চাইলাম, হঠাৎ ঈশ্বর মূলগাছের খোঁজ কেন? বললাম, তুমি তো ব্যবসা নিয়েই থাক, গাছপালার প্রতি হঠাৎ আগ্রহ হলো কেন? জানাল, না একটা বিশেষ প্রয়োজনে খুঁজছি। বাবার বিষব্যথা হয়েছে, ডাক্তার দেখিয়েও ভালো হচ্ছে না। তাই কবিরাজের কাছে গিয়েছিলাম। তিনি বলেছেন, হয়তো ওখানে অ্যাড়াবিষ লেগেছে। ওটা সারাতে দরকার ঈশ্বর মূলগাছ। কবিরাজি ভাষায় সে গাছের নাম রুদ্রজটা।
গাছের জন্য হন্যে হয়ে খোঁজ লাগালাম। ছবি পাঠালাম তাকেও, ওখানকার বন-জঙ্গলে খুঁজে দেখার জন্য। কয়েক মাস খোঁজের পরও সেই গাছের দেখা মিলল না। গাছে ফুল-ফল না থাকলে শুধু পাতা আর লতা দেখে গাছ চেনা মুশকিল। অবশেষে চোখের কাছেই তার দেখা পেলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কার্জন হলের সামনে উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের উদ্ভিদ উদ্যানের লোহার বেড়ায় লতিয়ে উঠেছে একটা গাছ। কার্তিকের ২৩ তারিখে ভোরবেলায় সে গাছটার কাছে গিয়ে দেখলাম, তির তির করে কাঁপছে পাতাগুলো। পাতার ফাঁকে ফাঁকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফুটে আছে ছোট ছোট বেশ কয়েকটা ফুল, কুঁড়ি ও দু-চারটা ফল। ফুল বা গাছের কোনো আহামরি রূপ নেই। কিন্তু বৈদ্যদের কাছে এ এক অসাধারণ গুণের গাছ। এটাই তো প্রকৃতির বিধান। স্রষ্টা যাকে বেশি রূপ দেন, তাকে গুণ দেন কম। আর যাকে রূপ দেন কম, তাকে গুণ দেন বেশি।
ঈশ্বর মূলের গুণ যেন পৌরাণিককালেই ঈশ্বর তাকে দান করেছেন। শিবের সঙ্গে গিরিকন্যা উমার বিয়ের সময় উমার মা অন্যান্য বিবাহিতাদের নিয়ে বিয়ের স্ত্রী-আচারের কাজ সারতে এসে দেখেন, জামাই শিব দাঁড়িয়ে আছেন বাঘের ছাল পরে, বেল্ট বা কোমরবন্দ করা হয়েছে একটি সাপকে। এ দৃশ্য দেখে সবাই সেখান থেকে ভয়ে পালাতে গেলে এক ওঝা এসে তার ঝোলার ভেতর থেকে ঈশ্বর মূলের একটি খণ্ড বরণডালার ওপরে রাখতেই সাপ সর সর করে সরে পালাল আর বাঘছাল খসে পড়ল নিচে। উলঙ্গ শিবকে দেখে সবাই ঘোমটা টেনে দিল লজ্জায়। সেই থেকে মেয়েদের ঘোমটা দেওয়ার চল চালু হলো আর ওঝার কাছ থেকেও সাপ তাড়ানোর সে গাছটার নাম জানা গেল রুদ্রজটা ওরফে ঈশ্বর মূল।
চিরঞ্জীব বনৌষধি বইতেও আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য সর্পাঘাতের চিকিৎসায় রুদ্রজটার পাতা ও মূল বেটে সাপে কাটা স্থানে প্রলেপ দেওয়ার কথা লিখেছেন। রুদ্রজটা নামটা পাই অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ লিখিত উদ্ভিদ অভিধান গ্রন্থেও। সে বইয়ে ঈশ্বর মূলের রুদ্রজটা নাম ছাড়াও আরও ২২টি নাম পাওয়া যায়, নামগুলো হলো- ঈশ্বরী, অর্কমূলা, ইশুরামুলি, ঈশের মূল, মৌরী, রৌদ্রী, জটা, রুদ্রা, সোম্যা, সুবহা, ঘনা, রুদ্রলতা, সুপত্রা, সুগন্ধপত্রা, সুরভি, শিবহা, পত্রবল্লী, জটাবল্লী, রুদ্রাণী, নেত্রপুষ্করা, মহাজটা ও জটরুদ্রা।
ঈশ্বর মূলগাছের উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Aristolochia indica ও গোত্র অ্যারিস্টোলোকিয়েসি। ঈশ্বর মূল একটি লতানো গাছ, সরু সবুজ লতা ঘড়ির কাঁটা যেদিকে ঘোরে সেদিকে ঘুরে ঘুরে অবলম্বনকে পেঁচিয়ে ওপরে ওঠে। গাছের নিচের অংশ কাষ্ঠল হলেও ওপরের অংশ নরম ও সবুজ। পাতা অবডিম্বাকার থেকে বেহালা আকৃতির, অগ্রভাগ সুচাল, ফলক মসৃণ। পাতার বোঁটার গোড়ার কক্ষ থেকে ছোট ছোট ফুল ফোটে। ফুলের গড়নটা বেশ অদ্ভুত, একেবারে সাপুড়েদের বিণের মতো, বোঁটার কাছটা ফোলা, বেলনাকৃতির নল, পাপড়ি বা ফুলের মুখটা সাপের মতো হা করা। এ গাছের চরিত্র দেখে সাপের সঙ্গে এর সম্পর্কের বিষয়টি বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে। প্রমাণ করার দায়িত্ব গবেষকদের।
এশিয়াটিক সোসাইটি বাংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষের ষষ্ঠ খণ্ডে এ উদ্ভিদের ঔষধি গুণ সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, এর তাজা পাতার রস কাশির উপশম করে, বীজ প্রদাহনাশক, পাতার রস তৃষ্ণা সারায়, শিকড় জন্মনিরোধক কাজে ব্যবহার্য। ছোট ফল দেখতে কিছুটা ঝিঙার মতো, তবে তা ঝিঙার মতো লম্বা না, ঘটাকৃতি আর আয়ত-ডিম্বাকার। আগস্ট থেকে নভেম্বরে এ গাছে ফুল ফোটে ও ফল ধরে। বীজ ও শিকড় গজানো কাণ্ড কেটে লাগালে নতুন গাছ হয়। ঈশ্বর মূলগাছ এ দেশে বিরল, এর ভেষজ গুণ নিয়ে আরও গবেষণা ও এ গাছ সংরক্ষণ করা উচিত।