চারপাশে শুধু ফুল আর ফুল। লাল, নীল, হলুদ, সাদা, গোলাপিসহ নানা রঙের ফুলের সুগন্ধ ও সৌন্দর্যে ছেয়ে গেছে পার্কের পুরো এলাকা। আর এ সৌন্দর্য দেখতে ভিড় জমাচ্ছেন হাজার হাজার দর্শনার্থী। বলা হচ্ছে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের সলিমপুর ইউনিয়নের ফৌজদারহাটে ডিসি পার্কে আয়োজিত ফুল উৎসবের কথা।
এ বছর ডিসি পার্কে তৃতীয়বারের মতো আয়োজন করা হয়েছে ফুল উৎসব। ৩ জানুয়ারি শুরু হয় এ উৎসব। মাসব্যাপী এ আয়োজনে প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত পার্ক দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকছে। আগামী ৪ ফেব্রুয়ারি এ উৎসব শেষ হবে। এবার প্রত্যেক দর্শনার্থীর পার্কে প্রবেশের জন্য ৫০ টাকা ফি নির্ধারণ করা হয়েছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, পার্কের ভেতরে জোড়া পুকুরের পশ্চিম পাশে মূলত ফুল উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। সে স্থান সাজানো হয়েছে লাখের বেশি ফুলের চারা দিয়ে। দেশি-বিদেশি ১৩৬ প্রজাতির ফুল রয়েছে এখানে। দেশি ফুলের মধ্যে রয়েছে ১৫ প্রজাতির গাঁদা, জবা, কৃষ্ণচূড়া, চন্দ্রমল্লিকাসহ বিভিন্ন ফুল।
উৎসবে যেসব ফুল রাখা হয়েছে তার বেশির ভাগই শীতকালীন বিদেশি প্রজাতির। বিদেশি ফুলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ২৫ ধরনের গোলাপ, স্টকস, গ্যাজানিয়া, ক্যামেলিয়া, হলিহক, স্নেক, নেসটিয়াম, লিলিয়াম, ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, ম্যাগনোলিয়া, চেরি, জারবেরা, উইলো, উইস্টেরিয়া, কনকাম্বরি, হাইব্রিড জবাসহ আরও শতাধিক জাতের ফুল।
ফুলের সৌন্দর্য উপভোগের পাশাপাশি এখানে মিলছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী বাহারি রকমের পিঠা-পুলিসহ নানান খাবারের স্বাদ। আছে শিশুদের জন্য আলাদা কিডস জোন।
উৎসবে প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। স্থানীয় গায়কদের পাশাপাশি সারা দেশের শিল্পীরা এখানে অংশগ্রহণ করছেন। গত বছর উৎসবটি ১৫ দিনব্যাপী হলেও এ বছর তা বাড়িয়ে ৩০ দিন করা হয়েছে।
প্রতিদিন শিক্ষক-শিক্ষার্থী, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার কর্মকর্তা-কর্মচারী, বন্ধুবান্ধবসহ অনেকে পরিবার-পরিজন নিয়ে এ সৌন্দর্য দারুণভাবে উপভোগ করছেন। ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকেও দর্শনার্থীরা ছুটে আসছেন। এভাবেই সাগরপাড়ের জেলাতে সুবাস ছড়াচ্ছে ডিসি পার্কের ফুলের বাগান।
ডিসি পার্কে কথা হয় চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলা থেকে আসা পাঁচ বন্ধুর সঙ্গে। তারা বলেন, ‘পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত ও টানেল দেখতে এসেছিলাম। সেখান থেকে ডিসি পার্কে এসেছি। এখানে ব্যাপক আয়োজন দেখে অবাক হয়েছি। পুরো পার্কটা ফুলে ফুলে সজ্জিত। ফুলের রাজ্যে অন্য রকম ভালো লাগছে।’
সীতাকুণ্ড থেকে আসা ওমরগনি এমইএস কলেজের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান মুনমুন বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম (ফেসবুক) এবং বেশ কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের বরাতে ডিসি পার্কের ফুলের ছবি দেখে কৌতূহলী হয়ে উঠি। তাই নিজ চোখে দেখতে এলাম। এখানে এসে দেখার পর সত্যি লাখো রঙিন ফুলের সুবাসে আমি বিমোহিত হয়েছি। আমরা গত বছরও এ পার্কে এসেছিলাম। সন্ধ্যার পর ভাবলাম ভিড় কম হবে। কিন্তু দিনের চেয়ে সন্ধ্যার পর বেশি মানুষ এসেছে।’
চট্টগ্রাম নগরীর চকবাজার এলাকা থেকে পরিবার নিয়ে বেড়াতে এসেছেন ব্যাংকার জাহিদ হাসান। তিনি বলেন, ‘আমি ডিসি পার্কে প্রথমবার এসেছি। পার্কের বেশির ভাগ ফুল বিদেশি প্রজাতির, যা আগে কখনো দেখিনি। তাই তো ফুলের সৌন্দর্য দেখে আমরা মুগ্ধ হয়েছি। পাশাপাশি গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী হরেক রকমের খাবার রয়েছে। শিশুদের জন্য বিনোদনের নানা ব্যবস্থা থাকায় বাড়তি আনন্দ যোগ হয়েছে। এমন মনোমুগ্ধকর আয়োজনের জন্য জেলা প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানাই।’
গত শুক্রবার (১০ জানুয়ারি) বিকেলে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে ফুলের উৎসব ঘিরে ডিসি পার্কে মানুষের ব্যাপক ভিড় দেখা গেছে। সকাল থেকেই দর্শনার্থীরা আসতে শুরু করেন। সন্ধ্যাবেলায় এত মানুষ আসে যে মানুষকে ঢোকার জন্য দীর্ঘ সময় ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। একজন বের হলে অন্যজন ঢোকার সুযোগ পায় এমন অবস্থা। ভেতরে লোকজনের চাপে হাজার হাজার দর্শনার্থী পার্কের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আনসার সদস্যরা বলেন, শুক্রবার ডিসি পার্কে লাখের ওপরে দর্শনার্থী আসায় বাড়তি চাপে পড়তে হয়। এতে করে দর্শনার্থীদের শৃঙ্খলায় রাখতে হিমশিম খেতে হয়েছে। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন অনেকেই। এ ছাড়া টিকিট নিয়ে আবার অনেকে টিকিট না নিয়েই দেয়াল টপকে ভেতরে প্রবেশ করেছেন। এ সময় বাধা দিলে নিরাপত্তাকর্মীদের সঙ্গে বিবাদে জড়ান অনেকে। অনেকে চেয়ারের ওপরে উঠে নাচানাচি করেছেন। অতিথিদের চেয়ার নিয়েও টানাটানি করেন অনেকে। পার্কে প্রতিদিন ২০-২৫ হাজার দর্শনার্থী আসেন। কিন্তু শুক্রবার ছুটির দিন হওয়ায় এক লাখের মতো মানুষে এসেছে পার্কে। এতে চরম বেকায়দায় পড়তে হয়।
সিনিয়র সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আলাউদ্দিন মুঠোফোনে বলেন, ‘গত শুক্রবার দুপুরের পর থেকে ৫০ হাজারের বেশি মানুষ টিকিট নিয়ে প্রবেশ করলেও সন্ধ্যার পর অনুষ্ঠান চলাকালে প্রায় লাখো মানুষের সমাগম হয়। এ সময় জেলা প্রশাসনের প্রস্তুতির চেয়ে বেশি দর্শক এসেছে। অনুষ্ঠান চলাকালে অতিথিদের চেয়ার দখল করে উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করায় কিছুটা বিড়ম্বনা তৈরি হয়। পরে মাইকিং করে দর্শকদের বুঝিয়ে শান্ত করে পুনরায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিচালনা করা হয়।’
জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম বলেন, ‘চট্টগ্রাম শহর থেকে পযর্টকদের আসা-যাওয়ার সুবিধার্থে শাটল বাস সার্ভিস চালু করা হয়েছে। এটি টাইগার পাস থেকে পতেঙ্গা হয়ে ডিসি পার্কে দর্শনার্থীদের নিয়ে আসবে। আবার একই রুট হয়ে গাড়ি টাইগার পাস ফিরে যাবে। এ ছাড়া এখানে দর্শনার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত টয়লেট ও পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে। চট্টগ্রামবাসীসহ সারা দেশের মানুষকে আহ্বান জানাচ্ছি এখানে এসে এ ফুল উৎসবকে উপভোগ করার জন্য।’
তিনি জানান, এবারের ফুল উৎসবে বেশ কিছু নতুনত্ব রয়েছে। ১২টি দোকান নিয়ে গ্রামীণ মেলা বসবে, যা আগে ছিল না। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি মাল্টিকালচারাল ফেস্টিভ্যাল, বই উৎসব, ঘুড়ি উৎসব, ফুলের সাজে একদিন, পিঠা উৎসব, লেজার লাইট শো, ভিআর গেইম, মুভি শো, ভায়োলিন শো, পুতুলনাচসহ নানা রকমের আয়োজন।