চিতা নামের গাছ খোঁজার আগে চিতা নামটা নিয়েই তো বিভ্রাটে পড়লাম। চিতা নামে এ দেশে বেশ কয়েকটি গাছের দেখা পাওয়া যায়। একটি ফুলের রং লাল, তাকে বলে রক্তচিতা। আরেকটি ফুলের রং নীল, তাকে বলে নীল চিতা। পহেলা অগ্রহায়ণ মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার সুলতানপুর গ্রামে তানভীর আহমেদের তরুরাজ্যে গিয়ে পেলাম সাদা ফুলের আর এক গাছের দেখা, তার নাম চিতা বা সাদা চিতা। আবার চিতা লিলি নামে আরও একটি গাছ আছে এ দেশে। চিতা নামের গাছগুলো বেশ চিন্তায় ফেলল। চিতা আর চিন্তা শব্দ দুটির বানানে সামান্য তফাত থাকলেও অর্থে বিস্তর পার্থক্য। মরা মানুষকে পোড়ানো হয় চিতায় আর তাজা মানুষকে পোড়ায় চিন্তা। চিতা নামের সঙ্গে কেমন যেন লাশ লাশ গন্ধ মেখে আছে। থাকাটাও তো একেবারে অমূলক না। রোগেও তো মানুষ মরে। আর সে রোগ যদি চিতাগাছ সারিয়ে দিতে পারে তো তার নাম চিতা কি হতে পারে না? চিতা এ দেশের এক গুরুত্বপূর্ণ ঔষধি গাছ।
বৈদিক সাহিত্যে চিতাকে তুলনা করা হয়েছে বিশ্বকর্মার সঙ্গে, যিনি পৃথিবীর মানুষকে শোক ও দুঃখ দূর করেন। আবার শোকের ক্ষেত্রও তৈরি করেন। যদিও সংস্কৃত ভাষায় চিতার নাম চিত্রক, কিন্তু চিত্রকের বর্ণনায় চিতাগাছকে চিনতে অসুবিধা হয় না। মহাভারতের বনপর্বেও রয়েছে চিত্রকের কাহিনি। তবে সে চিত্রক কোনো উদ্ভিদ না, চিত্রক সেন ছিলেন গন্ধর্ব রাজ। গন্ধর্ব রাজ্য ছিল আজকের আফগানিস্তান। সেসব পৌরাণিক কালের কথা। একালে এসেও চিত্রকের খোঁজ পেলাম, সেটা চিত্রক উদ্ভিদ; যার ডাকনাম চিতা। অথর্ববেদেও চিত্রকগাছের উল্লেখ আছে ঔষধি গাছ হিসেবে। প্রাচীনকালে যে কুষ্ঠরোগী চিতায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে বসে থাকত, সেই রোগীকে চিতা থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসত চিতাগাছ, তাই কি তার নাম চিতা? গ্রামের মানুষরা একে চিতেগাছ বলে ডাকে। সাদা চিতার চেয়ে লাল চিতাগাছের ঔষধিগুণ বেশি। সাদা চিতার উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Plumbago yeylanica ও গোত্র প্লামবাগিনেসি।
সাদা চিতা বা চিতা একটি বহুবর্ষজীবী বিরুৎজাতীয় ছোট গাছ। কোথাও লাগালে আগাছার মতো বাড়তে থাকে। বাড়তে বাড়তে দীর্ঘ সময় পর কখনো কখনো সে গাছ ছোট গুল্মের রূপ নেয়। গাছ আড়াই মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। ফুল সাদা ও পাঁচটি পাঁপড়িবিশিষ্ট, তারার মতো ফোটে। বোঁটা খাটো। ফল লম্বাটে ক্যাপসুলের মতো, ফলের খোসা কণ্টকযুক্ত, সবুজ। পাকলে ফল পাঁচটি খণ্ডে ভাগ হয়ে ফেটে যায় ও ভেতর থেকে বাদামি বীজ বেরিয়ে মাটিতে ঝরে পড়ে। এ দেশে অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরে সাদা চিতার ফুল ফোটে ও ফল ধরে। বীজ থেকে চারা জন্মে, তবে শাখা কেটে মাটিতে পুঁতে দিলেও তা থেকে গাছ হয়।
ভারতের লোধা আদিবাসীরা চার মাস পর্যন্ত গর্ভপাত ঘটাতে সাদা চিতার শিকড় ব্যবহার করে, যদিও তা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। সুন্দরবনের মুণ্ডা আদিবাসীরা বাতের চিকিৎসায় এর শিকড় সর্ষের তেলে গরম করে ব্যবহার করে। ওঁরাও আদিবাসীরা সাপে কাটা স্থানকে অনুভূতিহীন করার জন্য এর শিকড় বেটে ব্যবহার করে। গেঁটে বাত চিকিৎসায় এর তাজা শিকড় পিষে মলমের মতো করে তা জয়েন্টে মালিশ করা হয়। শ্বেতী রোগেও এ গাছ ব্যবহার করে উপকার পাওয়া যায় বলে জানা গেছে।
এ দেশে সাদা চিতার গাছ বেশ দেখা যায়। তার চেয়ে কম দেখা যায় নীল চিতাগাছ, রক্তচিতা বা লাল চিতাগাছ তার চেয়ে কম দেখা যায়। তবু কেন জানি না, বাংলাদেশের উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ বইয়ের নবম খণ্ডে সাদা চিতাগাছকে বিরল প্রজাতি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কবিরাজরা গাছ উপড়ে সাদা চিতার শিকড় সংগ্রহ করে। তাই অতিরিক্ত আহরণে গাছটি বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। এ গাছ কেউ লাগায় না, গ্রামীণ জঙ্গলে প্রাকৃতিকভাবে জন্মে। এ গাছ সংরক্ষণেরও কেউ কোনো ব্যবস্থা নেয় না।