ঢাকা ৪ মাঘ ১৪৩১, শনিবার, ১৮ জানুয়ারি ২০২৫

ভরত পাখির সুরেলা গান

প্রকাশ: ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৩৬ এএম
ভরত পাখির সুরেলা গান
বাংলা ঝাড়ভরত, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠ থেকে তোলা। ছবি: লেখক

‘ভোরের বেলায় তুমি আমি
নীল আকাশের ভরত পাখির গানে
কবে যে এই ধুলোমাটির পৃথিবীতে
প্রথম দেখেছিলাম’

-    জীবনানন্দ দাশ

বসন্তের দুপুর, খোলা মাঠে বসন্তের হাওয়া বইছে। আকাশে ঝলমলে রোদ। এমন সময় মাঠের ওপর ছোট্ট এক পাখি ডানা ঝাপ্টাচ্ছে অনবরত, সেই সঙ্গে গাইছে সুরেলা কণ্ঠে। এমন গানের সুর আকুল করে তোলে মানুষের মন। বসন্তের বাতাসে তার মিষ্টি ও সুরেলা গানের সুরের মূর্ছনা ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। পাখিটি অনবরত ডেকে যাচ্ছে কয়েক মিনিট ধরে। একসময় গাইতে গাইতে সে ঘাসের মাঠে নেমে গেল। নামার গতির সঙ্গে সঙ্গে গানের সুরও নরম হতে থাকে। গানের শেষ পর্যায়ে প্যারাস্যুটের মতো ডানা মেলে ধরে ভূমিতে ল্যান্ড করে পাখিটি। ভূমিতে নামার পর হেঁটে হেঁটে ঘাসের মধ্যে পোকা খোঁজে। ঘাসের মাঠে ভরত পাখিটি হাঁটতে পারে। তবে বিপদ বুঝলে থেমে গিয়ে অনড় হয়ে বসে থাকে। বাংলার মেঠো ফসলের মাঠে, ঘাসের মাঠে হেঁটে বেড়ানো এ পাখিটির পোশাকী নাম ‘বাংলা ঝাড়ভরত’। তবে এরা গ্রাম-বাংলায় ভরত পাখি নামেই সর্বাধিক পরিচিত। পাখিটি তার গায়কীর জন্য বিখ্যাত। কবিরাও করেছেন ভরত পাখির জয়গান। 

ছেলেবেলায় ভরত পাখির বাসা খুঁজেছি। কিন্তু কখনোই খোঁজ পাইনি তাদের বাসার। বিশাল ঘাসের মাঠে বাসা খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তা ছাড়া ভরত পাখি বাসার কাছাকাছি পৌঁছে গেলেও হয়তো আমাদের দিকভ্রান্ত করে অন্যদিকে নিয়ে যেত আকাশে ডেকে ডেকে। কিছুটা হট্টিটি পাখির মতো কৌশলে। ছোট্ট এ পাখির দৈর্ঘ্য মাত্র ১৪ সেন্টিমিটার এবং ওজন ২৯ গ্রাম। পেট ও ডানার পালক লাল। বুকে কালচে তিলা থাকে এবং চোখের রং বাদামি। ভরত ছোট আকারের ভূচর গায়ক পাখি। বাংলাদেশে সাত প্রজাতির ভরত পাখি আছে, তার মধ্যে ‘বাংলা ঝাড়ভরত’ ও ‘বালি ভরত’ আমাদের আবাসিক পাখি। 

বাংলা ঝাড়ভরত পোকা শিকারি পাখি। প্রধানত আবাদি ভূমি, মুক্ত তৃণভূমি ও পতিত জমিতে বিচরণ করে। সচরাচর একা কিংবা জোড়া বেঁধে চলে এই পাখি। দেশের সব বিভাগের প্রত্যন্ত এলাকায় পাখিটি দেখা যায়। সিলেট ও সুনামগঞ্জের হাওরে শুষ্ক মৌসুমে গেলে চারদিকে এ পাখির গান শোনা যায়। বাংলা ঝাড়ভরতের ইংরেজি নাম ‘বেঙ্গল বুশলার্ক’। এই সুরেলাকণ্ঠী পাখিটি ভারতীয় উপমহাদেশ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ভুটান, মায়ানমার ও নেপালে দেখা যায়।

লেখক: নিসর্গী ও পরিবেশবিদ, জার্মান অ্যারোস্পেস সেন্টার

মনোহরি কালামাথা বুলবুল

প্রকাশ: ১৮ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯:৪৫ এএম
আপডেট: ১৮ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯:৪৬ এএম
মনোহরি কালামাথা বুলবুল
একজোড়া কালামাথা বুলবুল। সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান থেকে তোলা। ছবি: লেখক

গ্রীষ্মের তপ্ত রোদ। প্রকৃতিতে তেমন খুব বাতাস নেই। তবে সামান্য বাতাসে বনের মাঝে কখনো বৃক্ষের পাতাগুলো দুলে ওঠে। তখন কিছুটা শীতল অনুভব হয়। ছায়া থাকলেও গ্রীষ্মের সময় বনে হাঁটা কিন্তু কঠিন। অনেক সময়ই পাখি খোঁজার জন্য আমাদের কিছুটা জিরিয়ে নিতে হয়। একদিন রাঙামাটির কাপ্তাই বনে গ্রীষ্মের দুপুরে একটি গাছের ছায়াতে বসেছিলাম। এমন সময় একটি ফলের গাছে হলুদ-কালো মিশ্রণ বর্ণের একটি পাখি উড়ে এল। এর কিছুক্ষণ পর ঠোঁটে করে একটি পাকা ফল নিয়ে পাখিটি উড়ে গেল। কিছুক্ষণ বাদে সে আবার এল এবং পাকা ফল নিয়ে চলে গেল। নিশ্চিত হলাম যে, সে তার ছানার জন্য খাবার সংগ্রহ করছে। পাখিরা সাধারণত কোনো উৎস পেলে খাবারের জন্য সেই স্থানে বারবার আসে। সেই পাখিটি ছিল কালামাথা বুলবুল। সেই প্রথম, বনে আমার কালামাথা বুলবুল দেখা। তার জলপাই-হলুদ রঙের পালক এবং সৌন্দর্য প্রথম দেখায় আমার মন কেড়ে নিয়েছিল। তারপরে, ২০১৯ সালে সাতছড়ি উদ্যানে কয়েক জোড়া কালামাথা বুলবুল দেখেছিলাম। মূলত তারা ছোট একটি দলে ছিল। তারা একটি পত্রহীন বৃক্ষের শাখায় বসে সকালের রোদে পোহাচ্ছিল।

বাংলাদেশে ৯ প্রজাতির বুলবুল আছে। এর বেশির ভাগ প্রজাতিই চিরসবুজ বনে বাস করে। কালামাথা বুলবুল চিরসবুজ বন, বনের প্রান্তর এবং বনের কাছের ছোট ঝোপ এলাকায় বিচরণ করে। বুনো বৃক্ষ ও লতায় এরা ওড়ে এবং খাবার খোঁজে। 

তাদের খাদ্য তালিকায় আছে প্রধানত বনের রসালো ফল ও পোকামাকড়। এরা তীক্ষ্ণ এবং মোনহর সুরে ডাকে। ঊষা এবং গোধূলিতে শিস দিয়ে গান গায়। প্রজনন মৌসুম বাদে এরা সাধারণত ছোট ঝাঁকে চরে বেড়ায়। একটি ঝাঁকে ৬-৮টি বুলবুল থাকতে পারে।

১৭৮৮ সালে জার্মান প্রকৃতিবিদ জোহান ফ্রেডরিখ গেমেলিন এ পাখির প্রথম বর্ণনা করেছিলেন। কালামাথার বুলবুলের দৈর্ঘ্য ১৬-১৮ সেমি এবং ওজন ২০-৩০ গ্রাম হয়ে থাকে। এদের চকচকে নীল-কালো পালকের মাথাসহ সারা দেহ প্রধানত জলপাই-হলুদ পালকে আবৃত থাকে। এরা এপ্রিল-মে মাসে গাছের ডালে বাটির মতো বাসা বানিয়ে দুই-তিনটি ডিম পাড়ে। ডিমের রং ফিকে পাটকিলে। কালামাথা বুলবুল বাংলাদেশের দুর্লভ আবাসিক পাখি। সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের বনে এদের দেখা যায়। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, চীন এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে এদের বিস্তৃতি রয়েছে।

লেখক: নিসর্গী ও পরিবেশবিদ, জার্মান অ্যারোস্পেস সেন্টার

চাঁদের দেশের চন্দ্রমল্লিকা

প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১০:৩৮ এএম
চাঁদের দেশের চন্দ্রমল্লিকা
আগারগাঁও ফ্যালকন নার্সারিতে ফুটেছে চন্দ্রমল্লিকা ফুল। ছবি: লেখক

‘চন্দ্রমল্লিকা, চন্দ্রমল্লিকা
চাঁদের দেশের পথ-ভোলা ফুল চন্দ্রমল্লিকা। 
রঙ-পরীদের সঙ্গিনী তুই অঙ্গে চাঁদের রূপ-শিখা 
ঊষর ধরায় আসলি ভুলে তুষার দেশের রঙ্গিনী
হিমেল দেশের চন্দ্রিকা তুই শীত-শেষের বাসন্তিকা 
চাঁদের আলো চুরি ক’রে আনলি তুই মুঠি ভ’রে,
দিলাম চন্দ্র-মল্লিকা নাম তাই তোরে আদর ক’রে।’

কাজী নজরুল ইসলাম এ গানটি কবে লিখেছিলেন জানি না, তবে জানা যায় ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিলে এইচএমভি রেকর্ড কোম্পানি থেকে এ গানটির রেকর্ড বেরিয়েছিল, সুরকারও ছিলেন কবি নিজেই। সে সময় নজরুলের বয়স ছিল ৩৪ বছর ১০ মাস। গানটির মধ্যেই তিনি আদর করে চীনা ‘ক্রিসানথিমাম’ ফুলটির নাম দিয়েছিলেন ‘চন্দ্রমল্লিকা’।

সে বয়সে তিনি চন্দ্রমল্লিকার রূপ-রসে মুগ্ধ হয়ে কল্পলোকে ঘুরেছেন চাঁদের দেশে। চন্দ্রমল্লিকা ফুলের রূপকে তিনি তুলনা করেছেন চাঁদের শিখার সঙ্গে, যার সঙ্গিনী রঙ-পরীরা। চন্দ্রমল্লিকা যেন চাঁদের আলো মুঠো ভরে চুরি করে এনে নিজের দেহে ছড়িয়ে দিয়েছে। শীতে ফোটা ফুলগুলো যেন শীতকালেই পুষ্পোচ্ছ্বাসে টেনে এনেছে বসন্তের পুষ্পশোভা। সত্যিই চন্দ্রমল্লিকার ফুলের এরূপ দীর্ঘস্থায়ী প্রস্ফূরণের প্রাচুর্য খুব কম ফুলেরই আছে। এ দেশে শীতকাল আলো করে যে কয়েকটি ফুল, চন্দ্রমল্লিকা সেগুলোর মধ্যে সেরা।

চন্দ্রমল্লিকার আদি নিবাস চীনে হলেও তার শ্রীবৃদ্ধি ও বিকাশ বেশি ঘটেছে জাপানে। বিখ্যাত চীনা দার্শনিক কনফুসিয়াসের লেখা থেকে জানা যায়, প্রায় ৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে চীনে চন্দ্রমল্লিকা চাষ হতো ঔষধি গাছ হিসেবে। জানা যায়, ১৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে চীনে চন্দ্রমল্লিকা সপুষ্পক হার্ব হিসেবে বাগানে লাগানো হতো। ভারতবর্ষ ও আমাদের দেশে ঠিক কখন-কীভাবে চন্দ্রমল্লিকা ফুল এল, তার সঠিক কোনো ইতিহাস পাওয়া না গেলেও ১২৯০ খ্রিষ্টাব্দে শান্ত জ্ঞানেশ্বর রচিত মারাঠি ভাষার ‘জ্ঞানেশ্বরী’ গ্রন্থে চন্দ্রমল্লিকা ফুলের উল্লেখ পাওয়া যায়। বিভিন্ন হিন্দি গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে যে ষোড়শ শতকে মোগল আমলে ভারতবর্ষে চন্দ্রমল্লিকা ফুলের চাষ শুরু হয়, সপ্তদশ শতকে চন্দ্রমল্লিকা প্রবেশ করে ইউরোপে। সারা বিশ্বে চন্দ্রমল্লিকা ফুল এখন সুখ, ভালোবাসা, আনন্দ, দীর্ঘজীবন, চিরবিদায় ও রাজকীয়তার প্রতীক।

চন্দ্রমল্লিকা ফুলের ইংরেজি নাম ক্রিসানথিমাম, নামটি দুটি প্রাচীন গ্রিক শব্দ থেকে উদ্ভূত। ‘ক্রিয়স’ অর্থ সোনালি ও ‘অ্যান্থিমন’ অর্থ ফুল; এর অর্থ সোনালি ফুল। আদিকালে চন্দ্রমল্লিকার হয়তো শুধু সে রূপই ছিল। ১৭৫৩ খ্রিষ্টাব্দে লিনিয়াস প্রথম এ ফুলের মহাজাতির নামকরণ করেন Chrysanthemum, তখন তার প্রজাতি সংখ্যা ছিল মাত্র ১৪টি। সারা পৃথিবীতে ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে চন্দ্রমল্লিকার প্রজাতিসংখ্যা পাওয়া যায় ৪২টি। ভারতবর্ষে চাষ হওয়া চন্দ্রমল্লিকার দেশীয় আদি প্রজাতিটি হলো Chrysanthemum indicum, এ প্রজাতির ফুলের রং প্রধানত সোনালি-হলুদ। চন্দ্রমল্লিকা একটি বহুবর্ষজীবী ও বহুশাখায়িত বিরুৎ শ্রেণির উদ্ভিদ। গাছ ৫০ থেকে ১০০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। পাতার কিনারা গভীরভাবে খাঁজকাটা। ডালের মাথায় অনেকগুলো ফুল ফোটে শীতকালে। ফোটার পর ফুলগুলো বেশ কয়েক দিন থাকে। চন্দ্রমল্লিকা বাগানে ও টবে লাগানো যায়।

১৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে সারা পৃথিবীতে চন্দ্রমল্লিকার নথিভুক্ত প্রজাতির সংখ্যা ছিল ৫০০টির বেশি। বর্তমানে সারা পৃথিবীতে ২০ হাজারের বেশি জাত রয়েছে। নানা আকারের, আকৃতির, চেহারার ও রঙের চন্দ্রমল্লিকা ফুল এখন বাংলাদেশেও বিভিন্ন বাগানে, বাড়িতে ও নার্সারিতে দেখা যাচ্ছে। হলুদ ও সাদা ফুলের চন্দ্রমল্লিকা ফুলগুলো দেখতে বেশ সুন্দর।  তবে ফুলটি লাল, গোলাপি, কমলা, খয়েরি, মেরুন, সোনালি, বেগুনি, হলুদ, মিশ্র বর্ণের প্রায় সব রঙের হয়। এমনকি মালয়েশিয়ায় গিয়ে সবুজ রঙের চন্দ্রমল্লিকাও দেখেছি। সব রঙের ফুলই ফোটে শীতকালে। অক্টোবরে গাছগুলোয় কুঁড়ি আসে, নভেম্বর-ডিসেম্বর থেকে ফুল ফুটতে শুরু করে। বসন্ত পর্যন্ত কোনো কোনো গাছে ফুল ফুটতে দেখা যায়। অন্য ফুলের সঙ্গে এর মূল পার্থক্যটা হলো, চন্দ্রমল্লিকার ফুল ফোটার পরও বহুদিন, এমনকি এক মাস পর্যন্ত সজীব থাকে। তাই কাট ফ্লাওয়ার হিসেবে ফুলদানির জন্য উত্তম।

জলবসা মাটি চন্দ্রমল্লিকাগাছ মোটেই সইতে পারে না। বীজ, শাখা কলম ও সাকার থেকে চন্দ্রমল্লিকার চারা তৈরি করা যায়। সম্প্রতি সাভারের বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের প্ল্যান্ট বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ডিভিশন টিস্যু কালচার পদ্ধতিতে চন্দ্রমল্লিকার চারা তৈরির প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। গাজীপুরের বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট চন্দ্রমল্লিকার ‘বারি চন্দ্রমল্লিকা ১’ ও ‘বারি চন্দ্রমল্লিকা ২’ নামে দুটি উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছে।

চন্দ্রমল্লিকা ফুলের কথা লিখতে গিয়ে শেষে হঠাৎ তারাপদ রায়ের ভুল কবিতাটির কয়েকটা লাইন মনে পড়ল- ‘কোনটা যে চন্দ্রমল্লিকার ফুল/আর কোনটা যে সূর্যমুখী/বারবার দেখেও/আমার ভুল হয়ে যায়/আমি আলাদা করতে পারি না।’ চন্দ্রমল্লিকা ফুলের মাঝখানে একটি ছোট্ট চাকতি, সে চাকতি থেকে চারদিকে রশ্মির মতো ছড়ানো পাঁপড়ি। এমন চেহারা আছে তো জারবেরা, অ্যাস্টার, টিথোনিয়া, জিনিয়া, গাজানিয়া ও সূর্যমুখী ফুলেরও। পাশাপাশি না রেখে এসব ফুল দেখলে ভুল তো হতেই পারে!

কাঁকড়ার খাদ্য উদ্ভাবনে সফলতা

প্রকাশ: ১৬ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯:৩৩ এএম
আপডেট: ১৬ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯:৩৪ এএম
কাঁকড়ার খাদ্য উদ্ভাবনে সফলতা
ঘেরে বা খাঁচায় চাষ করা কাঁকড়ার খাবার পর্যবেক্ষণ করছে নোবিপ্রবির ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন সায়েন্স বিভাগের গবেষক দল। ছবি-সংগৃহীত

বাংলাদেশে কাঁকড়া উৎপাদনের ক্ষেত্রে চাষিদের দুই কারণে প্রকৃতির ওপর নির্ভর করতে হয়। একটি হলো কাঁকড়ার খাবার এবং অন্যটি কাঁকড়ার পোনা। উন্মুক্ত জলাশয়ে কাঁকড়া প্রকৃতিতে মাছজাতীয় যে খাবার পায় তা খেয়ে বেঁচে থাকে। আবার ঘেরে বা খাঁচায় চাষ করা কাঁকড়াগুলোকে স্বল্পমূল্যের শামুক, তেলাপিয়া ও সাগরের অন্যান্য মাছ খাবার হিসেবে দেওয়া হয়। কিন্তু খাবার হিসেবে মাছের ব্যবহার, সংগ্রহ ও সংরক্ষণ কষ্টসাধ্য। এতে করে প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীলতা ক্রমেই বাড়ছে।

প্রাকৃতিক উপায়ে অতিমাত্রায় খাবার ও পোনা সংগ্রহের দরুন প্রকৃতিতে বৈষম্যের জন্য বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এ সংকট নিরসনে তথা উৎপাদন বৃদ্ধিতে ঘেরে বা খাঁচায় চাষ করা কাঁকড়ার জন্য সম্পূরক খাবার দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। কী হতে পারে সে খাবার? এর অনুসন্ধান করতেই গবেষণা শুরু করেন নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (নোবিপ্রবি) একদল গবেষক।

কাঁকড়ার জন্য নতুন সম্পূরক খাবার তৈরির উদ্যোগ নেন তারা। দেশে প্রথমবারের মতো কাঁকড়ার এ সম্পূরক খাবার উদ্ভাবনে সফলতা পান নোবিপ্রবির ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ আল মামুন ও তার দল। নতুন উদ্ভাবিত খাবার নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামানুসারে রাখা হয় ‘এনএসটিইউ ক্র্যাব ফিড’। দেশের বাইরে অস্ট্রেলিয়া ও ভিয়েতনামে কাঁকড়ার এ ধরনের খাবারের প্রচলন থাকলেও বাংলাদেশে এটাই প্রথম। বিভিন্ন আকারের কাঁকড়ার জন্য খাওয়ার উপযোগী করে তৈরি করা হয়েছে ৪৫ শতাংশ প্রোটিনসমৃদ্ধ এই খাবার। ঘেরে কিংবা খাঁচায় বেড়ে ওঠা কাঁকড়াদের খাবার হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে এটি। এতে করে চাষিদের প্রকৃতি-নির্ভরতা অনেকটা কমেছে। পাশাপাশি বেড়েছে কাঁকড়ার উৎপাদন ও রপ্তানি।

গবেষক দলের প্রধান অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ আল মামুন জানান, ২০১৪ সাল থেকে ছোট-বড় সাইজের নরম খোলসযুক্ত (সফট শেল) কাঁকড়া হিমায়িত করে বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। যার দরুন প্রকৃতিতে এর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে এবং নষ্ট হতে শুরু করেছে ইকোসিস্টেম। ছোট ছোট কাঁকড়াও রেহাই পাচ্ছে না রপ্তানি থেকে। এই পরিস্থিতি বিবেচনায় ২০২২ সালে মৎস্য অধিদপ্তরের আওতায় ‘সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ’ প্রকল্পের আর্থিক সহযোগিতা নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম শুরু করেন তিনি। এতে গবেষণা সহযোগী হিসেবে গ্লোন অ্যাগ্রোভেট, ইরওয়ান ট্রেডিং কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়কে সংযুক্ত করা হয়।

গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, ঘেরে ও খাঁচায় কাঁকড়া চাষ সম্ভব এবং এদের সম্পূরক খাবার দিলে কাঙ্ক্ষিত পুষ্টিগুণও পাওয়া যায়। তাই বর্তমানে চাষিরা প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল না হয়ে সম্পূরক খাবারের মাধ্যমে কাঁকড়া উৎপাদনে আগ্রহী হচ্ছেন। নতুন উদ্ভাবিত খাবার কাঁকড়ার জন্য একটি উপযোগী খাবার হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।

গবেষক ড. মামুন জানান, গবেষণার শুরুর দিকে কক্সবাজারে কাঁকড়ার প্রচলিত খাদ্যব্যবস্থা সম্পর্কে একটি গবেষণা পরিচালনা করা হয়। পরবর্তী সময়ে বৃহৎ পরিসরে কক্সবাজার ও সাতক্ষীরার ৮০ জন চাষিকে নির্বাচন করা হয়। নির্বাচিত চাষিদের হ্যাচারির কাঁকড়ার পোনা, সম্পূরক খাবার ও কারিগরি সহায়তা দেওয়া হয়। তাদের মাধ্যমে ঘেরে ও খাঁচায় উৎপাদিত কাঁকড়ার খাবারের বিভিন্ন দিক পর্যবেক্ষণ করা হয়। পাশাপাশি মা কাঁকড়ার লালন, স্বজাতি ভক্ষণ প্রতিরোধে শেল্টার ব্যবহারকরণ, মজুত ঘনত্ব ইত্যাদি নিরীক্ষণ করা হয়। বর্তমানে একই বিভাগের সাতজন শিক্ষার্থী স্নাতকোত্তর পর্যায়ে কাঁকড়ার আরও বিভিন্ন দিক নিয়ে গবেষণায় নিয়োজিত রয়েছেন। তারা শস্য বহুমুখীকরণ অর্থাৎ ‘কাঁকড়া, চিংড়ি ও সাদা মাছের পলিকালচার’ নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। এ ক্ষেত্রে গবেষক দল বিভিন্ন উদ্যোক্তা, হ্যাচারি মানিক, ফিড ইন্ডাস্ট্রিসহ সংশ্লিষ্টদের কারিগরি সহায়তা দেওয়ার জন্য উন্মুক্ত, যা মৎস্য খাতকে গতিশীল করবে।

লেখক পরিচিতি: সহকারী পরিচালক (তথ্য ও জনসংযোগ), নোবিপ্রবি।

ভেষজ উদ্ভিদ মটকিলা

প্রকাশ: ১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১১:৩২ এএম
ভেষজ উদ্ভিদ মটকিলা
ময়মনসিংহের তারাকান্দায় কলেজ রোড এলাকার মটকিলা গাছ। ছবি: লেখক

গ্রামে আত্মীয়বাড়ি বেড়াতে গেছেন, টুথব্রাশ বা টুথপেস্ট নিয়ে যাননি। সকালে উঠে বাড়ির পেছন থেকে মটকিলার ডাল ভেঙে মুখে একটু চিবিয়ে থেঁতলে নিয়ে দাঁত ব্রাশ করে ফেললেন। অনেকের এই অভিজ্ঞতা রয়েছে। ছোটবেলায় বাড়ির পেছনে, বনের ধারে মটকিলা গাছে পাকা ফল খুঁজে বেড়িয়েছি অন্য বাচ্চাদের মতো আমিও। গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর ময়মনসিংহ জেলার তারাকান্দার কলেজ রোড এলাকায় রাংসা নদীর ধারে মটকিলা গাছের দেখা পেলাম।

মটকিলা কাষ্ঠল, গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ। এটি উচ্চতায় এক থেকে পাঁচ মিটার হয়। এর অন্যান্য বাংলা নাম আঁশশেওড়া, কওয়াটুটি, মটমটি ইত্যাদি। এর বৈজ্ঞানিক নাম Glycosmis Pentaphylla, এটি Rutaceae পরিবারের উদ্ভিদ। এই উদ্ভিদ ইংরেজিতে Orange berry, Gin berry, Toothbrush plant, Motar tree ইত্যাদি নামে পরিচিত। এই উদ্ভিদ মারমাদের কাছে ‘তাতিয়াং’, চাকমাদের কাছে ‘হতিজ্ঞিরা’, গারোদের কাছে ‘মোয়াতন’ নামে পরিচিত।

দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ফিলিপিন্স, দক্ষিণ চীন, ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, জাভা, সুমাত্রা, বোর্নিও এবং অস্ট্রেলিয়ায় পাওয়া যায় এই উদ্ভিদ।

মটকিলার কিছু কিছু গাছ ৬ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। কাণ্ড বেশ শক্ত এবং রং ধূসর। কাণ্ডের দেড় থেকে ২ ফুট পর্যন্ত কোনো ডালপালা হয় না বললেই চলে। কাণ্ডের বেড় দেড় থেকে আড়াই ইঞ্চি পর্যন্ত হয়। পাতার রং সবুজ। পাতা একপক্ষল, উপবৃত্তাকার, দৈঘ্য ৩-৪ ইঞ্চি। মাঝ বরাবর এর প্রস্থ ২-২.৫ ইঞ্চি। পাতা পাতলা, মসৃণ। মটকিলার ফুল খুব ছোট। ফুলের রং সবুজাভ সাদা। ফুলের ব্যাস ৫-৭ মিলিমিটার। প্রতি ফুলে পাঁচটি করে পাঁপড়ি থাকে। এর ফুল হালকা মিষ্টি গন্ধযুক্ত। পাতা দেখতে লেবু পাতার মতো। 

আসলে লেবু, কমলা, জাম্বুরা আর মটকিলা একই গোত্রের, তাই এই মিল। ফল সবুজ রঙের, মটর দানার চেয়ে সামান্য বড়। একটি গুচ্ছে ২০-৫০টি পর্যন্ত ফল থাকে। কাঁচা ফলের রং সবুজ। পাকা ফলের রং গাঢ় গোলাপি, গোলাকার। ফল রসাল, বেশ মিষ্টি। তবে ফলে সামান্য তেতোভাব আছে। পাখি ও শিশুদের প্রিয় এই ফল। মটকিলার ফলের ভেতর দ্বিবীজপত্রী গোলাকার বীজ থাকে। মটকিলার চারা জন্মায় বীজ থেকে। 

মটকিলা বেশ কয়েক বছর বাঁচে। প্রায় ৫ থেকে ৭ বছর পর্যন্ত বাঁচে। পানি পেলে সারা বছর জন্মায়। বাংলাদেশের সর্বত্র এদের দেখা মেলে। এরা যেকোনো পরিবেশে সহজেই অভিযোজিত হতে পারে। রাস্তার দুই ধারে, জমির আইলে, বাড়ির পেছনে, পুরোনো দালানের ইটের খাঁজে, পুকুরপাড়ে, নদীর ধারে, ঘন ঝোপের আড়ালে প্রায় সব জায়গাতেই জন্মাতে ও বেড়ে উঠতে পারে এরা। 

লিভারের সমস্যা, কাশি, জন্ডিস, বাত, রক্তশূন্যতা ইত্যাদি রোগের চিকিৎসায় এ উদ্ভিদের ব্যবহার দেখা যায়। গ্রামের মানুষ এ গাছের ডাল দাঁত মাজার কাজে ব্যবহার করে। মটকিলার পাতা আদার সঙ্গে মিশিয়ে মণ্ড তৈরি করা হয়, যা চর্মরোগের উপশমে ব্যবহৃত হয়। গাছের মূল সেদ্ধ করে তৈরি করা হয় এক ধরনের ক্বাথ, যা মুখমণ্ডলের প্রদাহের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। 

লেখক: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ, মুমিনুন্নিসা সরকারি মহিলা কলেজ, ময়মনসিংহ।

চট্টগ্রামে সৌন্দর্য-সুবাসে মুগ্ধ দর্শনার্থীরা

প্রকাশ: ১৩ জানুয়ারি ২০২৫, ০৮:৫৪ এএম
আপডেট: ১৩ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯:৩৩ এএম
চট্টগ্রামে সৌন্দর্য-সুবাসে মুগ্ধ দর্শনার্থীরা
ফুলে ফুলে সাজানো হয়েছে চট্টগ্রামের ডিসি পার্ক। ছবি: খবরের কাগজ

চারপাশে শুধু ফুল আর ফুল। লাল, নীল, হলুদ, সাদা, গোলাপিসহ নানা রঙের ফুলের সুগন্ধ ও সৌন্দর্যে ছেয়ে গেছে পার্কের পুরো এলাকা। আর এ সৌন্দর্য দেখতে ভিড় জমাচ্ছেন হাজার হাজার দর্শনার্থী। বলা হচ্ছে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের সলিমপুর ইউনিয়নের ফৌজদারহাটে ডিসি পার্কে আয়োজিত ফুল উৎসবের কথা।

এ বছর ডিসি পার্কে তৃতীয়বারের মতো আয়োজন করা হয়েছে ফুল উৎসব। ৩ জানুয়ারি  শুরু হয় এ উৎসব। মাসব্যাপী এ আয়োজনে প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত পার্ক দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকছে। আগামী ৪ ফেব্রুয়ারি এ উৎসব শেষ হবে। এবার প্রত্যেক দর্শনার্থীর পার্কে প্রবেশের জন্য ৫০ টাকা ফি নির্ধারণ করা হয়েছে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, পার্কের ভেতরে জোড়া পুকুরের পশ্চিম পাশে মূলত ফুল উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। সে স্থান সাজানো হয়েছে লাখের বেশি ফুলের চারা দিয়ে। দেশি-বিদেশি ১৩৬ প্রজাতির ফুল রয়েছে এখানে। দেশি ফুলের মধ্যে রয়েছে ১৫ প্রজাতির গাঁদা, জবা, কৃষ্ণচূড়া, চন্দ্রমল্লিকাসহ বিভিন্ন ফুল।

উৎসবে যেসব ফুল রাখা হয়েছে তার বেশির ভাগই শীতকালীন বিদেশি প্রজাতির। বিদেশি ফুলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ২৫ ধরনের গোলাপ, স্টকস, গ্যাজানিয়া, ক্যামেলিয়া, হলিহক, স্নেক, নেসটিয়াম, লিলিয়াম, ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, ম্যাগনোলিয়া, চেরি, জারবেরা, উইলো, উইস্টেরিয়া, কনকাম্বরি, হাইব্রিড জবাসহ আরও শতাধিক জাতের ফুল।

ফুলের সৌন্দর্য উপভোগের পাশাপাশি এখানে মিলছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী বাহারি রকমের পিঠা-পুলিসহ নানান খাবারের স্বাদ। আছে শিশুদের জন্য আলাদা কিডস জোন।

উৎসবে প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। স্থানীয় গায়কদের পাশাপাশি সারা দেশের শিল্পীরা এখানে অংশগ্রহণ করছেন। গত বছর উৎসবটি ১৫ দিনব্যাপী হলেও এ বছর তা বাড়িয়ে ৩০ দিন করা হয়েছে।

প্রতিদিন শিক্ষক-শিক্ষার্থী, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার কর্মকর্তা-কর্মচারী, বন্ধুবান্ধবসহ অনেকে পরিবার-পরিজন নিয়ে এ সৌন্দর্য দারুণভাবে উপভোগ করছেন। ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকেও দর্শনার্থীরা ছুটে আসছেন। এভাবেই সাগরপাড়ের জেলাতে সুবাস ছড়াচ্ছে ডিসি পার্কের ফুলের বাগান।

ডিসি পার্কে কথা হয় চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলা থেকে আসা পাঁচ বন্ধুর সঙ্গে। তারা বলেন, ‘পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত ও টানেল দেখতে এসেছিলাম। সেখান থেকে ডিসি পার্কে এসেছি। এখানে ব্যাপক আয়োজন দেখে অবাক হয়েছি। পুরো পার্কটা ফুলে ফুলে সজ্জিত। ফুলের রাজ্যে অন্য রকম ভালো লাগছে।’

সীতাকুণ্ড থেকে আসা ওমরগনি এমইএস কলেজের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান মুনমুন বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম (ফেসবুক) এবং বেশ কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের বরাতে ডিসি পার্কের ফুলের ছবি দেখে কৌতূহলী হয়ে উঠি। তাই নিজ চোখে দেখতে এলাম। এখানে এসে দেখার পর সত্যি লাখো রঙিন ফুলের সুবাসে আমি বিমোহিত হয়েছি। আমরা গত বছরও এ পার্কে এসেছিলাম। সন্ধ্যার পর ভাবলাম ভিড় কম হবে। কিন্তু দিনের চেয়ে সন্ধ্যার পর বেশি মানুষ এসেছে।’

চট্টগ্রাম নগরীর চকবাজার এলাকা থেকে পরিবার নিয়ে বেড়াতে এসেছেন ব্যাংকার জাহিদ হাসান। তিনি বলেন, ‘আমি ডিসি পার্কে প্রথমবার এসেছি। পার্কের বেশির ভাগ ফুল বিদেশি প্রজাতির, যা আগে কখনো দেখিনি। তাই তো ফুলের সৌন্দর্য দেখে আমরা মুগ্ধ হয়েছি। পাশাপাশি গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী হরেক রকমের খাবার রয়েছে। শিশুদের জন্য বিনোদনের নানা ব্যবস্থা থাকায় বাড়তি আনন্দ যোগ হয়েছে। এমন মনোমুগ্ধকর আয়োজনের জন্য জেলা প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানাই।’

গত শুক্রবার (১০ জানুয়ারি) বিকেলে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে ফুলের উৎসব ঘিরে ডিসি পার্কে মানুষের ব্যাপক ভিড় দেখা গেছে। সকাল থেকেই দর্শনার্থীরা আসতে শুরু করেন। সন্ধ্যাবেলায় এত মানুষ আসে যে মানুষকে ঢোকার জন্য দীর্ঘ সময় ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। একজন বের হলে অন্যজন ঢোকার সুযোগ পায় এমন অবস্থা। ভেতরে লোকজনের চাপে হাজার হাজার দর্শনার্থী পার্কের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
 
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আনসার সদস্যরা বলেন, শুক্রবার ডিসি পার্কে লাখের ওপরে দর্শনার্থী আসায় বাড়তি চাপে পড়তে হয়। এতে করে দর্শনার্থীদের শৃঙ্খলায় রাখতে হিমশিম খেতে হয়েছে। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন অনেকেই। এ ছাড়া টিকিট নিয়ে আবার অনেকে টিকিট না নিয়েই দেয়াল টপকে ভেতরে প্রবেশ করেছেন। এ সময় বাধা দিলে নিরাপত্তাকর্মীদের সঙ্গে বিবাদে জড়ান অনেকে। অনেকে চেয়ারের ওপরে উঠে নাচানাচি করেছেন। অতিথিদের চেয়ার নিয়েও টানাটানি করেন অনেকে। পার্কে প্রতিদিন ২০-২৫ হাজার দর্শনার্থী আসেন। কিন্তু শুক্রবার ছুটির দিন হওয়ায় এক লাখের মতো মানুষে এসেছে পার্কে। এতে চরম বেকায়দায় পড়তে হয়।

সিনিয়র সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আলাউদ্দিন মুঠোফোনে বলেন, ‘গত শুক্রবার দুপুরের পর থেকে ৫০ হাজারের বেশি মানুষ টিকিট নিয়ে প্রবেশ করলেও সন্ধ্যার পর অনুষ্ঠান চলাকালে প্রায় লাখো মানুষের সমাগম হয়। এ সময় জেলা প্রশাসনের প্রস্তুতির চেয়ে বেশি দর্শক এসেছে। অনুষ্ঠান চলাকালে অতিথিদের চেয়ার দখল করে উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করায় কিছুটা বিড়ম্বনা তৈরি হয়। পরে মাইকিং করে দর্শকদের বুঝিয়ে শান্ত করে পুনরায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিচালনা করা হয়।’

জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম বলেন, ‘চট্টগ্রাম শহর থেকে পযর্টকদের আসা-যাওয়ার সুবিধার্থে শাটল বাস সার্ভিস চালু করা হয়েছে। এটি টাইগার পাস থেকে পতেঙ্গা হয়ে ডিসি পার্কে দর্শনার্থীদের নিয়ে আসবে। আবার একই রুট হয়ে গাড়ি টাইগার পাস ফিরে যাবে। এ ছাড়া এখানে দর্শনার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত টয়লেট ও পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে। চট্টগ্রামবাসীসহ সারা দেশের মানুষকে আহ্বান জানাচ্ছি এখানে এসে এ ফুল উৎসবকে উপভোগ করার জন্য।’

তিনি জানান, এবারের ফুল উৎসবে বেশ কিছু নতুনত্ব রয়েছে। ১২টি দোকান নিয়ে গ্রামীণ মেলা বসবে, যা আগে ছিল না। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি মাল্টিকালচারাল ফেস্টিভ্যাল, বই উৎসব, ঘুড়ি উৎসব, ফুলের সাজে একদিন, পিঠা উৎসব, লেজার লাইট শো, ভিআর গেইম, মুভি শো, ভায়োলিন শো, পুতুলনাচসহ নানা রকমের আয়োজন।