বাংলা সাহিত্যের কোথায় না দোলনচাঁপা আছে? জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থের নামটাই ছিল দোলনচাঁপা, আজ থেকে ১০১ বছর আগে সেটি প্রকাশিত হয় কলকাতার আর্য পাবলিশিং হাউস থেকে। শরৎ-হেমন্তের বৃষ্টি আর শিশিরে ভেজা দোলনচাঁপার শুভ্র-স্নিগ্ধ রূপ আর সুগন্ধ প্রকৃতিমনাদের যেমন বিমোহিত করে, তেমনি প্রেমিকদের করে ব্যথিত। কাজী নজরুল ইসলামের অভিশাপ কবিতায় দোলনচাঁপা ফুটে আছে সেই ব্যথার ফুল হয়ে- ‘ফুটবে আবার দোলন চাঁপা চৈতী-রাতের চাঁদনী, আকাশ-ছাওয়া তারায় তারায় বাজবে আমার কাঁদ্নী।’ দোলনচাঁপা ফুলগুলো যেন জ্যোৎস্নাধোয়া বিধবার সাদা শাড়ি পরা কোনো বিরহী প্রেমিকা, যার নিশ্বাসে মেখে আছে বিরহের আতরগন্ধ। ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি দোলনচাঁপা ফুলের সেই সাদা স্বরূপ। হঠাৎ দেখলাম এক বাগানে ফুটেছে গোলাপি রঙের দোলনচাঁপা।
কয়েক দিন আগে মানিকগঞ্জের হরিরামপুরের সুলতানপুর গ্রামে গিয়েছিলাম। সেখানে তরুরসিক তানভীর আহমেদের বাগানে গিয়ে চিরচেনা বিধবা দোলনচাঁপাকে দেখলাম বর্ণিল সাজে। যেন সে হঠাৎ করে কোনো জাদুর ছোঁয়ায় পেয়ে গেছে প্রেমের রং। গোলাপি পাঁপড়িগুলো যেন প্রজাপতির মতো ডানা মেলে উড়তে চাইছে নীল আকাশে। প্রথম দেখাতেই মুগ্ধতা, কেননা বিরল রঙে রাঙানো এই দোলনচাঁপা আমাদের দেশে এসেছে বিদেশ থেকে অতিথি হয়ে। তানভীর বললেন, ২০১৬ সালে তিনি নেটে এই গোলাপি দোলনচাঁপার ছবি দেখে তার খোঁজ শুরু করেন। নানা দেশ ও স্থান থেকে নতুন নতুন গাছপালা সংগ্রহ করা তার নেশা। খুঁজতে খুঁজতে তিনি থাইল্যান্ড থেকে এই গোলাপি রঙের দোলনচাঁপাসহ ১০ জাতের দোলনচাঁপা সংগ্রহ করেন। এর মধ্যে সোনালি হলুদ ফুলের জাতটিও চমৎকার! তার সংগ্রহে ছিল লাল দোলনচাঁপার জাতটিও। দুর্ভাগ্য যে সে গাছটি চুরি হয়ে গেছে। তার পরও তিনি দমে যাননি। তার বাগানে বর্তমানে প্রায় ২০০ প্রজাতির প্রায় সাড়ে ৭০০ গাছ রয়েছে। এর মধ্যে তার সংগ্রহে আছে প্রায় ৪০ জাতের বাহারি কচু ও ৫০ জাতের জলজ ফুলগাছ। তবে এই গোলাপি দোলনচাঁপা তার কাছে অত্যন্ত প্রিয়। যেমন এর রং, তেমনি মিষ্টি সুগন্ধ।
আফসোস যে তানভীর আহমেদের বাগানে গিয়ে যখন সেই দুই ঝাড় গোলাপি দোলনচাঁপা ফুলগাছের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম, তখন তার যৌবন ঢলে গেছে। হেমন্ত শেষে ফুল ফোটাও শেষের পথে। কয়েকটা গোলাপিরঙা দোলনচাঁপা ফুল কেবল সে গাছের সাক্ষ্য হয়ে আছে। শীতে সেসব গাছে আর ফুল ফুটবে না, অনেক ফোটা ফুল শুকিয়ে গেছে, গাছও মরে যাবে। পরের বর্ষায় সেসব গাছ আবার ঝোপালো ও তাগড়া হয়ে বর্ষা থেকে হেমন্ত পর্যন্ত ফুল দেবে।
গোলাপি দোলনচাঁপা গাছ দেখতে অনেকটা আদাগাছের মতো, গাছ দেখতে হুবহু সাদা দোলনচাঁপা গাছের মতোই। এ গাছ প্রায় ৯০ থেকে ১২০ সেন্টিমিটার লম্বা হয়, ঝোপ দেখতে বেশ সুন্দর। এর ফুল বড় আকারের ধবধবে সাদা এবং মিষ্টি সুগন্ধযুক্ত। গাছ যখন বেশ ঝাড়ালো হয়, তখন প্রতিটি গাছ থেকে ডাঁটির মাথায় অনেকগুলো ফুল ফোটে। দোলনচাঁপা প্রধানত বর্ষা ও শরৎকালের ফুল, বিকেলের দিকে ফুল ফোটে এবং সারা রাত বহুদূর থেকেও ফুলের মধুর গন্ধ পাওয়া যায়। শীতকালে মাটির ওপরে গাছ যখন শুকিয়ে যায়, তখন এর কন্দ বা রাইজোম তুলে সংরক্ষণ করা যায় অথবা মাটির নিচেই রেখে দেওয়া যায়। প্রতিবছর নতুন নতুন জায়গায় গাছ রোপণ করা ভালো। দোলনচাঁপা চাষের জন্য বেশি পানির দরকার হয়। তাই রোপণের পর নিয়মিত পানির ব্যবস্থা করতে হয়। এ গাছ আবার অতিরিক্ত পানি বা জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না।
সাধারণত জুলাই থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত ফুল ফোটে, তবে নভেম্বরের শেষ পর্যন্তও এর কিছু ফুল দেখা যায়। দোলনচাঁপার আদি নিবাস ভারতবর্ষ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও মাদাগাস্কার। আদাগোত্রীয় গাছ, গোত্র জিঞ্জিবারেসি। দোলনচাঁপার ইংরেজি নাম বাটারফ্লাই লিলি বা জিঞ্জার লিলি। দোলনচাঁপা হেডিকিয়াম গণের একটি গাছ। সারা পৃথিবীতে হেডিকিয়াম গণের ৭০ থেকে ৮০টি প্রজাতির গাছ আছে, বাংলাদেশে এ গণের আছে ১৫ প্রজাতির গাছ। ধবধবে সাদা ফুলের প্রজাতি হলো Hedychium coronarium, হলুদাভ সাদা রঙের ফুলের প্রজাতি Hedychium flavum, যার নাম রাঙা আদা। এ দেশে লাল বা গোলাপি ফুলের দোলনচাঁপার মতো ফুল লাল বা কমলা রঙের ফুল ফোটে ভুঁই আদাগাছেও, তার প্রজাতি Hedychium coccineum. লাল, কমলা ও গোলাপিরঙা দোলনচাঁপার আদি নিবাস দক্ষিণ চীন।