শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে জলাশয়ের পানিতে ভেসে থাকা শাপলা পাতার ওপর অতিথি পাখির জলকেলি, তাদের দলবেঁধে উড়ে যাওয়া ও মনোমুগ্ধকর কিচিরমিচির শব্দ— শীতকালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লেক ও জলাশয়ের চিত্র এমনই দেখা যেত। কিন্তু এখন যেন সম্পূর্ণ উল্টো চিত্র। জাবিতে কমতে শুরু করেছে অতিথি পাখির সংখ্যা।
গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশ হওয়ায় শীতকালে দেশের বিভিন্ন জেলায় শীতপ্রধান দেশগুলো থেকে অতিথি পাখিরা আসত। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৬ সালে জাবির লেকগুলোতে প্রথমবারের মতো অতিথি পাখি আসে। এরপর ২০১৪ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে অতিথি পাখির অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করে তৎকালীন সরকার।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরোনো প্রশাসনিক ভবন-সংলগ্ন লেক, বন্যপ্রাণী উদ্ধার কেন্দ্র (ওয়ালইড লাইফ রেসকিউ সেন্টার), জাহানারা ইমাম ও প্রীতিলতা হল-সংলগ্ন লেক ও পরিবহন চত্বরের পেছনের লেকগুলো অতিথি পাখির মূল অভয়ারণ্য। এখন লেকগুলোতে পাখির কিচিরমিচির শব্দে মুখর ক্যাম্পাস। তবে দুই-তিন বছর আগের তুলনায় তা আশঙ্কাজনক হারে কমেছে।
অতিথি পাখি আসার আগে তাদের সুস্থ ও সুন্দর আবাসস্থল নিশ্চিত করতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিজ দায়িত্বে অতিথি পাখির অভয়ারণ্য হিসেবে পরিচিত লেকগুলো পরিষ্কার করে থাকে। তাদের নিরাপদ আশ্রয় নিশ্চিতে প্রশাসন ও বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন ক্যাম্পাসজুড়ে বিভিন্ন সচেতনতা ও তথ্যমূলক ব্যানার, ফেস্টুন টানায়। এ বছরও এসব উদ্যোগ নিতে দেখা গেছে সংশ্লিষ্টদের।
অতিথি পাখিদের সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দেয় জলাশয়গুলোতে ফোটা লাল শাপলা। লাল শাপলার চাদরে পাখিদের বিচরণের দৃশ্য মন কেড়ে নেয় দর্শনার্থীদের।
প্রতিবছর শীতপ্রধান দেশ মঙ্গোলিয়া, নেপাল, সাইবেরিয়া ও ভারত থেকে হাজার হাজার অতিথি পাখি আমাদের এই নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে আসে। অক্টোবরের শেষ ও নভেম্বরের শুরুর দিকে দেশে আসতে শুরু করে পাখিরা। বাংলাদেশে আসা অতিথি পাখিদের একটি বড় অংশ আশ্রয় নেয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। প্রতিবছর শীত মৌসুমে ক্যাম্পাসে দুই শতাধিক প্রজাতির পাখি দেখা যায়। এদের মধ্যে সরালি, পচার্ড, ফ্লাইফেচার, গার্গেনি, ছোট জিরিয়া, মুরগ্যাধি, কোম্বডাক, পাতারি অন্যতম। এ ছাড়া আছে খঞ্জনা, পান্তামুখী, নর্থগিরিয়া, কমনচিল, কটনচিল, পাতিবাটান, পান্তামুখী, বুটি হাঁস, বৈকাল ইত্যাদি প্রজাতির পাখি। তবে জলাশয়গুলোয় পাতি সরালির বিচরণই বেশি লক্ষণীয়।
অতিথি পাখি দর্শনের সবচেয়ে ভালো সময় হচ্ছে ভোরে ও সূর্য ডোবার আগে। এ সময় পাখিরা ঝাঁক বেঁধে উড়ে বেড়ায় জলাশয়ের ওপর। নিভু নিভু সূর্যের আলো, শীতল আবহাওয়ার সঙ্গে শত শত পাখির কিচিরমিচির শব্দে এই সময়ে এক মনোরম পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
অতিথি পাখির অবাধ বিচরণ ও সৌন্দর্য উপভোগ করতে বাইরের অনেক দর্শনার্থী বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে আসেন। বিশেষ করে ছুটির দিনগুলোতে অতিথি পাখি দেখতে ছুটে আসেন তারা।
ক্যাম্পাসে ঘুরতে আসা হৃদয় হাসান নামে এক দর্শনার্থী বলেন, ‘আমি প্রায় প্রতি বছরই আপনাদের ক্যাম্পাসে আসি অতিথি পাখি দেখতে। ঢাকা শহরে এই সুযোগটি নেই। বাসার ছোট ছেলেমেয়েদের এনেছি এবার। তারাও এই সময়টা খুব উপভোগ করছে।’
তবে উদ্বেগের বিষয় হলো, আগের তুলনায় গত কয়েক বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি পাখির আনাগোনা অনেকটাই কমে গেছে। এর মূল কারণ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের জলাশয়গুলোর পাখিদের বসবাসের অনুপযোগী হয়ে যাওয়াকে দায়ী করেন প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. কামরুল হাসান।
তিনি বলেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব জলাশয়ে পাখিরা থাকে, সেগুলো এখন তাদের বসবাস-উপযোগী নয়। জলাশয়গুলোর আশপাশে অধিক লোকসমাগম ও শব্দদূষণই এর প্রধান কারণ।’
‘পরিবহন চত্বরের পেছনে যে লেক, সেই লেকের ধারে সারা দিনই লোকজন থাকে। এর জন্য পাখিরা ওই লেকে বসতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। তা ছাড়া অন্যান্য লেকেও এবার পাখির সংখ্যা খুবই কম।’
ড. কামরুল হাসান বলেন, ‘আমাদের ক্যাম্পাসের সবচেয়ে বড় যে লেক, সেটি হচ্ছে ওয়াইল্ড লাইফ সেন্টার-সংলগ্ন লেকটি। সংরক্ষিত এলাকা হওয়ায় ওই লেকে পাখির সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। তবে লেকটি এখন পানা দিয়ে ভরে গেছে। পরিষ্কার না হওয়ায় পাখিরা লেকজুড়ে বসতে পারে না। অল্প কিছু অংশে পাখি বসে। তবে এবার প্রশাসন লেকটি পরিষ্কার করেনি। আমি নিজে প্রশাসনকে এ ব্যাপারে কয়েকবার বলেছি।’
বিশ্ববিদ্যালয়-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অতিথি পাখিদের নিরাপদ আবাসস্থল নিশ্চিত না করা হলে পাখির সংখ্যা প্রতিনিয়ত কমতে থাকবে। প্রশাসনের উচিত দ্রুত সময়ের মধ্যে এসব ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া এবং জাহাঙ্গীরনগরের অতিথি পাখি তথা সব বন্যপ্রাণীর জন্য সুষ্ঠু প্রাকৃতিক পরিবেশ নিশ্চিত করা।
পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী অরিত্র সাত্তার বলেন, ‘এ বছর গতবারের তুলনায় পাখি বেশ কম এসেছে। আটটি লেকের মধ্যে মাত্র দুটিতে পাখি বসতে দেখা গেছে, যার মধ্যে অধিকাংশই পাতি সরালি। ডব্লিউআরসি-সংলগ্ন লেক বাদে, অন্য একটি লেকে পাখি বসলেও মাত্র দুই হাজারের কাছাকাছি পর্যবেক্ষণ করা গেছে। অধিকাংশ লেক কচুরিপানায় পরিপূর্ণ থাকায় পাখিরা সেখানে বসতে চায় না।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা ছোটবেলা থেকেই শুনেছি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অতিথি পাখিদের অভয়ারণ্য। কিন্তু ক্যাম্পাসে এসে দেখছি উল্টো চিত্র। আগের মতো আর পাখি নেই। জীববৈচিত্র্য আজ হুমকির মুখে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রশাসনিক কর্মকর্তা ইউএনবিকে বলেন, ‘অতিথি পাখির সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছে, এ ব্যাপারে আমরা অবগত। কিন্তু প্রশাসনের উচ্চস্তরের সদিচ্ছার অভাবের কারণেই দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ লক্ষ করা যাচ্ছে না।’
অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণ, গাছ কাটা, লেক ভরাট, পরিষ্কার না করাসহ আরও কিছু সমস্যা আছে। এগুলো সমাধান করতে পারলেই অতিথি পাখির আগমন আবারও বাড়ানো সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, ‘যেসব লেক পরিষ্কার করা হয়েছে, সেখানে আবার স্থানীয় জলজ উদ্ভিদের পরিমাণ কম হওয়ায় বুনো হাঁসগুলো বসছে না, যদিও মাছ শিকারি পাখিগুলো, যেমন— পানকৌড়ি, সাপপাখি, মেটে মাথা কুড়া ঈগল ইত্যাদি এখানে দেখা গেছে।’
প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান বলেন, ‘আসলে এটা শুধু আমাদের ক্যাম্পাসের সমস্যা নয়, পুরো দেশেই বর্তমানে এই চিত্র দেখা যাচ্ছে। তবে আমাদের জাবিতে যে বিষয়টা, পাখির আবাসস্থল লেকগুলো ঠিক আছে। তবে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা বহুতল ভবন এবং এগুলোর আলো পাখির আবাসস্থল ক্ষতিগ্রস্ত করছে। কেননা পাখিদের বিচরণ স্বভাবতই রাতে বা ভোরবেলায় বেশি হয়ে থাকে।’
‘আমরা প্রাণিবিদ্যা বিভাগ থেকে গত ৩ জানুয়ারি পাখিমেলার আয়োজন করে দেশবাসীকে আসলে পাখি আবাসস্থল সংরক্ষণ আর পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার মেসেজটাই দেওয়ার চেষ্টা করেছি।’
জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এ কে এম রাশিদুল আলম ইউএনবিকে বলেন, ‘পাখি কমে যাওয়ার জন্য বেশকিছু কারণ রয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে উঁচু উঁচু ভবন নির্মাণ, যা পাখিদের বিচরণে সমস্যার সৃষ্টি করে। এ ছাড়া রয়েছে কোলাহলপূর্ণ পরিবেশ (অতিরিক্ত যানবাহন থেকে তৈরি শব্দদূষণ) ও পাখির খাদ্যসংকট। পাখি আসলে ছোট ছোট মাছ খেয়ে থাকে, কিন্তু এই খাদ্যের অভাবে পাখির সংখ্যা কমে যেতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘প্রশাসনের পক্ষ থেকে উল্লেখযোগ্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। আপনারা দেখবেন যে, পুকুরগুলো পরিষ্কার করে প্রতিটি পুকুরে পাখির বসার জন্য নির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। লেক সংস্কার করেছি ৮ লাখ টাকা ব্যয়ে। এ ছাড়া আগে পুকুরগুলো লিজ দেওয়া হতো, কিন্তু বর্তমানে পাখির খাদ্যের কথা চিন্তা করে আর লিজ দেওয়া হচ্ছে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘শব্দদূষণ রোধে যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। এ ছাড়াও আমরা বিবেচনায় রেখেছি, কীভাবে পাখির আগমন বাড়ানো যায়। সে ব্যাপারে আরও জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
বাংলাদেশে আবহমান জীববৈচিত্র্যের এক অপরূপ সৌন্দর্য এই অতিথি পাখির আগমন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সেই ঐতিহ্য ধরে রেখেছিল অনেক আগে থেকেই। কিন্তু নানা অব্যবস্থাপনায় সেই অতিথি পাখি জাহাঙ্গীরনগর থেকে সরে যাচ্ছে। এই ঐতিহ্য ধরে রাখতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে—এমনটাই প্রত্যাশা সবার। সূত্র: ইউএনবি