
খুদে এক ফুল। কিন্তু সেই ফুলকে নিয়েই প্রাচীনকাল থেকে কবি-সাহিত্যিকদের চলছে মাতামাতি। প্রায় দুই হাজার বছর আগে কবি কালিদাসের মেঘদূত কাব্যের প্রাচীন নগরী উজ্জয়িনীর সুন্দরীরা মুখের মদিরা-সিঞ্চনে বাগানে ফোটাতেন বকুল ফুল। কিন্তু সে নিহায়ত শাস্ত্রের মর্যাদা রক্ষার জন্য, বকুলের প্রতি আকর্ষণে নয়। এমনকি কবি কালিদাস নিজেও বকুলের অনুরাগী ছিলেন না। বকুল তার পূর্ণ মর্যাদা পাওয়ার জন্য হাজার বছর অপেক্ষা করেছে। শেষে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা ও গানে সে প্রাচীন বকুল পেয়েছে তার পূর্ণ মর্যাদা। বকুল ফুল হয়ে উঠেছে প্রেমের সৌরভ হয়ে। কবি কাজী নজরুল ইসলামের জিঞ্জীর কাব্যের ‘ভীরু’কবিতায় সে সৌরভ ছুটেছে বকুল ফুলের গোপন কুঠুরি থেকে- ‘বিকচ বুকের বকুল-গন্ধ/ পাপড়ি রাখিতে পারে না বন্ধ,/ যত আপনারে লুকাইতে চাও তত হয় জানাজানি।’
প্রেম আর ফুলের সৌরভ- দুটির কোনোটিই লুকানো যায় না। হেমন্তের এক সন্ধ্যা রাতে রমনা পার্কের ঝিলের ধার ধরে যখন হাঁটছিলাম তখন হঠাৎ নাকে ভেসে এল সুমিষ্ট সৌরভ, বুঝতে পারলাম কাছে কোথাও বকুল ফুল ফুটেছে। তারই তীব্র ঘ্রাণ ভেসে আসছে। কয়েক পা হেঁটে আমরা তিনজন বাওবাব আর জাকারান্ডা গাছের কাছাকাছি যেতেই পথের ওপর চোখে পড়ল শত শত ঝরা বকুল ফুল। বর্ষায় দেখিনি, শরতে দেখেছি, হেমন্তেও দেখলাম বকুল ফুল। শীতেও কি দেখব সে ফুল? সে প্রশ্নটা তো কবি নজরুলেরও ছিল, তার গানে দেখি সে প্রশ্নটাই- ‘বরষায় ফুটলো না বকুল/ পউষে ফুটবে কি সে ফুল?’ কিন্তু পৌষেও দেখা হলো বকুল ফুলের সঙ্গে। জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে মানিক মিয়া এভিনিউর পাশে সারি করে লাগানো প্রায় দেড় শটি বকুল গাছ। সেসব গাছে শুধু ফুল না, ফলেরও দেখা পেলাম। কাঁচা ফলগুলো ধূসর সবুজ, পাকতে শুরু করেছে সেসব ফল। পাকা ফলের রং হলুদাভ থেকে লাল হতে শুরু করেছে। প্রায় সারা বছরই দু-চারটা বকুল ফুল ফোটে বলেই এর আর এক নাম সদাপুষ্প। বকুলের আরেক নাম মদন। সেই বৈদিক আমলে দেবতারা সোমরস তথা সে যুগের শ্যাম্পেন তৈরি করতেন পাকা বকুলের শাঁস গাঁজিয়ে। সে সুরা বা সোমরস পান করে দেহে আসত অন্য রকমের কামুক মাদকতা।
বকুল ফুল শুধু দেবতাদেরই না, চাঁদকেও করে দেয় মাতাল। শরত-হেমন্তের পূর্ণ জ্যোস্না রাত, বকুল-শাখা বিলাচ্ছে তার ফুলের সৌরভ, টুপটাপ করে ঝরে পড়ছে বকুল ফুল আর শিশির, ঝরা বকুল ফুলের মালা গেঁথে প্রেয়সী অপেক্ষা করছে প্রেমিকের অথবা অভিসারের- এর চেয়ে প্রেমময় দৃশ্য আর কী হতে পারে? কবি নজরুলের রিক্তের বেদন গ্রন্থে ‘মেহের নেগার’ গল্পের নায়িকার সেরূপ অপেক্ষা ও মিলনের এক দুর্দান্ত চিত্র ফুটে উঠেছে: ‘চাঁদ এলো মদখোর মাতালের মতো টলতে টলতে, চোখ মুখ লাল করে। এসেই সে জোর করে সন্ধ্যা-বধূর আবরু ঘোমটা খুলে দিলে। সন্ধ্যা হেসে ফেললে! লুকিয়ে-দেখা বৌ-ঝির মত একটা পাখি বকুল গাছ থেকে লজ্জারাঙ্গা হয়ে টিটকারী দিয়ে উঠল, ছি! ছি!’
বাংলা সাহিত্যে বকুল যতটা আদরণীয় ততটা আদরণীয় না বাঙালিদের কাছে। সাধারণত কেউ বাগানে বকুলগাছ লাগায় না। বকুলের তাই ঠাঁই হয়েছে নগর উদ্যানে আর নগরপথের ধারে। কিছু প্রতিষ্ঠানেও বকুলগাছ লাগানো হয়েছে। বকুলের মতো ঘনশ্যামল ছায়াধারী শোভাধারী শক্ত গাছ এ দেশের প্রকৃতিতে খুব কম আছে। পঞ্চাশের দশকে ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশন প্রাঙ্গণে লাগানো বকুলগাছ এখনো সেখানে রয়েছে। তবে সবচেয়ে পুরোনো বকুলগাছ রয়েছে রমনা উদ্যানে ও ঢাকায় শাহবাগের কাছে চারুকলার ভেতরে, যার নাম বকুলতলা। রমনা উদ্যান ও বলধা উদ্যানের সাইকি অংশে রয়েছে বিচিত্রা বকুলগাছ, যার পাতা সবুজে-হলুদে চিত্রিত।
বকুলের ইংরেজি নাম স্প্যানিশ চেরি। এ দেশে তিন প্রজাতির বকুলগাছ থাকলেও সচরাচর আমরা যে বকুলগাছ দেখি তা মাইমুসোপস ইলেঙ্গি (Mimusops elengi) প্রজাতির, গোত্র স্যাপোটেসি। বকুল এক চিরসবুজ দীর্ঘজীবী বৃক্ষ, যা প্রায় ১৫ মিটার পর্যন্ত গাছ লম্বা হতে পারে। ডালপালা প্রসারিত, ঝাঁকড়া। ঘন উজ্জল সবুজ, মসৃণ ও চকচকে পাতা। ফুল ঘিয়ে রঙের, তারার মতো, ছোট ও সুঘ্রাণযুক্ত। গাছের বাকল ধূসর, অমসৃণ বা কালচে ধূসর, ফাটলযুক্ত। বকুলের কাঠ কিন্তু খুবই শক্ত ও ভারী, লাল রঙের, মসৃণ ও খুব মজবুত। কাঠ কড়ি, খুঁটি, রোয়া, ঢেঁকি, সাঁকো ইত্যাদি কাজে ব্যবহার করা যায়। বীজ থেকেই বকুলের নতুন গাছ জন্মে। পাকা বকুল ফলের সিরাপ শুক্র তারল্য সারায়। বকুলের আদিনিবাস দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া।