ঢাকা ২৪ মাঘ ১৪৩১, শুক্রবার, ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
English
শুক্রবার, ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৪ মাঘ ১৪৩১

পৌষেও ফুটেছে বকুল

প্রকাশ: ২০ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:২৬ এএম
আপডেট: ২০ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:৩৮ এএম
পৌষেও ফুটেছে বকুল
ঢাকা মানিক মিয়া এভিনিউর ধারের গাছে ফোটা বকুল ফুল। ছবি: লেখক

খুদে এক ফুল। কিন্তু সেই ফুলকে নিয়েই প্রাচীনকাল থেকে কবি-সাহিত্যিকদের চলছে মাতামাতি। প্রায় দুই হাজার বছর আগে কবি কালিদাসের মেঘদূত কাব্যের প্রাচীন নগরী উজ্জয়িনীর সুন্দরীরা মুখের মদিরা-সিঞ্চনে বাগানে ফোটাতেন বকুল ফুল। কিন্তু সে নিহায়ত শাস্ত্রের মর্যাদা রক্ষার জন্য, বকুলের প্রতি আকর্ষণে নয়। এমনকি কবি কালিদাস নিজেও বকুলের অনুরাগী ছিলেন না। বকুল তার পূর্ণ মর্যাদা পাওয়ার জন্য হাজার বছর অপেক্ষা করেছে। শেষে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা ও গানে সে প্রাচীন বকুল পেয়েছে তার পূর্ণ মর্যাদা। বকুল ফুল হয়ে উঠেছে প্রেমের সৌরভ হয়ে। কবি কাজী নজরুল ইসলামের জিঞ্জীর কাব্যের ‘ভীরু’কবিতায় সে সৌরভ ছুটেছে বকুল ফুলের গোপন কুঠুরি থেকে- ‘বিকচ বুকের বকুল-গন্ধ/ পাপড়ি রাখিতে পারে না বন্ধ,/ যত আপনারে লুকাইতে চাও তত হয় জানাজানি।’

প্রেম আর ফুলের সৌরভ- দুটির কোনোটিই লুকানো যায় না। হেমন্তের এক সন্ধ্যা রাতে রমনা পার্কের ঝিলের ধার ধরে যখন হাঁটছিলাম তখন হঠাৎ নাকে ভেসে এল সুমিষ্ট সৌরভ, বুঝতে পারলাম কাছে কোথাও বকুল ফুল ফুটেছে। তারই তীব্র ঘ্রাণ ভেসে আসছে। কয়েক পা হেঁটে আমরা তিনজন বাওবাব আর জাকারান্ডা গাছের কাছাকাছি যেতেই পথের ওপর চোখে পড়ল শত শত ঝরা বকুল ফুল। বর্ষায় দেখিনি, শরতে দেখেছি, হেমন্তেও দেখলাম বকুল ফুল। শীতেও কি দেখব সে ফুল? সে প্রশ্নটা তো কবি নজরুলেরও ছিল, তার গানে দেখি সে প্রশ্নটাই- ‘বরষায় ফুটলো না বকুল/ পউষে ফুটবে কি সে ফুল?’ কিন্তু পৌষেও দেখা হলো বকুল ফুলের সঙ্গে। জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে মানিক মিয়া এভিনিউর পাশে সারি করে লাগানো প্রায় দেড় শটি বকুল গাছ। সেসব গাছে শুধু ফুল না, ফলেরও দেখা পেলাম। কাঁচা ফলগুলো ধূসর সবুজ, পাকতে শুরু করেছে সেসব ফল। পাকা ফলের রং হলুদাভ থেকে লাল হতে শুরু করেছে। প্রায় সারা বছরই দু-চারটা বকুল ফুল ফোটে বলেই এর আর এক নাম সদাপুষ্প। বকুলের আরেক নাম মদন। সেই বৈদিক আমলে দেবতারা সোমরস তথা সে যুগের শ্যাম্পেন তৈরি করতেন পাকা বকুলের শাঁস গাঁজিয়ে। সে সুরা বা সোমরস পান করে দেহে আসত অন্য রকমের কামুক মাদকতা। 

বকুল ফুল শুধু দেবতাদেরই না, চাঁদকেও করে দেয় মাতাল। শরত-হেমন্তের পূর্ণ জ্যোস্না রাত, বকুল-শাখা বিলাচ্ছে তার ফুলের সৌরভ, টুপটাপ করে ঝরে পড়ছে বকুল ফুল আর শিশির, ঝরা বকুল ফুলের মালা গেঁথে প্রেয়সী অপেক্ষা করছে প্রেমিকের অথবা অভিসারের- এর চেয়ে প্রেমময় দৃশ্য আর কী হতে পারে? কবি নজরুলের রিক্তের বেদন গ্রন্থে ‘মেহের নেগার’ গল্পের নায়িকার সেরূপ অপেক্ষা ও মিলনের এক দুর্দান্ত চিত্র ফুটে উঠেছে: ‘চাঁদ এলো মদখোর মাতালের মতো টলতে টলতে, চোখ মুখ লাল করে। এসেই সে জোর করে সন্ধ্যা-বধূর আবরু ঘোমটা খুলে দিলে। সন্ধ্যা হেসে ফেললে! লুকিয়ে-দেখা বৌ-ঝির মত একটা পাখি বকুল গাছ থেকে লজ্জারাঙ্গা হয়ে টিটকারী দিয়ে উঠল, ছি! ছি!’

বাংলা সাহিত্যে বকুল যতটা আদরণীয় ততটা আদরণীয় না বাঙালিদের কাছে। সাধারণত কেউ বাগানে বকুলগাছ লাগায় না। বকুলের তাই ঠাঁই হয়েছে নগর উদ্যানে আর নগরপথের ধারে। কিছু প্রতিষ্ঠানেও বকুলগাছ লাগানো হয়েছে। বকুলের মতো ঘনশ্যামল ছায়াধারী শোভাধারী শক্ত গাছ এ দেশের প্রকৃতিতে খুব কম আছে। পঞ্চাশের দশকে ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশন প্রাঙ্গণে লাগানো বকুলগাছ এখনো সেখানে রয়েছে। তবে সবচেয়ে পুরোনো বকুলগাছ রয়েছে রমনা উদ্যানে ও ঢাকায় শাহবাগের কাছে চারুকলার ভেতরে, যার নাম বকুলতলা। রমনা উদ্যান ও বলধা উদ্যানের সাইকি অংশে রয়েছে বিচিত্রা বকুলগাছ, যার পাতা সবুজে-হলুদে চিত্রিত।

বকুলের ইংরেজি নাম স্প্যানিশ চেরি। এ দেশে তিন প্রজাতির বকুলগাছ থাকলেও সচরাচর আমরা যে বকুলগাছ দেখি তা মাইমুসোপস ইলেঙ্গি (Mimusops elengi) প্রজাতির, গোত্র স্যাপোটেসি। বকুল এক চিরসবুজ দীর্ঘজীবী বৃক্ষ, যা প্রায় ১৫ মিটার পর্যন্ত গাছ লম্বা হতে পারে। ডালপালা প্রসারিত, ঝাঁকড়া। ঘন উজ্জল সবুজ, মসৃণ ও চকচকে পাতা। ফুল ঘিয়ে রঙের, তারার মতো, ছোট ও সুঘ্রাণযুক্ত। গাছের বাকল ধূসর, অমসৃণ বা কালচে ধূসর, ফাটলযুক্ত। বকুলের কাঠ কিন্তু খুবই শক্ত ও ভারী, লাল রঙের, মসৃণ ও খুব মজবুত। কাঠ কড়ি, খুঁটি, রোয়া, ঢেঁকি, সাঁকো ইত্যাদি কাজে ব্যবহার করা যায়। বীজ থেকেই বকুলের নতুন গাছ জন্মে। পাকা বকুল ফলের সিরাপ শুক্র তারল্য সারায়। বকুলের আদিনিবাস দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া।

হৃদয় রাঙানো রঙ্গন ফুল

প্রকাশ: ৩১ জানুয়ারি ২০২৫, ১০:৫০ এএম
আপডেট: ৩১ জানুয়ারি ২০২৫, ১০:৫০ এএম
হৃদয় রাঙানো রঙ্গন ফুল
খুলনা শহিদ হাদিস পার্কে ফোটা রঙ্গন ফুল। ছবি: লেখক

মাঘ মাস, তাই শীতটাও বেশ লাগছে। বেলা প্রায় ১১টা। তাই রোদের তাপটা মন্দ লাগছে না। খুলনায় শহিদ হাদিস পার্কের দখিনা তোরণ দিয়ে সোজা হাঁটতে হাঁটতে প্রায় উত্তরা তোরণের কাছে চলে গেলাম। বাঁয়ে গোধূলি তোরণ, ডানে পূর্ব দিকে বিশাল দিঘি। দিঘির পাড় ধরে চারদিকে চমৎকার হাঁটার পথ। সে পথের ধারে বেশ বড় বড় ৬৯টি ঝোপালো রঙ্গনগাছ। এক সারিতে এতগুলো শোভাময়ী রঙ্গনগাছ খুব কম দেখা যায়। 

বর্ষাকাল হলো রঙ্গনের রঙিন হওয়ার সময়। বড় বড় লাল টুকটুকে থোকা ধরা ফুলে গাছের ডালপালা ভরে থাকে। শীতে সেভাবে ফোটে না। তবুও দেখা গেল, প্রায় সব গাছেই স্বল্প হলেও থোকা ধরে কিছু ফুল ফুটে রয়েছে। 

রঙ্গন একটি চিরসবুজ বহুবর্ষজীবী বৃক্ষ ও গুল্মপ্রকৃতির উদ্ভিদ। রঙ্গন রুবিয়েসি গোত্রের ইক্সোরা (Ixora) গণের উদ্ভিদ। ১৭৫৩ খ্রিষ্টাব্দে রঙ্গনের এই গণগত নামকরণ করেন লিনিয়াস। সারা পৃথিবীতে এ গণের এ পর্যন্ত ৫৪৪ প্রজাতির রঙ্গন আছে বলে জানা গেছে। বাংলাদেশে আছে ১৮ প্রজাতির রঙ্গন। প্রজাতিভেদে রঙ্গনগাছের ধরন, পাতার আকার ও ফুলের রঙের পার্থক্য হয়। 

সাধারণভাবে রঙ্গনগাছের পাতা ৫ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। ডালের আগায় খোঁপার মতো থোকায় প্রচুর ছোট ফুল ফোটে। ফুলগুলোর পুষ্পনল লম্বা ও সোজা, পুষ্পনলের মাথায় চার পাপড়ি থাকে চারদিকে ছড়িয়ে। প্রজাতি ও জাতভেদে পাপড়ির অগ্রভাগ চোখা ও ভোঁতা হয়, রং ঘন লাল থেকে গোলাপি, কমলা, হলুদ, সাদা, এমনকি দোরঙা রঙ্গনও হয়। আমরা সচরাচর যে বড় বড় থোকার টকটকে লাল ফুল ও বড় বড় পাতার রঙ্গনগাছ দেখি, সেটি ইক্সোরা কক্সিনিয়া প্রজাতির। এর অন্য নাম লালরঙ্গন ও রঞ্জন। ইক্সোরা একুমিনাটা প্রজাতির গাছ লম্বা, উচ্চতায় প্রায় তিন মিটার পর্যন্ত হয়। পাতা উপবৃত্তাকার, বড়, চকচকে সবুজ। ফুল সাদা ও সুগন্ধযুক্ত। এ জন্য একে সুরভীরঙ্গনও বলা হয়। ইক্সোরা আলিপোরেনসিস একটি হাইব্রিড রঙ্গন। এ প্রজাতির গাছ উচ্চতায় ১ দশমিক ৫ মিটার পর্যন্ত হয়। ফুল বড় খোঁপার মতো থোকা ধরে ফোটে, ফুলের রং কমলা। ইক্সোরা লুটিয়া প্রজাতির পাতা বড়, ফুল হলুদ। এ প্রজাতির লাল ফুলও আছে। ইক্সোরা ডাফি প্রজাতিকে বলা হয় রক্তরঙ্গন। এর ফুল টকটকে লাল, পাতা অনেক বড়। ইক্সোরা সিঙ্গাপোরেনসিস প্রজাতির রঙ্গনকে সিঙ্গাপুরি রঙ্গন নামে ডাকা হয়। এর পাতা বড়, ফুল লাল। ইক্সোরা চাইনেসিস প্রজাতির রঙ্গনের গাছ, পাতা ও ফুল ছোট, গোলাপি রঙের পাপড়ি। একে বলা হয় চাইনিজ রঙ্গন। ইক্সোরা আনডুলাটা প্রজাতির রঙ্গন এ দেশে পলকজুঁই নামে পরিচিত এবং বেওফুল বা বিজু ফুল নামে পরিচিত ইক্সোরা কিউনিফোলিয়া প্রজাতির রঙ্গন। শ্বেতরঙ্গন হলো ইক্সোরা প্যাভেটা ও কুঠি রঙ্গন বলা হয় ইক্সোরা নাইগ্রিকানস প্রজাতির রঙ্গনকে। 

উদ্ভিদের গণগত নামের উৎসগুলো হয় সাধারণত লাতিন শব্দ থেকে। কিন্তু ‘ইক্সোরা’ শব্দের উৎপত্তি ঘটেছে সংস্কৃত শব্দ থেকে। বাংলাদেশের ডিকশনারি অব প্ল্যান্ট নেমস গ্রন্থে ইক্সোরা শব্দের উৎপত্তি ঈশ্বরী থেকে উল্লেখ করা হয়েছে, ঈশ্বরী হলো শিবের স্ত্রী পার্বতীর আরেক নাম, যাকে পৌরাণিক কালে এই ফুল নিবেদন করা হয়েছিল। অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণের উদ্ভিদ অভিধান গ্রন্থে বাংলা নাম রঙ্গনকে আচ্ছুকাদিবর্গের পুষ্পক্ষুপ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে; যার ফুল লাল, চতুর্দল, অনেক ও গুচ্ছাকারে ফোটে। রঙ্গনের গাছ ক্ষুপ বা ঝোপবিশিষ্ট। তাই রঙ্গন বলতে আমরা প্রধানত লাল রঙ্গনকেই চিনি। এ জন্য হয়তো রঙ্গনের ইংরেজি নাম রাখা হয়েছে জাংগল ফ্লেইম। গুটি কলম, কাটিং বা শাখা কলম করে এর চারা তৈরি করা যায়।

এত সব রঙ্গনের হদিস করা উদ্ভিদ বিজ্ঞানীদের কাজ, প্রকৃতিরসিক ও কবিদের কাজ না। কাজী নজরুল ইসলামও রঙ্গন বলতে টকটকে লাল রঙ্গন ফুলকেই বলেছেন তার কবিতায়। রঙ্গন ফুলের রংকে তিনি তুলনা করেছেন রক্তের রঙের সঙ্গে। ‘দোলনচাঁপা’ কাব্যের আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কবিতার দুটি পঙ্‌ক্তিতে রয়েছে রঙ্গনের উল্লেখ। ‘আজ রঙ্গন এলো রক্ত প্রাণের অঙ্গনে মোর চারপাশে/ আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে!’ আবার সিন্ধু-হিন্দোল কাব্যের ফাল্গুনী কবিতাতেও দেখা মেলে সেই লাল রঙ্গনের। 

শীতের ফুল পিটুনিয়া

প্রকাশ: ২৮ জানুয়ারি ২০২৫, ১০:১১ এএম
আপডেট: ২৮ জানুয়ারি ২০২৫, ১০:৪৭ এএম
শীতের ফুল পিটুনিয়া
ময়মনসিংহের কাচারিঘাটের বাংলাদেশ নার্সারির বিক্রয়কেন্দ্রে পিটুনিয়া (Petunia)। ছবি: লেখক

প্রতিদিন সকালে ব্রহ্মপুত্র নদের তীর ধরে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন উদ্যানে হাঁটতে যাই। ফেরার সময় নার্সারিতে ঢুঁ মারি। উদ্দেশ্য নতুন কোনো উদ্ভিদের দেখা পাই কি না। কয়েকদিন আগে ময়মনসিংহ শহরের কাচারিঘাটে হিমু আড্ডা রেস্তোরাঁর পাশে বাংলাদেশ নার্সারির বিক্রয়কেন্দ্রে দারুণ রঙের সব পিটুনিয়ার দেখা পাই। সাদা, লাল, বেগুনি, হলদে, নীল বিভিন্ন রঙের পিটুনিয়া রয়েছে এখানে। পিটুনিয়া শীতের মৌসুমি ফুল। নানান রঙের পিটুনিয়া বাগান ও বারান্দার সৌন্দর্য বাড়িয়ে দেয়।

মে-জুন মাস পর্যন্ত ফুল ফোটে এই উদ্ভিদে। পিটুনিয়ার একটি প্রজাতির নাম Petunia hybrida, এটি Solanaceae পরিবারের বিরুৎ জাতীয় উদ্ভিদ। Petunia এসেছে ব্রাজিলিয়ান শব্দ Petein থেকে। Petunia axillaris এবং Petunia violacea- এর পরাগায়নের মাধ্যমে Petunia hybrida তৈরি করা হয়। এ উদ্ভিদের কাণ্ড দুর্বল। পাতা পুরু এবং লোমশ। এটি ২৪ থেকে ৪৫ সেন্টিমিটার উঁচু হতে পারে। এই ফুলগাছের আদি নিবাস দক্ষিণ আফ্রিকা ও আর্জেন্টিনা। 

পিটুনিয়া ফুল বিভিন্ন রংয়ের হয়। শীতের মাঝামাঝি পিটুনিয়ার কলি বের হয়, বসন্তে ফুল ফোটে ও তা গরমে ঝরে যায়। তিন মাসের মতো বেঁচে থাকে এই ফুলগুলো। এই ফুল সুন্দর সুগন্ধি ছড়ায়। ছবির পিটুনিয়াটিতে ডোরাকাটা আছে বলে নার্সারিওয়ালাদের কাছে তা ‘টাইগার পিটুনিয়া’ নামে পরিচিত।

পিটুনিয়া ফুল থেকে মিষ্টি গন্ধ বের হয়। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, এই ফুলের পাপড়িগুলো যতই ঘন হবে, ততই উদ্ভিদ আরও সুগন্ধযুক্ত হবে। পরাগায়নের জন্য প্রজাপতিসহ অন্য পতঙ্গ আকর্ষণ করতে ফুল মিষ্টি গন্ধ নিঃসরণ করে। 

মায়া এবং ইনকা সভ্যতার মানুষরা বিশ্বাস করত যে পিটুনিয়ার ঘ্রাণে আন্ডারওয়ার্ল্ড দানব এবং আত্মাদের তাড়ানোর ক্ষমতা আছে। Pitunia গণে প্রজাতির সংখ্যা ২০টি । পিটুনিয়ার জনপ্রিয় জাতগুলো হলো ব্লু বার্ড, রোজ অব হেভেন, লেডি বার্ড, কনব্লু,কংলো, কনস্ট্রো, ক্লেফ, স্টর্ম ল্যাভেন্ডার, স্টর্ম পিঙ্ক, স্টর্ম সালমন, সানটোসল, কেরপ্রিল ইত্যাদি।

দোআঁশ মাটি পিটুনিয়া চাষের উপযোগী। এর বীজ খুব ছোট। তাই সমানভাবে যাতে বীজতলায় বীজ পড়ে সেজন্য বীজের সঙ্গে মিহি বালি মিশিয়ে বীজ বোনা উচিত। 

লেখক: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ, মুমিনুন্নিসা সরকারি মহিলা কলেজ, ময়মনসিংহ

বাতাসে আম্রমুকুলের ঘ্রাণ

প্রকাশ: ২৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:০৫ পিএম
বাতাসে আম্রমুকুলের ঘ্রাণ
রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার নিমপাড়া গ্রামের একটি আমবাগানে পাতার ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে মুকুল। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে মুকুলের ঘ্রাণ। ছবিটি গতকাল তোলা খবরের কাগজ

প্রকৃতিতে এখনো ফাল্গুন না এলেও মাঘের শীতের মধ্যেই বাতাসে আম্রমুকুলের গন্ধে ম-ম করছে উত্তরের জনপদ রাজশাহী। বাগানগুলোতে পাতার ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে আগাম আমের মুকুল। পৌষের শেষে আসা এই মুকুলে আমচাষিদের মনে আশার প্রদীপ জ্বলে উঠেছে। ভালো ফলনের স্বপ্ন নিয়ে বাগানগুলোতে বাড়তি যত্ন নিতে শুরু করেছেন তারা।

রাজশাহী অঞ্চল কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের তথ্যমতে, এ বছর রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ও নাটোর জেলায় ৯৬ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে আমবাগান রয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় সাড়ে ১৩ লাখ টন। এ অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি আমবাগান রয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায়। গত বছর রাজশাহী অঞ্চলে মোট ১২ লাখ ৭ হাজার ২৬৩ টন আম উৎপাদন হয়। এবার আমের ফলন কিছুটা বাড়বে বলে আশা করছে কৃষি বিভাগ।

সরেজমিনে রাজশাহী নগরীর পুলিশ লাইনস, ভেড়িপাড়া, মেহেরচণ্ডী, মালোপাড়া, ভদ্রা ও সিনিন্দা এলাকায় আমগাছে মুকুলের দেখা মিলেছে। তবে রাজশাহীর চারঘাট ও বাঘা উপজেলায় আমের আগাম মুকুল বেশি এসেছে। জেলার পুঠিয়া, দুর্গাপুরসহ অন্যান্য উপজেলাতেও গাছে গাছে ফুটেছে আগাম আমের মুকুল। কোথাও কোথাও ইতোমধ্যে ৭০ শতাংশ আমগাছে মুকুল এসেছে। আবার কোথাও ৫০ শতাংশ গাছে মুকুল ফুটেছে। তবে সব গাছে মুকুল আসতে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত সময় লাগবে। 

বাগানের কয়েকজন মালিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আমগাছে মুকুল আসা শুরু হতেই মৌসুমি বাগান ব্যবসায়ী ও ফড়িয়ারা মাঠে নেমে পড়েছেন। তারা মুকুল দেখে বাগান কেনার জন্য মালিকদের কাছে যাচ্ছেন। তবে এখনো বাগান কেনাবেচা জমে ওঠেনি। জমে উঠলে এবার আমগাছে রেখেই ভালো দাম পাওয়া যাবে। 

রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার নিমপাড়া গ্রামের বাগানমালিক জুয়েল রানা খবরের কাগজকে বলেন, ‘গত বছর আমের মুকুল তেমন আসেনি। এবার আগেভাগেই অনেক মুকুল এসেছে। এসব আম আগেভাগে বাজারজাত করতে পারলে ভালো দাম পাওয়া যাবে। গত মৌসুমের লোকসান পুষিয়ে এবার লাভ হবে বলে আশায় বুক বেঁধেছি।’ 

রাজশাহীর বড়গাছি এলাকার বাগানমালিক আলী হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘কিছু কিছু গাছে মুকুল আসতে শুরু করেছে। আর ১০ দিন গেলে পুরো বাগানেই মুকুল ফুটবে। বাগানের আগাছা পরিষ্কারসহ পোকা দমনে কীটনাশক স্প্রে করা হচ্ছে। এতে পোকা যেমন দূর হবে, তেমনি গাছে স্বাস্থ্যকর মুকুল দেখা দেবে।’ 

রাজশাহী আম ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি সাইফুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘কিছুদিনের মধ্যে আমবাগান কেনাবেচা শুরু হবে। গত মৌসুমের চেয়ে এবার ভালো দামে বাগান বিক্রি হবে বলে আশা করছি।’

রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শফিকুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘গত বছর যেহেতু কম মুকুল এসেছে, সেহেতেু এবার বেশি মুকুল হবে। চাষিদের গাছের প্রতি যত্নশীল হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।’ 

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক ড. মো. মোতালেব হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী বড় আমগাছে কোনো বছর মুকুল কম এলে পরের বছর বেশি আসে। সেই হিসাবে বড় গাছগুলোতে মুকুল এবার বেশি আসার কথা। আর ছোট গাছ যারা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে রোপণ করেন, তারা যথাযথ যত্ন নেন। এ কারণে ছোট বাগানগুলোতে সব মৌসুমেই মুকুল বেশি হয়। এবারের আবহাওয়া আমের জন্য এখন পর্যন্ত উপযোগী আছে। অধিক ফলনের আশায় যত্ন নিচ্ছেন আমবাগানীরা।’

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক উম্মে ছালমা খবরের কাগজকে বলেন, ‘বাগানে পুরোপুরি মুকুল আসতে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময় লেগে যাবে। যেসব গাছে মুকুল এসেছে, সেগুলো আগাম জাতের। চাষিদের বাগান পরিচর্যা এবং ওষুধ স্প্রে করার নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। চাষিরাও অধিক ফলনের আশায় কাজ করছেন। আশা করা হচ্ছে, এবার আমের বাম্পার ফলন হবে। চাষিরাও অধিক লাভবান হবেন।’

বর্ণিল পাতি মাছরাঙা

প্রকাশ: ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:৫৭ পিএম
বর্ণিল পাতি মাছরাঙা
পাতি মাছরাঙা। বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ থেকে তোলা ছবি: লেখক

বাংলাদেশ মিঠাজলের দেশ। এই দেশে বসবাস করে অনেক প্রজাতির জলনির্ভর পাখি। এসব পাখির মধ্যে বক, হাঁস ও মাছরাঙা আমাদের অতি পরিচিত। আমাদের দেশে ১২ প্রজাতির মাছরাঙা পাওয়া যায়। বাংলাদেশের সব জেলার পুকুরে একটি মাছরাঙা প্রজাতি খুব সহজেই দেখা যায়। সেটি হলো পাতি মাছরাঙা। গ্রামের কোনো কোনো পুকুরে দুই জোড়া পাতি মাছরাঙাও বসবাস করে। 

ছেলেবেলায় দেখেছি পাতি মাছরাঙার আচার-আচরণ। গ্রামে বা শহরের নির্জন কোনো পুকুরের মধ্যে কাঠের খুঁটি বা লগি থাকলে সেটির ওপর অধীর ধৈর্য নিয়ে বসে থাকে একটি মাছের জন্য। কখনো পুকুরের কাছে, কোনো গাছের ডালে বসে নজর থাকে পানির দিকে। সাধারণত এদের পছন্দ ছোট পুঁটি ও অন্যান্য ছোট মাছ। জলের মধ্যে মাছ দেখলে এরা দ্রুত ঝাঁপ দিয়ে মাছটি ধরে ফেলে। তারপরে উড়ে এসে বসে কিছু সময়ের মধ্যেই মাছটিকে গলাধঃকরণ করে। 

ছেলেবেলায় দুপুরের রোদে মাছরাঙাদের পালকের আকর্ষণীয় নীল রং এবং মাছ ধরার কৌশল ভালো লাগত। মাছরাঙা পাখি গ্রামের মানুষ শিকার করত না। যে কারণে তাদের সংখ্যা ভালোই ছিল। প্রতি বাড়ির পুকুরে দুই প্রজাতির- পাতি ও ধলাবুক মাছরাঙা থাকত। নিজেদের মতো করে এরা বিচরণ এলাকা ঠিক করত। কোনো দিন দুই প্রজাতির মধ্যে সংঘাত দেখিনি।

পাতি মাছরাঙা খাল, বিল, পুকুর, ডোবা, নদী, নর্দমা, প্যারাবনসহ অন্যান্য জলাভূমিতে বিচরণ করে। সাধারণত একা বা জোড়ায় থাকে। ছোট মাছ ছাড়াও এরা ছোট ব্যাঙ এবং জলজ পোকা খায়। স্থান ত্যাগ করার সময় এবং ওড়ার সময় তীব্র শব্দে ‘চিট…ইট...ইট’ সুরে ডাকে। বসে থাকার সময় প্রায়ই ছোট লেজটি নাড়ায়। পাতি মাছরাঙা বাংলাদেশের সুলভ আবাসিক পাখি এবং বাংলাদেশের সব জেলায় এরা বিচরণ করে। 

পাতি মাছরাঙা কমলা পেট ও নীল বর্ণের ছোট পাখি। দেহের দৈর্ঘ্য প্রায় ১৮ সেন্টিমিটার। দেহের উপরিভাগ নীল বা নীলচে সবুজ, দেহতল কমলা এবং ঠোঁট চোখা ও লম্বা। পানির নিচে শিকার দেখার জন্য এরা বিশেষভাবে অভিযোজিত। মার্চ-জুন মাসে এরা জলাশয়ে খাড়া পাড়ে গর্ত করে বাসা বানায়। সেখানে পাঁচ থেকে সাতটি সাদা রঙের ডিম পাড়ে। ছেলে ও মেয়ে-পাখি পালা করে ডিমে তা দেয় ও ছানাদের যত্ন করে। 

বিজ্ঞানী কার্ল লিনিয়াস ১৭৫৮ সালে এ পাখির প্রথম বর্ণনা করেছিলেন। সারা পৃথিবীতে পাতি মাছরাঙার সাতটি উপ-প্রজাতি রয়েছে। বাংলাদেশ বাদে পাতি মাছরাঙা ভারত, ইউরেশিয়া ও উত্তর আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে দেখা যায়। 
লেখক: নিসর্গী ও পরিবেশবিদ, জার্মান অ্যারোস্পেস সেন্টার

লণ্ঠনের মতো পাথরকুচি ফুল

প্রকাশ: ২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১১:০৭ এএম
আপডেট: ২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১১:০৭ এএম
লণ্ঠনের মতো পাথরকুচি ফুল
শীতা ফোটা পাথরকুচি ফুল। ছবি: লেখক

মাঘ মাস, ঢাকার চেয়ে ঢাকার বাইরে শীতটা একটু বেশি লাগে। ভোরের কুয়াশার ভেতর দিয়ে ঢাকা থেকে সকাল ৭টায় রওনা হয়ে ১০টায় পৌঁছে গেলাম টাঙ্গাইলের সখিপুর উপজেলার যাদবপুর গ্রামে। সেখানে কবি নজরুল পার্কে দেখা হলো পাথরকুচিগাছের সঙ্গে। যদিও এ দেশে পাথরকুচি কোনো দুর্লভ গাছ না। ছোটবেলায় অনেক বাড়িতে এ গাছটি দেখতাম। এখন সেভাবে আর গ্রামের বাড়িগুলোতেও পাথরকুচির গাছ চোখে পড়ে না। কৃমি হলে পাথরকুচি পাতার রস খাওয়াতেন ঠাকুমা। শিশুকালে পেটব্যথা কমাতেও এ পাতার রস কয়েকবার খেয়েছি। সেই পাতার রসটা খেয়ে বেশ আরামবোধ হতো। তখন ঠাকুমাও হয়তো ঠিক জানতেন না যে কৃমির কারণেও পেটে ব্যথা হতে পারে।

কবি নজরুল পার্কে নামফলকের পাশে লাগানো কয়েকটা পাথরকুচিগাছে ফোটা ফুলগুলোতে চোখ যেন আটকে গেল। যদিও পাথরকুচিগাছ সচরাচর চোখে পড়ে। তবে এর ফুল সহজে চোখে পড়ে না। কেননা শুধু শীতকালেই এই গাছে ফুল ফোটে। ফুলগুলো অন্য সব গাছের ফুলের মতো না। এ ফুল দেখতে বড়ই অদ্ভুত লাগে। গাছের মাঝখান থেকে একটা লম্বা ডাঁটির মতো পুষ্পদণ্ড খাড়া হয়ে ওপরে উঠে গেছে। সেই পুষ্পদণ্ডের মাথায় অধোমুখী হয়ে লণ্ঠনের মতো ঝুলছে গাঢ় লালচে গোলাপি রঙের ফুল। পুরো ফুলটাই ঝুলে থাকে মাটির দিকে মুখ করে।

ফুলগুলো লম্বা আঙুরের মতো থোকায় থোকায় ঝুলছে। ফুল প্রায় দেড় ইঞ্চি লম্বা। তবে ভেতরটা ফাঁপা। ফুলের বাইরের অংশ লালচে। তাতে রয়েছে লম্বা লম্বা সাদাটে আঁচড়ের মতো দাগ, এগুলো ফুলের বৃতি। চোঙ্গাকার চারটি বৃতির মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে ফুলের মেরুন লাল পাপড়ি। পাপড়িগুলোর গোড়া যুক্ত হলেও অগ্রভাগ খণ্ডিত বা বিযুক্ত। পাপড়ির ভেতরে লুকানো তার জননাঙ্গ। সেগুলো বাইরে থেকে চোখে পড়ে না। শীতকালে ফোটা এই ফুল থেকে গ্রীষ্মকালে পরিপক্ব ফল ও বীজ পাওয়া যায়।

পাথরকুচির গাছগুলো বেশ অদ্ভুত। সাধারণত গাছের বীজ বা ডাল থেকে চারা হয়। তবে পাথরকুচির চারা হয় পাতা থেকে। পাতাকে ভেজা মাটির ওপর শুইয়ে দিলে পাতার কিনারার প্রতিটি খাঁজ থেকে চারা বের হয়। বর্ষাকাল চারা গজানোর সবচেয়ে ভালো সময়। চারা ও গাছ কষ্ট সইতে পারে। বালি বা মাটি, কাঁকর বা নুড়ি যেখানেই হোক, পাথরকুচিগাছ বেঁচে থাকার চেষ্টা করে।

পাথরকুচি কেন এ গাছের নাম হলো? সেটা খুঁজতে গিয়ে কিছু মজার তথ্য পেলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম, পাথরের ফাঁকে ফাঁকে বা কংক্রিটের ওপরে জমা ময়লার মধ্যে এ গাছ জন্মাতে পারে বলে হয়তো এর নাম ‘পাথরকুচি’ হয়েছে। পরে দেখলাম, অয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য তার চিরঞ্জীব বনৌষধি বইয়ের চতুর্থ খণ্ডে পাথরকুচির আরও একটি নাম লিখেছেন, ‘পাষাণভেদ’। এটি পাথরকুচির সংস্কৃত নাম।

তিনি লিখেছেন, পাষাণভেদ নামের তাৎপর্য মনে হয় যে, দেহের ভেতরে বিশেষ আশয়ের অশ্ম অর্থাৎ পাথর হয়, তাকে ভিন্ন করে বা ভেঙে দেয় এই গাছ। তাই কি এর নাম পাষাণভেদ? পাষাণ মানে পাথর। আর ভেদ বা ভিন্ন অর্থ কুচি-কুচি করা। মূত্রথলির পাথরকে ভাঙতে সক্ষম পাথরকুচি। সেখান থেকেই মনে হয় এ গাছের বাংলা নামকরণ করা হয়েছে পাথরকুচি।

এ গাছের আরও তিনটি বাংলা নাম পেলাম। সেগুলো হলো পত্রিক পাথরকুচি, কফপাতা ও গাত্রপুরী। এ গাছের পাতার রস ঘি ও রসুন রসের সঙ্গে মিশিয়ে খেলে কাশি ও সর্দির উপশম হয় বলেই কি এর নাম কফপাতা? ফার্সি ভাষায় সর্দিকে বলে কফ। ইংরেজি নাম Kalanchoe বা Love Bush উদ্ভিতাত্ত্বিক নাম Kalanchoe Pinnata ও গোত্র ক্রাসুলেসি। এ দেশে কালাঞ্চো গণের আরও চারটি গাছ রয়েছে। এগুলো হলো লাল পাথরকুচি (Kalanchoe Blossfeldiana), হাজার পাথরকুচি (Kalanchoe Diagremontiana), সেরা পাথরকুচি (Kalanchoe Heterophylla) ও হিমসাগর (Kalanchoe Laciniata)।

পাথরকুচি একটি চিরসবুজ বিরুৎজাতীয় নরম পাতা ও কাণ্ডবিশিষ্ট উদ্ভিদ। পাতা রসালো, পুরু, উপবৃত্তাকার, কিনারা খাঁজকাটা ও লালচে সবুজ। কাণ্ডের গোড়া থেকে আগা পর্যন্ত গিঁটে গিঁটে পাতা জন্মে। পাতা মাটিতে রেখে দিলে কিনারা থেকে চারার জন্ম হয়।

লম্বা ডাঁটির মতো পুষ্পমঞ্জরিতে ফুল ফোটে। ফুলের রং লালচে-কমলা, চারটি বৃতির রং লালচে সবুজ, লণ্ঠনের মতো দেখায়। পাথরকুচি মাদাগাস্কারের গাছ হলেও এ দেশে ঔষধি গাছ হিসেবে বেশ মানিয়ে গেছে। লিখতে গিয়ে শেষে মনে প্রশ্ন এল, কাজী নজরুল ইসলাম তার গানে কেন ‘পাথরকুচি হার’-এর কথা লিখলেন? নজরুল লিখেছেন, ‘তার ভুরুর ধনুক বেঁকে ওঠে তনুর তলোয়ার, সে যেতে যেতে ছড়ায় পথে পাথর-কুচির হার।’ পুষ্পদণ্ডে ফোটা ফুলগুলো দেখতে আসলেই কি রত্ন বা পাথরের টুকরোর মতো?