
এ দেশে শীতকে বলে মিঠে শীত। ইউরোপ-আমেরিকার মতো এখানে শীতকালে বরফ পড়ে না, কুয়াশা পড়ে। খেজুরের রস আর কুয়াশা ছিঁড়ে উঁকি দেওয়া রোদের ওমে শীতের সকালটা মিঠে হয়ে ওঠে। আর সে সকালেই শিশিরে ভিজতে থাকে হলুদ গাঁদা ফুলেরা। পলাশ ফুল যেমন বসন্তের প্রতীক, তেমনি গাঁদা ফুল হলো শীতের।
শীতকাল ছাড়া গাঁদা ফুলের এমন উচ্ছ্বাস আর দেখা যায় না। গাঁদা ফুলের সেই উচ্ছ্বাস দেখলাম গত সপ্তাহে, নগর কৃষি মেলার স্টলে আর মেলায় আসা লোকজনের হাতে হাতে। গত সপ্তাহে ঢাকার মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে রাজধানী উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠে হয়ে গেল নগর কৃষি মেলা। সেখানে দেখা যায়, এক কিশোরী মেলায় প্রজাপতির মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে, এ স্টল থেকে ও স্টলে যাচ্ছে আর যাওয়ার সময় দুহাতে দুটো গাঁদা ফুল ফোটা গাছ নিয়ে যাচ্ছে- এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য আর কী হতে পারে?
আমাদের শিশুদের শ্যামলবন্ধু হয়ে ওঠা নিশ্চয়ই এক বড় সুসংবাদ। ধূলিধূসর এই নগরের বাড়ি, পথের পাশ, অফিস প্রাঙ্গণ ও নগর উদ্যান শীতের নানা রকম মৌসুমি ফুলে ভরে ওঠে। শীতের দিনের এমন দৃশ্য আর কোনো কালে চোখে পড়ে না।
ক্যান্টনমেন্টের ভেতর দিয়ে চলতে গিয়ে গাঁদা ফুলের রূপে চোখ জুড়িয়ে যায়। সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণ যেন গাঁদার সোনারূপে আলোকিত হয়ে ওঠে। রমনা উদ্যানের নার্সারির ভেতর রয়েছে ফালি ফালি গাঁদার বাগান।
গাঁদা আমাদের দেশে খুব সাধারণ এক মৌসুমি ফুল। মাত্র দুই-তিন মাসের জন্য সে আসে, আমাদের পুষ্পতৃষা মিটিয়ে আবার চলে যায়। একালে আমরা যে রকম বড় বড় গাঁদা ফুল দেখছি, অতীতে সে তেমন রূপবতী ছিল না। ফুলবিজ্ঞানীদের নানারকম গবেষণায় এখন গাঁদা ফুলের বাহারি জাতের উদ্ভব ঘটেছে।
ছোটবেলায় দেখতাম, বাড়িতে লম্বা গাছে ছোট ছোট গাঁদা ফুল ফুটত। ফোটার পর ফুলগুলো বেশ কয়েক দিন থাকত। ছোট ছোট অসংখ্য হলদে রঙের ফুলে ভরে থাকত গাছ, আমরা তাকে বলতাম পেতিগ্যান্দা। সে সময় কালচে-লাল রঙের আরও এক রকমের গাঁদা ফুটত, সে ফুলের গাছ হতো খাটো। আমরা তাকে বলতাম রক্তগাঁদা। একটু বড় হয়ে দেখলাম আরও বড় আকারের সর্ষে হলুদ ও কমলা রঙের গাঁদা ফুল। জানলাম ওর নাম রাজগাঁদা। আর যৌবন বয়স থেকে এখন দেখে আসছি, বড় বড় বলের মতো হাইব্রিড গাঁদা ফুল। যাকে সবাই বলছে, ইনকা গাঁদা। ইনকা গাঁদা এত বড় যে, খাটো খাটো গাছের ডালগুলো যেন ফুলের ভারে নুয়ে পড়তে চায়।
গাঁদা ফুল অ্যাস্টারেসি গোত্রের Tagetes গণের গাছ। ট্যাজেটাস ল্যাটিন শব্দ। এই শব্দটি এসেছে ইত্রুস্কান মিথোলজি থেকে। এর অর্থ হলো, যার জন্ম চাষের মাটি থেকে।
সারা পৃথিবীতে এ গণের প্রায় ৫০টি প্রজাতির গাছ আছে। আর জাত আছে হাজার হাজার। উদ্ভিদবিজ্ঞানী কার্ল লিনিয়াস ১৭৫৩ সালে এ গণের নামকরণ করেছিলেন। এ গণের প্রধানত ২টি প্রজাতির গাঁদা ফুল এ দেশে বেশি দেখা যায়- আফ্রিকান মেরিগোল্ড (Tagetes erecta) ও ফ্রেঞ্চ মেরিগোল্ড (Tagetes patula)। ফ্রেঞ্চ মেরিগোল্ড এ দেশে পেতিগ্যান্দা নামে পরিচিত।
গাঁদা গাছের ডাল কেটে মাটিতে পুঁতলেই সহজে গাছ হয়ে যায়। বীজ ছিটিয়ে দিলেও গাঁদার চারা উঠে। গাঁদা ফুলগাছ বিরুৎ প্রকৃতির গাছ। পাতা, বহুখণ্ডিত বা অনেক অনুপত্র দিয়ে একটি পত্রদণ্ডের দুই পাশে বিপরীতমুখী সাজানো থাকে।
অনুপত্রের কিনারা করাতের মতো খাঁজকাটা। গাছে ও পাতায় পশম আছে। কাণ্ড খাঁজকাটা। কাণ্ড থেকে ডালপালা ও শিকড় বের হয়। ফুলের রং প্রধানত হলুদ ও কমলা। তবে সাদা রঙের গাঁদা ফুলও আছে। এ দুই প্রজাতির সংকরায়নে বেশ কিছু হাইব্রিড জাতও সৃষ্টি হয়েছে। টকটকে মেরুন রঙের গাঁদা ফুলকে বলে রক্তগাঁদা বা চায়নিজ গাঁদা। মেরুন ও হলুদ রং মিশ্রিত গাঁদা ফুল জাম্বোগাঁদা নামে পরিচিত। যে জাতের ও রূপেরই হোক না কেন, গাঁদা শীত মৌসুমের এক রূপবতী ফুল। শত বছর আগেও সে (গাঁদা) কম রূপবতী ছিল না। তা না হলে কাজী নজরুল ইসলামের গানে কেন সেই ফুল আনার আবদার ফুটে উঠবে- ‘হলুদ গাঁদার ফুল, রাঙা পলাশ ফুল/ এনে দে এনে দে নৈলে রাঁধব না, বাঁধব না চুল।’
খোঁপায়, গলায়, বাসর ও অনুষ্ঠান সজ্জায়- কোথায় না এখন গাঁদা ফুলের মালা ব্যবহার হয়? তাই এখন আর সে শুধু বাগানে নয়, ফসলের মতো মাঠে বাণিজ্যিকভাবে তাকে চাষ করা হচ্ছে।