
‘সিস্তানের ঐ গুল-বাগিচা
গুলিস্তান্ আর বোস্তানে
দোস্ত হয়ে দখিন হাওয়া
কাঁদল সে আফশোস্-তানে।’
কাজী নজরুল ইসলামের ফণি-মনসা কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘দিল দরদি’ কবিতার এ পঙ্ক্তিগুলোর মধ্যে গোলাপের নাম ‘গুল’ আর গোলাপবাগানকে ‘গুল-বাগিচা’ বলা হয়েছে। গোলাপকে কবি কেন গুল বলে সম্বোধন করলেন? খুঁজতে গিয়ে দেখলাম, গুল একটি ফার্সি, পশতু ও তুর্কি শব্দ। যার অর্থ গোলাপ। গোলাপ ছিল কবি নজরুলের প্রিয় ফুল। তার অনেক গান ও কবিতা গুল বা গোলাপের সৌরভ মেখে আছে। ইংরেজি ‘রোজ’ থেকে বাংলা নাম গোলাপ হয়েছে। আদিকালে গোলাপের রংটা গোলাপিই ছিল। আর বুনোগোলাপ ছিল একসারি পাপড়ির। সে গোলাপে ছিল প্রেমের লাজুকতা প্রকাশের রং, আর প্রেম ছিল তার সৌরভ।
কবির একটি গানেও রয়েছে সেই প্রেম প্রকাশের আহ্বান: ‘গোলাপ-কপোল রাঙে গোলাপি লাজে/ হৃদয়-ব্যথার সুধা আছে তব কাছে/ রেখো না তারে ঢাকি॥’
অথবা নজরুলের অপ্রকাশিত ফুল-ছড়ি কবিতায় ‘গোলাপ-কুঁড়ির ডাক শুনেছে আজ বুঝি বুলবুল,/ তাই ত এত গুনগুনানি সব কাজই ভুল ভুল!’
গোলাপের রং আজ আর শুধু গোলাপি নেই। পৃথিবী এখন গোলাপের বহু জাত ও রঙে ছেয়ে গেছে। পৃথিবীতে এ পর্যন্ত অন্তত ৩৫০টি প্রজাতির ৩০ হাজার জাতের গোলাপের নাম জানা গেছে।
ঢাকার মিরপুরের জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে রয়েছে একটি সমৃদ্ধ গোলাপ বাগান। যেখানে রয়েছে প্রায় ৩০০ জাতের গোলাপ। গত সপ্তাহে গিয়েছিলাম ঢাকার আগারগাঁওয়ে ফ্যালকন নার্সারিতে। সেখানেও দেখলাম এক অপূর্ব গোলাপ রাজ্য। নার্সারির লোকজন জানিয়ে ছিলেন, তাদের সংগ্রহেও প্রায় ৩০০ জাতের গোলাপ আছে। কবি নজরুলের এত গোলাপপ্রীতির কথা মাথায় রেখেই টাঙ্গাইলের সখিপুর উপজেলার যাদবপুর গ্রামে কবি নজরুল পার্কে এক বিঘার একটা গোলাপ বাগান করা হয়েছে। সেখানে আমি লাগিয়েছিলাম শতাধিক জাতের গোলাপ। সে বাগানের নামও রাখা হয়েছে ‘গুল-বাগিচা’।
অধিকাংশ গোলাপ প্রজাতির আদি নিবাস এশিয়া। তবে অল্প কিছু জাতের উদ্ভব ইউরোপে ও উত্তর আমেরিকায়। গোলাপ রোজেসী গোত্রের অন্তর্ভুক্ত রোজা গণের গাছ। এটি একটি বহুবর্ষজীবী কাষ্ঠল গুল্ম প্রকৃতির গাছ। ডাল প্রতিবছর ছেঁটে দিলে গোলাপগাছ বহু বছর বাঁচে। গাছের কাণ্ড কাঁটাবিশিষ্ট, পাতার অগ্রভাগ সুচাল ও কিনারা সাধারণত খাঁজকাটা। অধিকাংশ গোলাপ ফুলের বৃতি পাঁচটি। ফুল ফুটলে বৃতি পাপড়ির নিচে আড়ালে চলে যায়। গোলাপি থেকে কালো কত যে রং ও রূপের গোলাপ আছে! গোলাপি, সাদা, হলুদ, ঘিয়ে, মেরুন, লাল, খয়েরি, কালচে লাল, কালো, বেগুনি, হালকা বেগুনি, কমলা, সিঁদুরে লাল ইত্যাদি নানা রঙের ও আকারের গোলাপ দেখা যায়। এ ছাড়া আছে দোরঙা ও মিশ্রবর্ণা গোলাপ। এ দেশে ডাবল ডিলাইট জাতটি বেশ জনপ্রিয়। একরঙা জাতের মধ্যে বড় আকারের তাজমহল গোলাপও অনেকে পছন্দ করেন। খুব ছোট ছোট গোলাপকে বলে মিনিয়েচার গোলাপ। এগুলোর গাছও খাটো। গাছে প্রচুর ফুল ফোটা অনেক জাত রয়েছে হাজারি গোলাপের। জার্মানির হিল্ডেশিম নামের একটি চার্চে রয়েছে হাজার বছর বয়সী একটি গোলাপগাছ। ক্যালিফোর্নিয়ার নিকিতা কে. রুলোক্সোফস্কি নামের এক ব্যক্তি এক জাতের গোলাপ ফুটিয়েছিলেন, যার ব্যাস ছিল প্রায় ৩৩ ইঞ্চি। সেটাই ছিল পৃথিবীতে এ পর্যন্ত ফোটা সবচেয়ে বড় আকারের গোলাপ। আবার আমেরিকার অ্যারিজোনা রাজ্যে একটি প্রাচীন গোলাপগাছ আছে। যার ঝোপ প্রায় ৯ হাজার বর্গফুট জায়গাজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে। সে গাছটি লাগানো হয়েছিল ১৮৮৫ সালে। তবে ২০২৪ সালে আমেরিকান রোজ সোসাইটির পুরস্কার জিতেছিল কমলা-গোলাপি রঙের একটি মিনিয়েচার গোলাপ। তাই শুধু আকার নয়, গোলাপের রং ও রূপ এক আকর্ষণের বিষয়। কোনো কোনো জাতের গোলাপের আবার মনবাহারি সৌন্দর্য থাকলেও সৌরভ থাকে না বা থাকলেও সেগুলো হয় মৃদুগন্ধি।
তারপরও নজরুলগীতির মতো গোলাপ যেন মনে নেশা লাগায়, ‘মনে সে শিরাজির নেশা লাগায়/ আঁখি-ইঙ্গিতে গোলাপ ফোটায়।’ শীতকাল এলে চোখে ও মনে যেন গোলাপের নেশা লাগে। শত-সহস্র গোলাপ ফুলে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে নগরের উদ্যানগুলো। অনেক বাড়ির বাগানেও গোলাপ ফুল দেখা যায়। এটি এ দেশের সাধারণ ফুল হলেও কোনো কোনো জাতের গোলাপের রূপ অসাধারণ। নেশার টানে গোলাপ এখন যশোর, ঝিনাইদহসহ দেশের বহু স্থানে বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হচ্ছে।
সাভারের বিরুলিয়ায়ও অনেক গোলাপের খেত দেখা যায়।