
‘চন্দ্রমল্লিকা, চন্দ্রমল্লিকা
চাঁদের দেশের পথ-ভোলা ফুল চন্দ্রমল্লিকা।
রঙ-পরীদের সঙ্গিনী তুই অঙ্গে চাঁদের রূপ-শিখা
ঊষর ধরায় আসলি ভুলে তুষার দেশের রঙ্গিনী
হিমেল দেশের চন্দ্রিকা তুই শীত-শেষের বাসন্তিকা
চাঁদের আলো চুরি ক’রে আনলি তুই মুঠি ভ’রে,
দিলাম চন্দ্র-মল্লিকা নাম তাই তোরে আদর ক’রে।’
কাজী নজরুল ইসলাম এ গানটি কবে লিখেছিলেন জানি না, তবে জানা যায় ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিলে এইচএমভি রেকর্ড কোম্পানি থেকে এ গানটির রেকর্ড বেরিয়েছিল, সুরকারও ছিলেন কবি নিজেই। সে সময় নজরুলের বয়স ছিল ৩৪ বছর ১০ মাস। গানটির মধ্যেই তিনি আদর করে চীনা ‘ক্রিসানথিমাম’ ফুলটির নাম দিয়েছিলেন ‘চন্দ্রমল্লিকা’।
সে বয়সে তিনি চন্দ্রমল্লিকার রূপ-রসে মুগ্ধ হয়ে কল্পলোকে ঘুরেছেন চাঁদের দেশে। চন্দ্রমল্লিকা ফুলের রূপকে তিনি তুলনা করেছেন চাঁদের শিখার সঙ্গে, যার সঙ্গিনী রঙ-পরীরা। চন্দ্রমল্লিকা যেন চাঁদের আলো মুঠো ভরে চুরি করে এনে নিজের দেহে ছড়িয়ে দিয়েছে। শীতে ফোটা ফুলগুলো যেন শীতকালেই পুষ্পোচ্ছ্বাসে টেনে এনেছে বসন্তের পুষ্পশোভা। সত্যিই চন্দ্রমল্লিকার ফুলের এরূপ দীর্ঘস্থায়ী প্রস্ফূরণের প্রাচুর্য খুব কম ফুলেরই আছে। এ দেশে শীতকাল আলো করে যে কয়েকটি ফুল, চন্দ্রমল্লিকা সেগুলোর মধ্যে সেরা।
চন্দ্রমল্লিকার আদি নিবাস চীনে হলেও তার শ্রীবৃদ্ধি ও বিকাশ বেশি ঘটেছে জাপানে। বিখ্যাত চীনা দার্শনিক কনফুসিয়াসের লেখা থেকে জানা যায়, প্রায় ৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে চীনে চন্দ্রমল্লিকা চাষ হতো ঔষধি গাছ হিসেবে। জানা যায়, ১৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে চীনে চন্দ্রমল্লিকা সপুষ্পক হার্ব হিসেবে বাগানে লাগানো হতো। ভারতবর্ষ ও আমাদের দেশে ঠিক কখন-কীভাবে চন্দ্রমল্লিকা ফুল এল, তার সঠিক কোনো ইতিহাস পাওয়া না গেলেও ১২৯০ খ্রিষ্টাব্দে শান্ত জ্ঞানেশ্বর রচিত মারাঠি ভাষার ‘জ্ঞানেশ্বরী’ গ্রন্থে চন্দ্রমল্লিকা ফুলের উল্লেখ পাওয়া যায়। বিভিন্ন হিন্দি গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে যে ষোড়শ শতকে মোগল আমলে ভারতবর্ষে চন্দ্রমল্লিকা ফুলের চাষ শুরু হয়, সপ্তদশ শতকে চন্দ্রমল্লিকা প্রবেশ করে ইউরোপে। সারা বিশ্বে চন্দ্রমল্লিকা ফুল এখন সুখ, ভালোবাসা, আনন্দ, দীর্ঘজীবন, চিরবিদায় ও রাজকীয়তার প্রতীক।
চন্দ্রমল্লিকা ফুলের ইংরেজি নাম ক্রিসানথিমাম, নামটি দুটি প্রাচীন গ্রিক শব্দ থেকে উদ্ভূত। ‘ক্রিয়স’ অর্থ সোনালি ও ‘অ্যান্থিমন’ অর্থ ফুল; এর অর্থ সোনালি ফুল। আদিকালে চন্দ্রমল্লিকার হয়তো শুধু সে রূপই ছিল। ১৭৫৩ খ্রিষ্টাব্দে লিনিয়াস প্রথম এ ফুলের মহাজাতির নামকরণ করেন Chrysanthemum, তখন তার প্রজাতি সংখ্যা ছিল মাত্র ১৪টি। সারা পৃথিবীতে ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে চন্দ্রমল্লিকার প্রজাতিসংখ্যা পাওয়া যায় ৪২টি। ভারতবর্ষে চাষ হওয়া চন্দ্রমল্লিকার দেশীয় আদি প্রজাতিটি হলো Chrysanthemum indicum, এ প্রজাতির ফুলের রং প্রধানত সোনালি-হলুদ। চন্দ্রমল্লিকা একটি বহুবর্ষজীবী ও বহুশাখায়িত বিরুৎ শ্রেণির উদ্ভিদ। গাছ ৫০ থেকে ১০০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। পাতার কিনারা গভীরভাবে খাঁজকাটা। ডালের মাথায় অনেকগুলো ফুল ফোটে শীতকালে। ফোটার পর ফুলগুলো বেশ কয়েক দিন থাকে। চন্দ্রমল্লিকা বাগানে ও টবে লাগানো যায়।
১৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে সারা পৃথিবীতে চন্দ্রমল্লিকার নথিভুক্ত প্রজাতির সংখ্যা ছিল ৫০০টির বেশি। বর্তমানে সারা পৃথিবীতে ২০ হাজারের বেশি জাত রয়েছে। নানা আকারের, আকৃতির, চেহারার ও রঙের চন্দ্রমল্লিকা ফুল এখন বাংলাদেশেও বিভিন্ন বাগানে, বাড়িতে ও নার্সারিতে দেখা যাচ্ছে। হলুদ ও সাদা ফুলের চন্দ্রমল্লিকা ফুলগুলো দেখতে বেশ সুন্দর। তবে ফুলটি লাল, গোলাপি, কমলা, খয়েরি, মেরুন, সোনালি, বেগুনি, হলুদ, মিশ্র বর্ণের প্রায় সব রঙের হয়। এমনকি মালয়েশিয়ায় গিয়ে সবুজ রঙের চন্দ্রমল্লিকাও দেখেছি। সব রঙের ফুলই ফোটে শীতকালে। অক্টোবরে গাছগুলোয় কুঁড়ি আসে, নভেম্বর-ডিসেম্বর থেকে ফুল ফুটতে শুরু করে। বসন্ত পর্যন্ত কোনো কোনো গাছে ফুল ফুটতে দেখা যায়। অন্য ফুলের সঙ্গে এর মূল পার্থক্যটা হলো, চন্দ্রমল্লিকার ফুল ফোটার পরও বহুদিন, এমনকি এক মাস পর্যন্ত সজীব থাকে। তাই কাট ফ্লাওয়ার হিসেবে ফুলদানির জন্য উত্তম।
জলবসা মাটি চন্দ্রমল্লিকাগাছ মোটেই সইতে পারে না। বীজ, শাখা কলম ও সাকার থেকে চন্দ্রমল্লিকার চারা তৈরি করা যায়। সম্প্রতি সাভারের বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের প্ল্যান্ট বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ডিভিশন টিস্যু কালচার পদ্ধতিতে চন্দ্রমল্লিকার চারা তৈরির প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। গাজীপুরের বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট চন্দ্রমল্লিকার ‘বারি চন্দ্রমল্লিকা ১’ ও ‘বারি চন্দ্রমল্লিকা ২’ নামে দুটি উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছে।
চন্দ্রমল্লিকা ফুলের কথা লিখতে গিয়ে শেষে হঠাৎ তারাপদ রায়ের ভুল কবিতাটির কয়েকটা লাইন মনে পড়ল- ‘কোনটা যে চন্দ্রমল্লিকার ফুল/আর কোনটা যে সূর্যমুখী/বারবার দেখেও/আমার ভুল হয়ে যায়/আমি আলাদা করতে পারি না।’ চন্দ্রমল্লিকা ফুলের মাঝখানে একটি ছোট্ট চাকতি, সে চাকতি থেকে চারদিকে রশ্মির মতো ছড়ানো পাঁপড়ি। এমন চেহারা আছে তো জারবেরা, অ্যাস্টার, টিথোনিয়া, জিনিয়া, গাজানিয়া ও সূর্যমুখী ফুলেরও। পাশাপাশি না রেখে এসব ফুল দেখলে ভুল তো হতেই পারে!