
‘চার-পাঁচ বছর আগেও পরিযায়ী পাখির কলকাকলিতে মুখর থাকত বাইক্কা বিল। তখন জলাশয়গুলোর পাশে দাঁড়ালেই পাখির হাক-ডাক ও খেলাধুলা চোখে পড়ার মতো ছিল। কিন্তু সেইসব দৃশ্য এখন আর চোখে পড়ে না। দেশের নানা প্রান্ত থেকে এখানে মানুষজন এসে হতাশ হচ্ছেন।’ কথাগুলো বলছিলেন পরিবেশকর্মী ও লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ইকো ট্যুর গাইড সাজু মারছিয়াং।
আক্ষেপের সুর ছিল সুনামগঞ্জ থেকে আসা চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী আদিবা আনমের কথায়। সে বলে, ‘বড়দের কাছে শুনতাম শীতের সময় বাইক্কা বিলে প্রচুর অতিথি পাখি আসে। এবার এসেছি পাখি দেখতে। কিন্তু খুব বেশি পাখি চোখে পড়েনি। পাখিদের জলকেলির দৃশ্য থেকে আমরা বঞ্চিত হয়েছি।’
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে পাখিদের অভয়াশ্রম হাইল হাওরের বাইক্কা বিল। পাখিরাজ্যের সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রতিদিন প্রচুর পাখিপ্রেমী এখানে ভিড় করেন। গত রবিবার বিকেলে বাইক্কা বিলে গিয়ে দেখা যায়, পাখির দল বিলের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ঝাঁক বেঁধে উড়ছে, ডাকাডাকি করছে। কিন্তু অন্য বছরের তুলনায় এ বছর ঝাঁক বেঁধে পাখি ওড়ার সংখ্যা অনেক কম।
স্থানীয় ও দর্শনার্থীরা জানান, এ বছর পরিযায়ী পাখি অন্যবারের তুলনায় অনেক কম। আগের চেয়ে বিল অনেকটা ভরাট হয়ে গেছে। পদ্মপাতা ও বিভিন্ন ধরনের জলজ উদ্ভিদ কম থাকায় দেখা দিয়েছে খাদ্যসংকট।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এলাকার কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা জানান, বিল থেকে লুকিয়ে মাছ ধরা হয়। এ ছাড়া গোপনে অনেকে পাখি শিকার করে বিক্রি করেন।
পাখিপ্রেমী আব্দুর রব রঞ্জু বলেন, ‘বর্তমানে বিল ভরাট ও খাদ্যের অভাবে পাখিরা আগের মতো এ বিলকে নিরাপদ মনে করছে না। অতিথি পাখিরা এখানে আসে ঠিকই, থাকার পরিবেশ না পেয়ে জেলার বিভিন্ন লেক ও জলাশয়ে চলে যায়।’
স্থানীয় পরিবেশকর্মী সোনিয়া মান্নান বলেন, ‘পরিযায়ী পাখি যেভাবে থাকার কথা, সেভাবে কিন্তু এখন আর নেই। এ বছর এখানে এসে বিল জুড়ে অল্পসংখ্যক পাখি দেখেছি। আমি হতাশ।’
বাইক্কা বিল দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা বড়গাঙ্গিনা সম্পদ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি মিন্নত আলী বলেন, ‘কচুরিপানা সরে গিয়ে বাইক্কা বিল প্রায় ফাঁকা হয়ে গেছে। পাখিরা এসব কচুরিপানা ও বিভিন্ন জলজ উদ্ভিদের ওপরেই বেশির ভাগ সময় থাকে। বিলের কিছু অংশে শাপলা-পদ্ম টিকে থাকলেও জলজ উদ্ভিদ প্রায় নেই। এতে পাখির আনাগোনা কমেছে।’
পাখি শিকারের বিষয়টি জানতে চাইলে মিন্নত আলী বলেন, ‘স্থানীয় কিছু মানুষ শিকারের সঙ্গে জড়িত। আগে শিকারির উৎপাত ছিল। এখন সেটা নেই। তবে বিলে নৌকা নিয়ে প্রায়ই চলাচল করতে দেখা যায়, যা পাখির জন্য খুবই ভয়ানক বিষয়।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বাপার জাতীয় পরিষদের সদস্য আ স ম সালেহ সোহেল বলেন, ‘পাখিরা বাইক্কা বিলকে আর নিরাপদ ভাবছে না। সেই সঙ্গে নিয়ম না মেনে বিলের আশপাশে ফিশারি তৈরি করা হচ্ছে। এতে জলজ বন হারিয়ে যাচ্ছে। জীববৈচিত্র্য রক্ষা করে স্থানটিকে নিরাপদ রাখতে পারলে সারা বছর এখানে পাখি থাকবে। এগুলোর দিকে প্রশাসনিক তৎপরতা বাড়ানোর দাবি জানাচ্ছি।’
বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ মৌলভীবাজারের সহকারী বন সংরক্ষক জামিল মোহাম্মদ খান বলেন, আমরা বাইক্কা বিলে পাখির নিরাপত্তার বিষয়টি দেখছি। মানুষকে সচেতন করতে সে রকম প্রচার কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।