ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আসাম রাজ্যের ডিমা হাসাও জেলার পাহাড়ঘেরা এক ছোট্ট গ্রাম জাতিংগা। নামটি সাধারণ হলেও এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক ভয়াবহ, রহস্যে মোড়া ও বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের উপাদানে পূর্ণ ঘটনা। যা বহু বছর ধরে বিশ্বের নজর কেড়েছে।
এখানে বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে আকাশ থেকে হঠাৎ করে শত শত পাখি নেমে আসে, ঝাঁকে ঝাঁকে নিচে পড়ে যায়, মরে যায় কিংবা হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে থাকে।
প্রতিবছর সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়, সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত, এই পাখিদের রহস্যময় দৃশ্য দেখা যায়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো- এ ঘটনা শুধু জাতিংগা গ্রামের মাত্র ১ দশমিক ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি নির্দিষ্ট এলাকাতেই ঘটে। এমনকি এই এলাকা পেরোলেই পাখিগুলোর ওপর এই 'আত্মঘাতী প্রভাব' আর কাজ করে না।
এই ঘটনায় প্রধানত যে সব পাখিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাদের মধ্যে রয়েছে- টাইগার বিটার্ন, ব্লু ব্রেস্টেড কিংফিশার, ইন্ডিয়ান পিট্টা, ব্ল্যাক ড্রংগো ইত্যাদি। পাখিগুলোর বেশিরভাগই পরিযায়ী এবং এদের অনেকেই বিলুপ্তপ্রায়।
প্রথমদিকে স্থানীয় মানুষজন এই ঘটনাকে ভৌতিক বা অতিপ্রাকৃত বলে মনে করত। তারা বিশ্বাস করত, জাতিংগা অভিশপ্ত, আর এই পাখিগুলো যেন অপদেবতা দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে আত্মহত্যা করছে। অনেক সময় পাখিগুলোকে ডাইনির চিহ্ন হিসেবে ধরে নিয়ে পিটিয়ে মারা হত।
তবে কালের পরিবর্তনে, আজকের বিজ্ঞান এই রহস্যের যুক্তিসম্মত ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, জাতিংগার ভৌগোলিক অবস্থান, হঠাৎ বৃষ্টির পর ঘন কুয়াশা, এবং গ্রামের আলো- এই তিনটি উপাদান একত্রে পাখিদের দিশেহারা করে তোলে। সন্ধ্যায় কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশে আলো দেখা মাত্র পাখিরা বিভ্রান্ত হয়ে নিচের দিকে নেমে আসে। আলো তাদের চোখে আকর্ষণ সৃষ্টি করে এবং তারা অবচেতনে আলোকে অনুসরণ করতে থাকে, যা শেষমেশ তাদের পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
আরও চমকপ্রদ বিষয় হলো- এই আলো যদি নিভিয়ে দেওয়া হয়, তবে এই 'আত্মহত্যা' বন্ধ হয়ে যায়। ফলে এটি প্রমাণিত হয় যে, প্রকৃতপক্ষে এটি আত্মহত্যা নয়, বরং একটি বিভ্রান্তিকর পরিবেশগত প্রতিক্রিয়া।
তবে প্রশ্ন থেকেই যায়, সব তথ্য ও যুক্তি থাকার পরও কেন এই নির্দিষ্ট এলাকা আর এই নির্দিষ্ট সময়েই এমন ঘটনা ঘটে? কেন অন্যান্য পাহাড়ি অঞ্চলে এমনটা হয় না? উত্তর এখনও পুরোপুরি নিশ্চিত নয়। এ বিষয়ে বিজ্ঞানের অনুসন্ধান এখনও চলমান।
বর্তমানে আসাম সরকারের উদ্যোগে এ ঘটনাটি নিয়ে ব্যাপক গবেষণা হচ্ছে এবং সচেতনতা বৃদ্ধির প্রচার চালানো হচ্ছে। পাখি সংরক্ষণ কর্মী ও পরিবেশবিদরা স্থানীয়দের বোঝাচ্ছেন, এটি কোনো অলৌকিক ঘটনা নয় বরং একটি বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা। ফলে এখন পাখি নিধনের ঘটনা অনেকাংশে কমেছে।
বর্তমানে জাতিংগা একটি বৈজ্ঞানিক ও পর্যটন আকর্ষণের স্থান। প্রতিবছর হাজারো পাখিপ্রেমী, বিজ্ঞানী ও পর্যটক এখানে ভিড় করেন এই রহস্যময় দৃশ্যের সাক্ষী হতে। এই আগ্রহ যেমন অর্থনৈতিক সম্ভাবনা বাড়াচ্ছে, তেমনি পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টাও জোরদার হচ্ছে।
এই রহস্যময়তা জাতিংগাকে ঘিরে রেখেছে এক অদ্ভুত মোহে। যেখানে প্রকৃতি তার নিজস্ব নিয়মে খেলে চলেছে।
মেহেদী/