বসন্তের বিদায়ে গ্রীষ্মের অগ্নিঝরা সূর্যের তাপে যখন প্রকৃতি হুমড়ি খেয়ে পড়ে ক্লান্তির কোলে, তখনই আকাশজুড়ে নিঃশব্দে নেমে আসে এক বেগুনি আভা। মাটি থেকে মাথা তুলে দাঁড়ানো প্রতিটি জারুলগাছ যেন হয়ে ওঠে রঙের নির্জন উৎসব। ক্যাম্পাসজুড়ে তখন বেগুনি পাপড়ির আলপনা- যা চোখে নয়, মনে গেঁথে যায়।
বিশেষত যখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা আসে তখন প্রকৃতি বরাবরই এক অনবদ্য কবিতার নাম। এখানে চারদিকে ছড়িয়ে থাকা লেকের জল, সবুজ গাছ-গাছালি যেন ঋতুবদলের গদ্যপদ্য। আর এই ছন্দময় সৌন্দর্যের মধ্যমণি হয়ে ওঠে জারুল, নীলচে-বেগুনি রঙে সেজে ওঠা গ্রীষ্মের অপরূপ রানী।
সর্পিল গতিতে চলা লেকের ধারে, খেলার মাঠের পাশে কিংবা বটতলা, চৌরঙ্গী, পুরান কলা, সুইজারল্যান্ড, শান্তিনিকেতন বা মুক্তমঞ্চের ছায়াঘেরা পথ ধরে হাঁটতে গেলে চোখ আটকে যায়- নিভৃতে দাঁড়িয়ে থাকা জারুল গাছে। মাথা উঁচু করে থাকা ডালগুলো যেন ক্যানভাস হয়ে উঠেছে বেগুনি পাপড়ির। সেই পাপড়ির ভাঁজে ভাঁজে উঁকি দেয় নরম হলুদ পরাগ, যা সূর্যছায়ার খেলায় দিগন্ত ছুঁয়ে যায়। এই রঙিন উপস্থাপনাকে শুধুই ফুল বলা যায় না; এ যেন এক মৌন সিম্ফনি, যা ছড়িয়ে পড়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মনে। আকর্ষিত করে বহিরাগত পর্যটকদের।

হাঁটতে হাঁটতে জারুলতলায় দেখা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী ইসতিয়াক আহমেদ রাতুলের সাথে। তার কাছে প্রকৃতির এই অপরূপ সৌন্দর্যের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জারুল ফুল ফোটে মানেই ক্যাম্পাসে এক ধরনের নিঃশব্দ উল্লাস শুরু হয়। মনে হয়, প্রকৃতি আমাদের হাতে রঙতুলি তুলে দিয়ে বলছে- আঁকো, ভাবো, ভালোবাসো। প্রকৃতির এই আহ্বানে আমরাও নতুন করে নবরূপে নব আঙ্গিকে ক্যাম্পাসকে ভালোবাসতে শুরু করি।’
জারুলের রঙ গায়ে মেখে হাঁটে যারা, তাদের মনে গেঁথে যায় এই ক্যাম্পাসের ছায়া-জল-রোদ্দুর। কেউ কেউ গাছতলায়, পুকুরপাড় বা লেকপাড়ে বসে লেখে কবিতা, কেউ আবার বন্ধুর কাঁধে মাথা রেখে গুনগুনিয়ে গায় রবীন্দ্রসংগীত। অনেকেই দলবেঁধে করে আড্ডাবাজি।
নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী ঐন্দ্রিলা মজুমদার বলেন, ‘জারুলকে আমরা শুধু ফুল হিসেবেই নয়, এটা আমাদের শিল্পচর্চার মৌসুমি মিউজিক হিসেবেও চিনি। ক্লাসে ঢোকার আগে কিংবা থিয়েটার অনুশীলনের ফাঁকে যখন বেগুনি ফুলটি চোখে পড়ে, তখন মনে হয় জীবনটা থেমে থেকে একটু রঙ খুঁজে নেয়। সজীবতা ফিরে আসে সকল কাজে।’
জাহাঙ্গীরনগরের এই ফুলেল রূপ শুধু সৌন্দর্যের প্রতীক নয়, বরং আবেগ, সৃজনশীলতা ও আত্মস্থতারও বাহক। জারুলের নিচে বসে কেউ করছে স্কেচ, কেউ লিখছে কবিতা, কেউ আবার তন্ময় হয়ে তাকিয়ে আছে দূর আকাশে- হারিয়ে গেছে অজানা জগতে।
গবেষণা বলছে, প্রকৃতির সান্নিধ্য মানসিক স্বাস্থ্য উন্নত করে। আর জাহাঙ্গীরনগর যেন তার জীবন্ত প্রমাণ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. রেজাউল করিম তালুকদার (তারেক রেজা) বলেন, ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কবিতার মতো সুন্দর। প্রতি পঙক্তিতে ছড়িয়ে আছে অপার রহস্য! জারুলের প্রাণখোলা উচ্ছ্বাস আমাদেরকে উদ্বেলিত করে প্রতিনিয়ত। জারুল ফুল শুধু চোখ জুড়ায় না, এর আশপাশে গড়ে ওঠা নিসর্গ শিক্ষার্থীদের আবেগি করে তোলে। ক্লাসে তারা যা ভাবতে পারে না, প্রকৃতির কোলে এসে তা ভাবতে শেখে।’
গ্রীষ্মের শেষে যখন গাছে গাছে ফোটে নীলচে-বেগুনি জারুল, তখন গোটা ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়ে এক রঙিন নীরবতা। শিক্ষার্থীরা নীরবতা ভেঙে নিঃশব্দে বসে আঁকে মনস্তত্ত্বের প্রতিচ্ছবি। কবিতার উপমা খোঁজে, সহপাঠীদের হাসি-ঠাট্টা আর গানের সুরে সুরে তৈরি হয় এক আত্মিক আবহ। প্রকৃতির এই নিবিড় সাহচর্য শুধু চোখের আরাম নয়, মনেরও বিশ্রাম।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ছালেহ আহমেদ খান বলেন, ‘জারুল গাছ স্থানীয় পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষায়, সৌন্দর্যবর্ধনে এবং বিভিন্ন রোগ নিরাময়ে গুরুত্বপূর্ণ। এর আকর্ষণীয় ফুল পরাগবাহী মৌমাছির জন্য খাদ্য সরবরাহ করে, যা স্থানীয় পরিবেশে পরাগায়ন প্রক্রিয়াকে সক্রিয় রাখে। একই সঙ্গে বড় গাছ হিসেবে কার্বন শোষণ করে এবং শহুরে উষ্ণতা কমাতে সহায়তা করে। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রকৃতির সংস্পর্শে মনোযোগ ও সৃজনশীলতা বৃদ্ধি পায়। জাহাঙ্গীরনগরে জারুলফুলের প্রাচুর্যতা শুধু ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য বৃদ্ধিই করে না, বরং এক ধরনের মননচর্চার পরিবেশও গড়ে তোলে।’
জাহাঙ্গীরনগরের প্রতিটি ঋতুরই নিজস্ব ভাষা আছে। কিন্তু গ্রীষ্মে জারুলের ভাষা যেন সবচেয়ে সংবেদনশীল। মৃদু বাতাসে দুলে ওঠা প্রতিটি থোকা যেন বলে, ‘এখনো রঙ ফুরায়নি, এখনো স্বপ্ন বাকি আছে।’

জারুল ফুটে ওঠা মানেই জাবির বুকে একটি নতুন গল্পের সূচনা। যে গল্পে বেদনা নেই, আছে কেবল রঙ, প্রেম আর প্রতিদিনের একান্ত কিছু অনুভব। আর তাই প্রতিটি জারুলের নিচে দাঁড়িয়ে যারা ছবি তোলে, তারা শুধু স্মৃতি জমায় না, বরং প্রকৃতিকে জানায় নীরব ধন্যবাদ।’
জাহাঙ্গীরনগরের আকাশ যখন জারুলের বেগুনিতে ঢেকে যায়, তখন সেই রঙ পড়ে না কেবল চোখে— পড়ে মনে। ছুঁয়ে যায় অন্তরের গোপন কোনো প্রান্ত, যেখানে এখনো স্বপ্ন ফোটে, এখনো রঙ থেমে যায়নি।
তাওফিক/