বিলের তাজা মাছ খাওয়ার আশায় গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের আমরা কজন শিক্ষক আমাদের বিভাগের অধ্যাপক জীবন চন্দ্র দাসের গ্রামের বাড়ি সদর থানার বাড়িয়া এলাকায় অবস্থিত গাজীপুরের বিখ্যাত বেলাই বিলে একটি প্রাকৃতিক মৎস্যাধার (স্থানীয় ভাষায় বলে ডাঙা) বন্দোবস্ত নিয়েছিলাম। এ বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি দুপুর ১২টা নাগাদ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে অটোরিকশাযোগে ড. জীবনের বাড়ির উদ্দেশে রওনা হলাম। বিকেলে মাছ ধরা হবে। গাজীপুর সদর পেরিয়ে অটোরিকশা যখন গ্রামের রাস্তা ধরে চলা শুরু করল, তখন চালককে বললাম কিছুটা ধীরে চালাতে। রাস্তার দুই পাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে যাচ্ছি। মাঝে মাঝেই অটো থামিয়ে ছবি তুলছি। এভাবে চলতে চলতে ড. জীবনের গ্রামের বাড়িতে পৌঁছাতে দুপুর ১টা ৪০ বেজে গেল। এরপর তার পীড়াপীড়িতে দ্রুত দুপুরের খাবার সারলাম।
কয়েক বছর আগেও একবার জীবনের গ্রামের বাড়িতে এসেছিলাম। কাজেই ওর গ্রামের আশপাশটা কিছুটা চেনা আছে। দুপুরের খাবার সেরে ডাঙায় যাওয়ার আগে আশপাশটায় একটু ঢুঁ মারতে বের হলাম। হাতে অবশ্য তেমন কোনো ভালো ক্যামেরাও নেই। আর এই ভরদুপুরে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য পাখি দেখার সম্ভাবনাও কম। যা হোক সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। এখান থেকে বেলাই বিল চোখে পড়ছে। এখন শীতকাল, বিলে তেমন একটা পানি নেই। বিকেলে তো ওখানে যাবই, তাই আমার অনুসন্ধিৎসু চোখ দুটিকে ওদিক থেকে ঘুরিয়ে এনে আশপাশের গাছগাছড়ার দিকে, পাতার ফাঁকে নিবদ্ধ করলাম।
আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, ঠিক তার সামনে একটি গাবগাছ। গাছের কাছে গেলাম, ঘন পাতার কারণে ভেতরটা কিছুটা অন্ধকার। সঙ্গে থাকা দু-একজন বলল, ‘স্যার, বেশি ভেতরে যাবেন না, পুরোনো গাবগাছ, সাপ থাকতে পারে।’ আমি বললাম, তাহলে তো ভলোই হয়, দু-একটা ক্লিক করে নেওয়া যাবে। তবে চিন্তার কোনো কারণ নেই, এখন শীতকাল, ওরা শীত নিদ্রায় আছে। গাছের ডালাপালা ভালো করে পরীক্ষা করছি। আমার বিশ্বাস, কোনো না কোনো রাতের শিকারি পাখিকে এখানে পাবই। যা ভেবেছি তাই। খানিকটা খুঁজতেই ঘন পাতার আড়ালে কিছু একটাকে বসে থাকতে দেখলাম। কিন্তু এই সাধারণ ক্যামেরা দিয়ে এত কম আলোতে ওর ছবি তোলা বেশ কঠিন। তা ছাড়া ঘুমকাতুরে পাখিটি কোনোভাবেই চোখ খুলছে না। ধীরে ধীরে অতি সাবধানে ওর কিছু ছবি তুললাম। কারণ কোনো ঘুমন্ত প্রাণীকে বিরক্ত করা মোটেও ঠিক হবে না। এর মধ্যে হঠাৎই একবার ও আমার দিকে রাগত দৃষ্টিতে তাকাল। আমি দ্রুত দুটি ক্লিক করে ঘুমকাতুরে পাখিটিকে আর বিরক্ত না করে গাবগাছের নিচ থেকে বেরিয়ে এলাম।
বেলাই বিলের পাশের গাবগাছে দেখা ঘুমকাতুরে পাখিটি আর কেউ নয়, এ দেশের সচরাচর দৃশ্যমান ও স্বল্প ঝুঁকিসম্পন্ন আবাসিক পাখি কু-পোখ। এটি কালো প্যাঁচা, কু-প্যাঁচা বা বাদামি প্যাঁচা নামেও পরিচিত। পশ্চিমবঙ্গে ওর নাম কাল প্যাঁচা। ইংরেজি নাম Brown Boobook, Burmese Hawk-owl ev Brown Hawk-owl। স্ট্রিজিডি বা উল্লুক গোত্রের প্যাঁচাটির বৈজ্ঞানিক নাম Ninox scutulata। বাংলাদেশ ছাড়াও প্যাঁচাটিকে দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে দেখা যায়।
প্রাপ্তবয়স্ক কু-পোখের দেহের দৈর্ঘ্য ২৭ থেকে ৩৩ সেন্টিমিটার, প্রসারিত ডানা ৭০ থেকে ৮৫ সেন্টিমিটার। আর ওজন ১৭০ থেকে ২৩০ গ্রাম। বাজপাখির মতো ছিপছিপে দেহ, লম্বা লেজ ও তুলনামূলকভাবে ছোট মাথা। কাঁধে সাদা ছিটসহ দেহের ওপরটা লালচে বাদামি। সাদাটে বুক ও পেটে মরচে-বাদামি দাগ। গাঢ় বর্ণের মাথা ও চিবুক। গোলাকার চোখের রং হলদে। কালচে চঞ্চুতে সাদা ছিট। পা ও পায়ের পাতা হলুদ। প্যাঁচা-পেঁচি দেখতে একই রকম।
এরা দেশজুড়ে বন, বাগান, বৃক্ষবহুল এলাকায় বিস্তৃত। সচরাচর একাকী বা জোড়ায় বিচরণ করে। দিনের বেলা গাছের ডালে পাতার আড়ালে বসে ঘুমায়। রাতে নিজের আবাসস্থলের আশপাশে খাবার খোঁজে। পোকামাকড়সহ ছোট পাখি, পাখির ডিম ও ছানা, নেংটি ইঁদুর ইত্যাদি ধারালো নখে গেথে শিকার করে খায়। এই পাখির ব্যাপক পরিবেশগত গুরুত্ব রয়েছে। কারণ এরা ফসলের জন্য ক্ষতিকারক প্রাণী, যেমন ইঁদুর, পাখি, কীটপতঙ্গ ইত্যাদির সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে স্থানীয় বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষা করে। তা ছাড়া আবাস্থলের স্বাস্থ্য ও গুণগত মান রক্ষার নির্দেশক হিসেবে এবং ফল খাওয়ার মাধ্যমে বীজ বিস্তারেও সাহায্য করে। রাতে মনোরম সুরে ‘হুওয়াপ-হুওয়াপ-হুওয়াপ…’ শব্দে ডাকে।
মার্চ থেকে জুন প্রজননকাল। এ সময় ভূমির ৫ থেকে ২০ মিটার উচ্চতায় গাছের কোটরে বাসা বানায়। একই বাসা বছরের পর বছর ব্যবহার করে। পেঁচি প্রতি মৌসুমে ৩ থেকে ৫টি সাদা রঙের ডিম পাড়ে ও তাতে একাই তা দেয়। ডিমে তা দেওয়ার সময় প্যাঁচা পেঁচিকে খাওয়ায়। ডিম ফোটে ২৪ থেকে ২৫ দিনে। প্যাঁচা-পেঁচি মিলেমিশে ছানাদের যত্ন করে। ছানারা ২৪ থেকে ২৭ দিন বয়সে উড়তে শেখে ও বাসা ছাড়ে। আয়ুষ্কাল প্রায় ১০ বছর।
লেখক: পাখি ও বন্যপ্রাণী প্রজনন ও চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ, গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়