ঢাকা ২৮ আষাঢ় ১৪৩২, শনিবার, ১২ জুলাই ২০২৫
English

১৬ ইঞ্চি কলাগাছে ৭ মোচা

প্রকাশ: ১৮ মে ২০২৫, ১০:১৬ এএম
১৬ ইঞ্চি কলাগাছে ৭ মোচা
ছবি : খবরের কাগজ

কু‌ড়িগ্রামের রাজারহাটে ১৬ ইঞ্চি উচ্চতার একটি কলাগাছে সাতটি মোচা ধরেছে। এই ছোট গাছে একসঙ্গে এতগুলো মোচা দেখতে মানুষ ভিড় করছেন নুরজ্জামালের বাড়িতে।

এলাকাবাসী জানান, উপজেলার চাকিরপশার ইউনিয়নের নাককাটিহাট বাজারের অদুরে উত্তর দিকে চাকিরপশার উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সঙ্গে নুরজ্জামালের বাড়ির পাশে একটি ১৬ ইঞ্চি কলারগাছে সাতটি মোাচা বের হয়।

শনিবার (১৭মে) দুপুরের দিকে বিষয়টি চোখে পড়ে বাড়ির লোকজনের।

বিষয়টি এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে শত শত মানুষ তা দেখতে আসেন।

সোনাবর এলাকার গায়ক ত্রৈলোক্যনাথ রায় (৫২) বলেন, ‘এতো ছোট কলাগাছে সাতটি মুখজওয়ালা (মোচা) গাছ কখনো দেখেনি। এই প্রথম আমার জীবনে দেখা।’

সেকেন্দার আলী নামের এক ব্যক্তি বলেন, ‘এটা গজবের লক্ষণ’। 

রাজারহাট উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাইফুন্নাহার সাথী বলেন, এখানে অনেক বেশি পরাগায়ন হয়ে গেছে। এজন্য হয়তো এতগুলো মোচা হয়েছে। তবে এ দৃশ্য খুবই দুর্লভ।

ম্লান আলোকে ফোটা গোলকচাঁপা

প্রকাশ: ১১ জুলাই ২০২৫, ১১:০১ এএম
ম্লান আলোকে ফোটা গোলকচাঁপা
বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রের বৃক্ষমেলার একটি স্টলে নতুন জাতের গোলকচাঁপা ফুল। ছবি: লেখক

আকাশে সূর্য আছে, তবে তার রোদ আষাঢ়ের মেঘেরা আড়াল করে ম্লান করে দিয়েছে। সকাল থেকে থেমে থেমে সে মেঘ থেকে বৃষ্টি ঝরছে। বৃষ্টির ফোঁটা একটা গাছের ফুল ও পাতায় জমেছে হীরের কুচির মতো। মেঘ ছিঁড়ে রোদ উঠলেই সেগুলো ঝিলিক দিচ্ছে। কাঠগোলাপ ফুলের এমন মধুময় সৌন্দর্য! আহা, নিবিড়ভাবে ওর রূপটা কখনো দেখা হয়নি। শুধু সেসব গাছের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় গোধূলিবেলার ম্লান আলোকে তার মাতাল করা তীব্র সুমিষ্ট ঘ্রাণ টের পাই। সেন্ট্রাল রোড ধরে গ্রিন রোডের দিকে হেঁটে যেতে যেতে বহুবার একটা বাড়ির সামনে থাকা প্রাচীন বুড়ো গাছের কাঠগোলাপ ফুল তার সৌরভের ভেলকি দেখিয়েছে। আবার ওই রোড ধরে ভোরবেলায় ধানমন্ডি লেকে হাঁটতে যাওয়ার সময় গাছটার তলায় দেখেছি দেশি কাঠগোলাপের অনেক ঝরা ফুল। ছোটবেলায় এ রকম ঝরে যাওয়া ফুল কুড়িয়ে সাঝি ভরতাম।

গত ৪ জুলাই রাজধানীর আগারগাঁওয়ের বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত বৃক্ষমেলায় গিয়ে খুঁজতে লাগলাম আমাদের সেই দেশি কাঠগোলাপকে। বৃথাই খোঁজা। দেশ এখন বিদেশি কাঠগোলাপে ভরে গেছে। প্রায় সব নার্সারিতেই এখন শোভা পাচ্ছে নানা রঙের, নানা রূপের কাঠগোলাপ। ছোটবেলায় চোখে লেগে থাকা সেই হলদে আভার মাখন-সাদা রঙের তীব্র সুগন্ধওয়ালা দেশি ফুলের গাছটাকে খুঁজেই পেলাম না। পেলাম উজ্জ্বল সোনালি হলদে রঙের এক নতুন জাতের কাঠগোলাপকে। লাল, গোলাপি, কমলা-হলুদ, গোলাপি-সাদা ছিট ছিট পাপড়ি, এমনকি ছিট ছিট হলদে সবুজ দাগযুক্ত ভেরিগেটেড পাতার কাঠগোলাপ গাছও দেখলাম সেখানে। বাণিজ্যিক কারণে বিদেশে এখন কত শত জাতের যে কাঠগোলাপ এখন উদ্ভাবন করা হচ্ছে! সিলেটের এক প্রকৌশলী ভবি মজুমদার জানিয়েছেন, তার সংগ্রহে আছে প্রায় ২০০ জাতের কাঠগোলাপ, বরিশাল নার্সারি ও ডিসি নার্সারিতে আছে ৪০ থেকে ৫০ জাতের। রমনা ও জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে আছে কয়েকটি বুড়ো গাছ।

ফুলগুলোয় গোলাপের মতো ঘ্রাণ আর গাছের ডালপালা কাঠের মতো। হয়তো এ কারণেই ফ্রাঞ্জিপানি ফুলের বাংলা নাম রাখা হয়েছে কাঠগোলাপ। সব চাঁপা নামের ফুলদেরই সৌরভ থাকে। সে জন্য এ ফুলকে কেউ কেউ ডাকেন কাঠচাঁপা নামে। দেশি কাঠগোলাপের রঙটা গৌরবর্ণের, এ জন্য এর আর এক নাম গৌরিচাঁপা বা গৌরচাঁপা, কারও কারও কাছে সে গরুরচাঁপা। কেননা, চৈত্র সংক্রান্তিতে এ দেশের পল্লি অঞ্চলে এক সময় গরুর লড়াইয়ে এ ফুলের মালা গরুর গলায় পরানো হতো। কাঠগোলাপের পাতাগুলো দেখতে খানিকটা চালতা পাতার মতো। সে জন্যই কি-না জানি না, নিসর্গী বিপ্রদাশ বড়ুয়া এ গাছের নাম লিখেছেন চালতা গোলাপ। কিন্তু কবি নজরুল এ ফুলকে কেন গোলকচাঁপা বলেছেন? অনুমান, সুগন্ধি এ ফুলগুলো ডালের আগায় ফোটে গোলকের মতো থোকায়। সে কারণেই কি-না জানি না, কবি নজরুল তার একটি জনপ্রিয় গানে লিখেছেন- ‘ম্লান আলোকে ফুটলি কেন গোলকচাঁপার ফুল।/ ভূষণহীনা বনদেবী কার হ’বি তুই দুল\/ হার হবি কার কবরীতে/ সন্ধ্যারানী দূর নিভৃতে,/ ব’সে আছে অভিমানে ছড়িয়ে এলোচুল\’ আশির দশকে অনুপ ঘোষালের কণ্ঠে গাওয়া এ গানটির সুর এখনো কানে বাজে। কী প্রেমময় কথা আর মধুর সুর! পুরো গানটিতেই পরিব্যাপ্ত রয়েছে গোলকচাঁপা তথা কাঠগোলাপ ফুলের বন্দনা। সে গাছ যেন ভূষণহীনা বনদেবী, মাটির ধরার ফুলদানিতে ফুটে থাকা এক তোড়া ফুল, গাছের ডালে ডালে ফুলদানিতে সাজানো ফুলের মতোই যেন ফুলগুলো সুন্দর।

কাঠগোলাপ অ্যাপোসাইনেসী পরিবারের একটি বহুবর্ষজীবী পাতাঝরা স্বভাবের নরম কাঠের গুল্ম বা ছোট বৃক্ষ। গাছ ৮ থেকে ১০ মিটার লম্বা হয়। ডাল ও পাতা ভাঙলে সাদা দুধের মতো কষ বের হয়। পাতা পুরু ও পত্রফলকের বোঁটার দিক ক্রমশ সরু ও মাঝখানে চওড়া। ডালের আগায় থোকা ধরে অনেকগুলো ফুল ফোটে। ফুল পাঁচ পাপড়ির, পাপড়ির আগা গোলাকার বা তীক্ষ্ণ, ফুল সুগন্ধযুক্ত। এ গাছের গণগত নাম প্লুমেরিয়া, এ গণে বিশ্বে ১৮ প্রজাতির গাছ রয়েছে। বাংলাদেশে নথিভুক্ত আছে ৩টি প্রজাতি। Plumeria alba প্রজাতিই আমাদের দেশি কাঠগোলাপ যাকে বলা হয় গরুর-চাঁপা, গুলাচিন বা গুলাচি। এর ফুল হলুদাভ কেন্দ্রবিশিষ্ট সাদা, তুলনামূলকভাবে ছোট ও সুগন্ধী। Plumeria obtuse প্রজাতির ফুল হলুদ গলদেশবিশিষ্ট সাদা, লাল আভাযুক্ত, বড় ও সুগন্ধী। এ প্রজাতির বাংলা নামও একই। Plumeria rubra প্রজাতির নাম গোলকচাঁপা, গরুর-চাঁপা, গুলাচি, কাঠগোলাপ, চালতা-গোলাপ, কাঠ-মল্লিকা ইত্যাদি। এ প্রজাতির ফুলের রং গাঢ় লাল বা মেরুন লাল। এদের ইংরেজি নাম ফ্রাঞ্জিপানি বা প্যাগোডা ট্রি। সব প্রজাতির গাছেই ফুল ফোটে মে থেকে সেপ্টেম্বরে। এসব প্রজাতির রয়েছে অসংখ্য জাত। হাইব্রিড জাতেরও এখন ছড়াছড়ি। এ গাছের ডাল কেটে মাটিতে পুঁতে দিলে গাছ হয়। গাছ শুষ্কতা সইতে পারে, কিন্তু জলাবদ্ধতা সইতে পারে না। গোলকচাঁপা মেক্সিকো, মধ্য আমেরিকা, ভেনেজুয়েলা ও দক্ষিণ ভারতের স্থানীয় ফুল। ইন্দোনেশিয়ার বালিদ্বীপে ফ্রাঞ্জিপানি ফুলের নাম জেপুন, সেখানে গোলকচাঁপা ফুল পবিত্রতা ও আতিথেয়তার প্রতীক। 

বেলাই বিলের ঘুমকাতুরে কু-পোখ

প্রকাশ: ১০ জুলাই ২০২৫, ০৯:৪৩ এএম
বেলাই বিলের ঘুমকাতুরে কু-পোখ
কু-পোখের রাগত চাহনি। ছবি: লেখক

বিলের তাজা মাছ খাওয়ার আশায় গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের আমরা কজন শিক্ষক আমাদের বিভাগের অধ্যাপক জীবন চন্দ্র দাসের গ্রামের বাড়ি সদর থানার বাড়িয়া এলাকায় অবস্থিত গাজীপুরের বিখ্যাত বেলাই বিলে একটি প্রাকৃতিক মৎস্যাধার (স্থানীয় ভাষায় বলে ডাঙা) বন্দোবস্ত নিয়েছিলাম। এ বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি দুপুর ১২টা নাগাদ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে অটোরিকশাযোগে ড. জীবনের বাড়ির উদ্দেশে রওনা হলাম। বিকেলে মাছ ধরা হবে। গাজীপুর সদর পেরিয়ে অটোরিকশা যখন গ্রামের রাস্তা ধরে চলা শুরু করল, তখন চালককে বললাম কিছুটা ধীরে চালাতে। রাস্তার দুই পাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে যাচ্ছি। মাঝে মাঝেই অটো থামিয়ে ছবি তুলছি। এভাবে চলতে চলতে ড. জীবনের গ্রামের বাড়িতে পৌঁছাতে দুপুর ১টা ৪০ বেজে গেল। এরপর তার পীড়াপীড়িতে দ্রুত দুপুরের খাবার সারলাম।  

কয়েক বছর আগেও একবার জীবনের গ্রামের বাড়িতে এসেছিলাম। কাজেই ওর গ্রামের আশপাশটা কিছুটা চেনা আছে। দুপুরের খাবার সেরে ডাঙায় যাওয়ার আগে আশপাশটায় একটু ঢুঁ মারতে বের হলাম। হাতে অবশ্য তেমন কোনো ভালো ক্যামেরাও নেই। আর এই ভরদুপুরে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য পাখি দেখার সম্ভাবনাও কম। যা হোক সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। এখান থেকে বেলাই বিল চোখে পড়ছে। এখন শীতকাল, বিলে তেমন একটা পানি নেই। বিকেলে তো ওখানে যাবই, তাই আমার অনুসন্ধিৎসু চোখ দুটিকে ওদিক থেকে ঘুরিয়ে এনে আশপাশের গাছগাছড়ার দিকে, পাতার ফাঁকে নিবদ্ধ করলাম। 

আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, ঠিক তার সামনে একটি গাবগাছ। গাছের কাছে গেলাম, ঘন পাতার কারণে ভেতরটা কিছুটা অন্ধকার। সঙ্গে থাকা দু-একজন বলল, ‘স্যার, বেশি ভেতরে যাবেন না, পুরোনো গাবগাছ, সাপ থাকতে পারে।’ আমি বললাম, তাহলে তো ভলোই হয়, দু-একটা ক্লিক করে নেওয়া যাবে। তবে চিন্তার কোনো কারণ নেই, এখন শীতকাল, ওরা শীত নিদ্রায় আছে। গাছের ডালাপালা ভালো করে পরীক্ষা করছি। আমার বিশ্বাস, কোনো না কোনো রাতের শিকারি পাখিকে এখানে পাবই। যা ভেবেছি তাই। খানিকটা খুঁজতেই ঘন পাতার আড়ালে কিছু একটাকে বসে থাকতে দেখলাম। কিন্তু এই সাধারণ ক্যামেরা দিয়ে এত কম আলোতে ওর ছবি তোলা বেশ কঠিন। তা ছাড়া ঘুমকাতুরে পাখিটি কোনোভাবেই চোখ খুলছে না। ধীরে ধীরে অতি সাবধানে ওর কিছু ছবি তুললাম। কারণ কোনো ঘুমন্ত প্রাণীকে বিরক্ত করা মোটেও ঠিক হবে না। এর মধ্যে হঠাৎই একবার ও আমার দিকে রাগত দৃষ্টিতে তাকাল। আমি দ্রুত দুটি ক্লিক করে ঘুমকাতুরে পাখিটিকে আর বিরক্ত না করে গাবগাছের নিচ থেকে বেরিয়ে এলাম।   

বেলাই বিলের পাশের গাবগাছে দেখা ঘুমকাতুরে পাখিটি আর কেউ নয়, এ দেশের সচরাচর দৃশ্যমান ও স্বল্প ঝুঁকিসম্পন্ন আবাসিক পাখি কু-পোখ। এটি কালো প্যাঁচা, কু-প্যাঁচা বা বাদামি প্যাঁচা নামেও পরিচিত। পশ্চিমবঙ্গে ওর নাম কাল প্যাঁচা। ইংরেজি নাম Brown  Boobook, Burmese Hawk-owl ev Brown Hawk-owl। স্ট্রিজিডি বা উল্লুক গোত্রের প্যাঁচাটির বৈজ্ঞানিক নাম Ninox scutulata। বাংলাদেশ ছাড়াও প্যাঁচাটিকে দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে দেখা যায়। 

প্রাপ্তবয়স্ক কু-পোখের দেহের দৈর্ঘ্য ২৭ থেকে ৩৩ সেন্টিমিটার, প্রসারিত ডানা ৭০ থেকে ৮৫ সেন্টিমিটার। আর ওজন ১৭০ থেকে ২৩০ গ্রাম। বাজপাখির মতো ছিপছিপে দেহ, লম্বা লেজ ও তুলনামূলকভাবে ছোট মাথা। কাঁধে সাদা ছিটসহ দেহের ওপরটা লালচে বাদামি। সাদাটে বুক ও পেটে মরচে-বাদামি দাগ। গাঢ় বর্ণের মাথা ও চিবুক। গোলাকার চোখের রং হলদে। কালচে চঞ্চুতে সাদা ছিট। পা ও পায়ের পাতা হলুদ। প্যাঁচা-পেঁচি দেখতে একই রকম।   

এরা দেশজুড়ে বন, বাগান, বৃক্ষবহুল এলাকায় বিস্তৃত। সচরাচর একাকী বা জোড়ায় বিচরণ করে। দিনের বেলা গাছের ডালে পাতার আড়ালে বসে ঘুমায়। রাতে নিজের আবাসস্থলের আশপাশে খাবার খোঁজে। পোকামাকড়সহ ছোট পাখি, পাখির ডিম ও ছানা, নেংটি ইঁদুর ইত্যাদি ধারালো নখে গেথে শিকার করে খায়। এই পাখির ব্যাপক পরিবেশগত গুরুত্ব রয়েছে। কারণ এরা ফসলের জন্য ক্ষতিকারক প্রাণী, যেমন ইঁদুর, পাখি, কীটপতঙ্গ ইত্যাদির সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে স্থানীয় বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষা করে। তা ছাড়া আবাস্থলের স্বাস্থ্য ও গুণগত মান রক্ষার নির্দেশক হিসেবে এবং ফল খাওয়ার মাধ্যমে বীজ বিস্তারেও সাহায্য করে। রাতে মনোরম সুরে ‘হুওয়াপ-হুওয়াপ-হুওয়াপ…’ শব্দে ডাকে।

মার্চ থেকে জুন প্রজননকাল। এ সময় ভূমির ৫ থেকে ২০ মিটার উচ্চতায় গাছের কোটরে বাসা বানায়। একই বাসা বছরের পর বছর ব্যবহার করে। পেঁচি প্রতি মৌসুমে ৩ থেকে ৫টি সাদা রঙের ডিম পাড়ে ও তাতে একাই তা দেয়। ডিমে তা দেওয়ার সময় প্যাঁচা পেঁচিকে খাওয়ায়। ডিম ফোটে ২৪ থেকে ২৫ দিনে। প্যাঁচা-পেঁচি মিলেমিশে ছানাদের যত্ন করে। ছানারা ২৪ থেকে ২৭ দিন বয়সে উড়তে শেখে ও বাসা ছাড়ে। আয়ুষ্কাল প্রায় ১০ বছর।   

লেখক: পাখি ও বন্যপ্রাণী প্রজনন ও চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ, গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

দেখা পেলাম পাতা বিটল পোকার

প্রকাশ: ০৯ জুলাই ২০২৫, ১০:১২ এএম
দেখা পেলাম পাতা বিটল পোকার
ঢাকার শেরেবাংলা নগরে দুই ফোঁটাযুক্ত পাতা বিটল পোকা। ছবি: লেখক

গত ৪ জুলাই ছুটির দিন। বর্ষাকাল বলে মাঝে মাঝেই আকাশ থেকে বৃষ্টি ঝরছে। রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সকালে গেলাম শেরেবাংলা নগরে বৃক্ষমেলায়। সকাল ১০টা বেজে ১০ মিনিট। মেলায় ঢোকার আগেই বাংলাদেশ চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্র পেরিয়ে রাস্তার ধারে জন্মানো একটা বুনো ঝোপের দিকে হঠাৎ চোখ পড়ল। অর্জুন গাছ, তার পাশে একটি তালের চারাগাছ। তালপাতায় জড়াজড়ি করছে অমললতা বা অনললতা, কিছু ঘাসও জন্মেছে গোড়ার মাটিতে। এসব ঝোপের ভেতর কমলা রঙের কিছু পোকা উড়াউড়ি করছে, অমললতায় হেঁটে বেড়াচ্ছে। ছবি তুলতে গেলেই মনে হয় আমার উপস্থিতি টের পেল পোকাগুলো। ঝুপ করে পড়ে গেল সেখান থেকে মাটিতে, লুকিয়ে পড়ল ঘাসপাতার ভেতরে। অসুবিধে নেই। আরও কয়েকটা তো রয়েছে দেখছি। একটা তালপাতার ওপর তিনটে পোকা বসে মনে হলো ঝিমুচ্ছে, প্রায় নিশ্চল হয়ে বসে রয়েছে। ওগুলোর গায়ে গাছের ছায়া পড়ায় সে জায়গা কিছুটা অন্ধকার হয়ে রয়েছে। লতা ও পাতা সরাতে সাহস হলো না, যদি আবার টুপ করে পড়ে যায়! ওই অবস্থাতেই পোকাটার ছবি তুললাম। এ পোকা এর আগে কখনো আমার চোখেও পড়েনি। 

বাংলাদেশের পোকামাকড়ের তালিকায় এটি নথিভুক্ত কি না, তাও নিশ্চিত হতে পারলাম না। একটা খটকা লাগল মনের ভেতর। বৃক্ষমেলায় তো অনেক গাছপালা আনা হয় থাইল্যান্ড থেকে। সেসব গাছের কোনো একটির সঙ্গে এ পোকাও এ দেশে চলে আসেনি তো? একটি অপোষক উদ্ভিদ অমললতার (Cayratia trifolia) ওপর ২০১৮ সালে থাইল্যান্ডে প্রথম এ পোকা দেখার পর তা নতুন পোকা হিসেবে রেকর্ড করা হয়। 

বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞান কোষ বইয়ের ২২তম খণ্ডে বিটল পোকার বর্ণনা রয়েছে। সেখানে এ প্রজাতির পোকার কোনো উল্লেখ নেই। তবে ইনসেক্টস অব বাংলাদেশ ফেসবুক গ্রুপের ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখের একটি পোস্ট থেকে জানা গেল যে, কুষ্টিয়ায় পদ্মা নদীর ধারে সে বছর জুনের ২০ তারিখে দহকুলায় তারা এ পোকাটির দেখা পেয়েছিলেন। এ কথা সত্যি হলে এ পোকা নিশ্চয়ই এ দেশে আছে। সেখানে বনকার্পাস বা ঝাপি টেপারি (Hibiscus vitifolius ) গাছকে এ পোকার পোষক বা আশ্রয়দাতা উদ্ভিদ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

অন্তর্জাল ঘেঁটে রিসার্চগেটে প্রকাশিত ট্রেভর ও আরও দুজন গবেষকের করা একটি গবেষণাপত্র থেকে জানা গেল থাইল্যান্ডের উবন রাতচাথানি প্রদেশে ২০১৮ সালে এ প্রজাতির পোকাটির প্রথম দেখা ও নথিভুক্ত করার কথা। সে গবেষণাপত্রের ভূমিকাতে এ পোকাটি সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, বৈশিষ্ট্যপূর্ণ চকচকে কমলা রং ও দুটি কালো ফোঁটা দেখে সহজেই এ পোকাটিকে চেনা যায়। এ জন্য এ পোকার ইংরেজি নাম রাখা হয়েছে টু স্পটেড লিফ বিটল। ইংরেজি নামের সঙ্গে মিলিয়ে আমরা এর বাংলা নামকরণ করতে পারি দুই ফোঁটাযুক্ত পাতা বিটল। এ পোকার বিশদ বর্ণনা খুব কমই পাওয়া যায়। তবে এটি যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পোকা তাতে কোনো সন্দেহ নেই। 

এ পোকাটি এ দেশে দেখা অন্যান্য পাতার বিটলদের চেয়ে আকারে বড়, দেহের দৈর্ঘ্য প্রায় ১১ থেকে ১৩ মিলিমিটার, ডানার রং চকচকে কমলা, ডানার পিছনের দিকে বড় দুটো ডিম্বাকার কালো ফোঁটা রয়েছে। দেহটা উপবৃত্তাকার, পিছনের প্রান্ত কিছুটা সুচালো। এরা সাধারণত পাতার ওপরে থাকে। তবে প্রতিকূল অবস্থা বুঝলে কখনো কখনো তারা পাতার নিচের পিঠে চলে যায়, এমনকি পাতা থেকে ঝাঁপ দিয়ে নিচে পড়ে শুকনো পাতার মধ্যে লুকিয়ে পড়ে। এরা পর্ণভোজী। প্রাপ্তবয়স্ক পোকা ও তার বাচ্চারা অমললতা গাছের কচি পাতা ফুটো করে খেতে পছন্দ করে। অমললতা এ দেশে একটি লতানো বিরুৎ শ্রেণির আগাছা। বাচ্চাদের দেহের রং হলদে ও লম্বাটে। মে থেকে জুলাই মাসে এদের বেশি দেখা যায়। প্রবল বৃষ্টিতেও এদের কোনো অসুবিধা হয় না। তখন তারা ঘন পাতার আড়ালে আশ্রয় নেয়। বাচ্চারা পরিপূর্ণভাবে বড় হলে মূককীট বা পুত্তলি দশায় যাওয়ার জন্য গাছ থেকে মাটিতে নেমে পড়ে ও হামাগুড়ি দিয়ে সুবিধাজনক কোনো জায়গা খুঁজতে থাকে। সে ধরনের জায়গা পেলে মাটিতে পুত্তলি দশায় যায় ও সেখানে কিছুদিন কাটানোর পর পূর্ণাঙ্গ পোকা হয়ে বেরিয়ে আসে এবং গাছে উঠে খাদ্যের সন্ধানে ঘুরতে থাকে। 

পাতা বিটল পোকা কলিওপ্টেরা বর্গের ক্রাইসোমেলিডি গোত্রের Oides palleata প্রজাতির একটি পোকা। ভারত, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম, চীন ও তাইওয়ানে এ পোকা আছে। বাংলাদেশে এ পোকাটি নিয়ে বিশদ গবেষণা করা যেতে পারে। কোনো ফসলের ক্ষতি করে কি না, তা খতিয়ে দেখা যেতে পারে। কেননা, এ গণের পোকারা ফ্যাবেসি, পোয়েসি, রুবিয়েসি, কিউকারবিটেসি, মালভেসি, রোজেসি, রুটেসি ইত্যাদি গোত্রের উদ্ভিদের খাদক বলে জানা গেছে। পোকাটি এ দেশের পোকামাকড়ের তালিকায় নথিভুক্ত না হয়ে থাকলে সে উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।

লেখক: কৃষিবিদ ও পরিবেশবিদ

দোষ ও গুণের শিয়ালকাঁটা

প্রকাশ: ০৮ জুলাই ২০২৫, ১০:২৩ এএম
দোষ ও গুণের শিয়ালকাঁটা
ময়মনসিংহের কাচারিঘাটে জন্ম নেওয়া এক শিয়ালকাঁটা। ছবি: লেখক

বন ও নদীর ধারে জন্মানো সুন্দর হলুদ ফুলের শিয়ালকাঁটা অনেকেরই পরিচিত। এই উদ্ভিদ একই সঙ্গে বিষাক্ত এবং ঔষধি গুণসম্পন্ন। এ উদ্ভিদের কাণ্ড ভাঙলে একধরনের হলুদ ল্যাটেক্স বের হয়। এই ল্যাটেক্স বিষাক্ত। এর কাণ্ড, পাতা ও ফুলে কাঁটা থাকে। ফুল দেখতে পপি ফুলের মতো। কারণ শিয়ালকাঁটা আর পপি একই গণ আর গোত্রের উদ্ভিদ। গত ২৩ মার্চ ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র তীরের কাচারিঘাটে সকালে হাঁটতে গিয়ে একটি শিয়ালকাঁটাগাছের দেখা পাই। ঝটপট ছবি তুলে নিই। 

শিয়ালকাঁটা জন্মায় কোনো যত্ন ছাড়াই। এটি অল্প শাখাবিশিষ্ট গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ। ফল অনেকটা ডিম্বাকার ও লম্বায় ১ থেকে ১২ ইঞ্চি হয়ে থাকে। এর মধ্যে সরিষার মতো কালো রঙের বীজ থাকে। শিয়ালকাঁটা গ্রীষ্মকালে মারা যায়, শরৎকালে মাটিতে পড়ে থাকা কালো রঙের বীজ থেকে নতুন গাছ জন্মায়। এর সংস্কৃত নাম শৃগাল কণ্টক। গাছটির আরও নাম স্বর্ণক্ষীরা, স্বর্ণমুদ্রা, রুক্সিণী, সুবর্ণা, হেমদুগ্ধী, কাঞ্চনী ইত্যাদি। ইংরেজিতে শিয়ালকাঁটা মেক্সিকান পপি, মেক্সিকান প্রিকলি পপি, কারডো ইত্যাদি নামে পরিচিত।

এই গাছের কাণ্ড দেখতে কিছুটা শিয়ালের লেজের মতো এবং এর গা-ভর্তি কাঁটা। এ জন্যই এর নাম শিয়ালকাঁটা। বেলেমাটিতে ভালো জন্মায়। এর ডাঁটা রান্না করে খাওয়া যায়। এর বৈজ্ঞানিক নাম Argemone Mexicana, এটি Papaveraceae গোত্রের উদ্ভিদ। এর ফুলে পাপড়ি থাকে ছয়টি। এর বীজ ও মূলের নির্যাস থেকে তেল আহরণ করা যায়। এই তেল দিয়ে প্রদীপ জ্বালানো যায়। এর নির্যাসকে কীটনাশক হিসেবে ব্যবহার করা যায়। 

এই গাছ মেক্সিকো থেকে সারা বিশ্বে আগাছা হিসেবে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রাচীন গ্রিক ভাষায় ‘আর্জিমা’ মানে চোখের ছানি। এই গাছের রস চক্ষুরোগের চিকিৎসায় ব্যবহার হতো বলে এর গণের নাম Argemone এবং মেক্সিকোয় পাওয়া যায় বলে প্রজাতিক পদ Mexicana। এর কাণ্ড গাঢ় সবুজ ও পাতায় সাদাটে ছিট থাকে। এর পাতা ঢেউ-খেলানো ও খণ্ডিত। প্রতিটি খণ্ডের মাথায় কাঁটা থাকে। এই গাছ দেখতে অনেকটা পপিগাছের মতো। তাই একে মেক্সিকান পপিও বলা হয়।
মেক্সিকো থেকে হন্ডুরাস পর্যন্ত বিস্তৃত জায়গার স্থানীয় এই বুনোফুল প্রায় ৫০০ বছর আগে আমাদের দেশের প্রকৃতিতে ছড়িয়ে পড়ে। ষোড়শ শতকের দিকে স্প্যানিশ বাণিজ্যিক জাহাজে আলুর বস্তা ও মাটির সঙ্গে এই গাছের সরিষার মতো ছোট ছোট বীজ চলে এসেছিল এ দেশে। এভাবেই সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে গাছটি।

১৯৯৮ সালে ভারতের দিল্লির আশপাশে এর বিষক্রিয়ার প্রাদুর্ভাবে প্রায় ৬৫ জন মানুষ মারা যায়। এই বিষক্রিয়ার লক্ষণ শরীরে পানি জমে যাওয়া। এ গাছের রসে আছে কয়েক ধরনের অ্যালকালয়েডস।

শিয়ালকাঁটা ভেষজ গুণে পরিপূর্ণ। এই গাছ কৃমি, পিত্ত ও কফনাশক। জ্বর ও মূত্রকৃচ্ছ্র রোগে কার্যকর। মূলের রস কুষ্ঠরোগ নিরাময়ে কাজে লাগে। গাছের পীত বর্ণের নির্যাস গনোরিয়া ও উপদংশ রোগে বেশ উপকারী। রক্তের ক্ষমতা তৈরিতে, নতুন রক্ত তৈরিতে, দেহের ক্ষয় পূরণে, পেটের যাবতীয় রোগ নিরাময়ে শিয়ালকাঁটা ব্যবহৃত হয়। 

লেখক: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ, মুমিনুন্নিসা সরকারি মহিলা কলেজ, ময়মনসিংহ

হাজারীখিলে অবমুক্ত করা হলো ৩৩টি অজগর ছানা

প্রকাশ: ০৫ জুলাই ২০২৫, ১০:৫৭ এএম
হাজারীখিলে অবমুক্ত করা হলো ৩৩টি অজগর ছানা
অবমুক্ত করা হলো ৩৩টি অজগর ছানা।

চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় জন্ম নেওয়া ৩৩টি অজগরের বাচ্চা ফটিকছড়ি উপজেলার হাজারীখিল বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে প্রাকৃতিক পরিবেশে অবমুক্ত করেছে কর্তৃপক্ষ। 

শুক্রবার (৪ জুলাই) বিকেল ৪টায় বাচ্চাগুলো গভীর জঙ্গলে ছেড়ে দেওয়া হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. নজরুল ইসলাম, হাজারীখিল রেঞ্জ কর্মকর্তা শিকদার আতিকুর রহমান ও চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার কিউরেটর ডা. মো. শাহাদাত হোসেন শুভ।

চিড়িয়াখানার কিউরেটর শাহাদাত হোসেন শুভ বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ‘চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় ষষ্ঠবারের মতো কৃত্রিম উপায়ে অজগরের ৩৩টি বাচ্চা ফোটানো হয়। এসব অজগর ছানা ফটিকছড়ি উপজেলার হাজারীখিল বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে প্রাকৃতিক পরিবেশে অবমুক্ত করা হয়েছে। হাজারীখিল বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে অফিস কার্যালয় থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার ভেতরে ছাড়া হয় বাচ্চাগুলো।’

জানা গেছে, গত ৪ ও ১৪ এপ্রিল দুটি অজগর থেকে পাওয়া ৪৫টি ডিম সংগ্রহ করে হাতে তৈরি ইনকিউবেটরে বসানো হয়। দুই ধাপে গত ১১-১৩ জুনের মধ্যে ১৭টি ও ২১-২৪ জুনের মধ্যে ১৬টিসহ ৩৩টি অজগরের বাচ্চা জন্ম নেয়। ওই বাচ্চাগুলো পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর সক্ষমতা পাওয়ার পর অবমুক্ত করা হয়।