ঢাকা ২ শ্রাবণ ১৪৩২, বৃহস্পতিবার, ১৭ জুলাই ২০২৫
English
বৃহস্পতিবার, ১৭ জুলাই ২০২৫, ২ শ্রাবণ ১৪৩২

সাগরে জেলেদের প্লাস্টিক বর্জ্য না ফেলতে সচেতন করছেন খোকন

প্রকাশ: ০৮ জুন ২০২৫, ০৫:১৩ পিএম
আপডেট: ০৮ জুন ২০২৫, ০৫:১৫ পিএম
সাগরে জেলেদের প্লাস্টিক বর্জ্য না ফেলতে সচেতন করছেন খোকন
ছবি: সংগৃহীত

কখনো সাংবাদিক, কখনো মানবিককর্মী, কখনো সামাজিক আন্দোলনকর্মী কখনো উপকূল বন্ধু, কখনো বা পরিবেশ-জলবায়ুযোদ্ধা হিসেবে পরিচিত। নাম শফিকুল ইসলাম খোকন। খোকন একজন গণমাধ্যমকর্মী। সাংবাদিকতা পেশায়  থেকেও ভিন্নধর্মী কাজ করা যায় তার উদাহরণ তিনি। রোগীদের জন্য রক্ত সংগ্রহ করা, অর্থের অভাবে চিকিৎসা না পাওয়া রোগীদের চিকিৎসার সাহায্যে এগিয়ে আসা, পথচারীদের খাবার দেওয়া, তরুণদের সামাজিক কাজে সম্পৃক্ত করা, মানবিক কাজ করা, সামাজিক আন্দোলনসহ নানা কাজে তাকে পাওয়া যায়।

বর্তমানে শফিকুল ইসলাম খোকন উপকূলের পরিবেশ রক্ষা এবং জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন বিরামহীন। প্রথম হিউম্যানবুক হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত শফিকুল ইসলাম খোকন সামুদ্রিক প্রোটিন,জীবন-জীবিকা,পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাসহ সমুদ্র অর্থনীতি টিকিয়ে রাখতে সাগরে জেলেদের প্লাস্টিক বর্জ না ফেলতে সেচ্ছায় সচেতন করছেন।  দীর্ঘদিন ধরে তিনি পাথরঘাটার বৃহত্তম মৎস্য অবতরণকেন্দ্রের ঘাটে এবং বিভিন্ন খালে নোঙর করা সমুদ্রগামী মাছ ধরার ট্রলারে জেলেদের এমন সচেতন করছেন।

উপকূলের জেলেরা তাদের জীবন-জীবিকার জন্য গভীর সমুদ্রে মাছ শিকার করতে যান। একেকটি মাছ ধরা ট্রলারে ১৫ থেকে ২০ জন জেলে থাকেন এবং তারা ১০ থেকে ১৫ দিন গভীর সমুদ্রে অবস্থান করেন। এ সময় তাদের ব্যবহৃত বিভিন্ন প্লাস্টিকের বোতল, মোড়ক, নিত্যব্যবহার্য বিভিন্ন পণ্যসহ পলিথিন ব্যাগ সাগরে ফেলছেন। যার কারণে সমুদ্রের তলদেশে প্লাস্টিক বর্জ্য জমে থাকায় সামুদ্রিক প্রোটিনের ব্যপক ক্ষতি হচ্ছে। পাপাশাশি পরিবেশের ভারসাম্যও হারাচ্ছে। দিন দিন তা পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দেখা দিচ্ছে। ক্ষতিকারক জেনেও মানুষের মধ্যে দিন দিন পলিথিন ও প্লাস্টিকসামগ্রীর ব্যবহার এবং অব্যবস্থাপনার হার ক্রমেই বাড়ছে। সাগরে জেলে সম্প্রদায়ই বেশি অবস্থান করার কারণে সমুদ্রগামী জেলেদের সাগরে যত্রতত্র প্লাস্টিকের বর্জ্য যাতে না ফেলেন এ জন্যই এই ব্যতিক্রমই উদ্যোগ নিয়েছেন শফিকুল ইসলাম খোকন।

এ পর্যন্ত তিনি অন্তত ৫০টির বেশি মাছ ধরার ট্রলারে জেলেদের সাগরে প্লাস্টিকের বর্জ্য ফেলার ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরেছেন এবং সমুদ্র-অর্থনীতি তথা সমুদ্রে মাছসহ প্রাকৃতিক সম্পদের বিষয় তিনি হাতে কলমে বুঝিয়ে দিচ্ছেন। জেলেরা সাগর থেকে মাছ শিকার করে ঘাটে আসামাত্রই ছুটে যান তিনি। জেলেরা সাগরে থাকাবস্থায় ট্রলারে বস্তা, ড্রাম বা ঝুড়িতে ব্যবহৃত প্লাস্টিকের মালামাল সংরক্ষণ করে তীরে এসে নির্ধারিত জাযগায় ফেলতে উদ্ভুদ্ধ করছেন তিনি।

শফিকুল ইসলাম খোকন পরিবেশ ও জলবায়ুবিষয়ক নাগরিক সংগঠন ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) এর সঙ্গে সম্পৃক্ত। পাশাপাশি স্থানীয় তরুণদের সংগঠিত করতে পরিবেশ রক্ষায় ‘পাথরঘাটা উপকূল সুরক্ষা আন্দোলন’ নামে একটি সংগঠন করেছেন।  

শফিকুল ইসলাম খোকন বলেন, ‘বাণিজ্যিক জাহাজের পাশাপাশি সমুদ্রে হাজার হাজার মাছ ধরার ট্রলার থাকে। এসব ট্রলারের জেলেরা প্রতি ট্রিপেই কোনো না কোনোভাবে প্লাস্টিক নিয়ে যাচ্ছেন যা সমুদ্রেই ফেলে দিচ্ছেন। এতে হুমকির মুখে সমুদ্র। এ রকম চলতে থাকলে এক সময় থাকবে না আর কোনো সামুদ্রিক মাছ। অতিরিক্ত মাছ ধরা, জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্লাস্টিকের দূষণের কারণে বিশ্বের সাগর-মহাসাগর এখন হুমকির মুখে।’

কিভাবে এই ব্যতিক্রম কাজে আসা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। পাশাপাশি সাংবাদিকতার পেশার কারণে অনেক সময় মানুষের কাছে যেতে হয়, তথ্য অনুসন্ধান করতে হয়। জেলেদের কাজ থেকে দেখেছি তারা কতটুকু প্লাস্টিক ব্যবহার করছেন সাগরে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলের পাশাপাশি সমুদ্রও ঝূকিতে রয়েছে। তাছাড়া প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলার কারণে আরও ক্ষতির সম্মুখীন সমুদ্রসহ সামুদ্রিক সম্পদ। সমুদ্রগামী জেলেদের এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রয়েছে। এ কারণেই আমি জেলেদেরকে বেছে নিয়েছি।’

তিনি বলেন, ‘জেলেরা যেমন আমাদের সম্পদ, এ সম্পদকেই কাজে লাগানো যায়। তাদের সচেতন করতে পারলে হয়তো বা একদিন সমুদ্রে প্লাস্টিক ফেলা বন্ধ হবে। ইতোপুর্বে আমি বেশ কয়েকটি ট্রলারে প্লাস্টিক রাখার জন্য নির্ধারিত জায়গা করে দিয়েছি, যাতে করে সাগরে না ফেলে তীরে এসে নির্ধারিত জায়গায় ফেলেন তারা। কতটুকু সফল হবো জানি না, তবে এগিয়ে যাচ্ছি।’

জেলেদের পাশাপাশি ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য সাগরকে রা করার বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

গভীর সমুদ্রে মাছ শিকার করা জেলে আব্দুল কাদের, বেলায়েত  হোসেন, জাহাঙ্গীর মাঝিসহ একাধিক জেলেরা বলেন, সাগরে যখন মাছ ধরতে যাই, তখন আমাদের সাথে অনেক প্লাস্টিক, পলিথিন থাকে। ওইগুলো ব্যবহার শেষে সাগরেই ফেলে দিয়ে আসি। এর ক্ষতিকর বিষয় আমরা জানতাম না। তবে সাংবাদিক খোকন প্রায়ই আমাদের কাছে এসে সাগরে  প্লাস্টিক নিয়ে যেতে নিষেধ করেন। প্রথমে আমরা তার কথাগুলো হাস্যকর হিসেবে নিতাম। পরে যখন তার কথায় ক্ষতিকর বিষয় বুঝতে পারলাম তখন থেকেই সচেতন হলাম।

তারা আরও বলেন, সাগরমুখী জেলেরা যদি প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধ করে তাহলে সাগর অনেকটা ভালো থাকবে। যেহেতু আমাদের জীবিকা সাগরের ওপর নির্ভর, আমাদেরকেই রক্ষা করতে হবে। আমরাও চেষ্টা করছি সাগরে প্লাস্টিক না নেওয়ার। খোকন ভাইয়ের দেওয়া বক্সে প্লাস্টিক রাখছি, যা তীরে এসে নির্ধারিত জায়গায় ফেলে দিই।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনোজ কুমার কীর্তনীয়া বলেন, এটি অবশ্যই ব্যতিক্রম কাজ। সাগর এখন ধংসের পথে। আর এ পথ থেকে রক্ষা করতে পারে জেলেরাই। খোকনের এমন কাজকে স্বাগত জানাই পাশাপাশি তার এ কাজ সমাজ এবং রাষ্ট্রও কাজে লাগাতে পারে।

বরগুনা জেলা মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বলেন, সাগরে প্রতিদিনই অসংখ্য ট্রলার মাছ শিকার করতে যায়। প্রতিটি ট্রলারেই জেলেরা প্লাস্টিক নিয়ে যায়, যা সাগরেই ফেলে দিয়ে আসে। প্লাস্টিক  সাগরে ফেলার কারণে লাভ ক্ষতি জেলেরা হিসেব করে না। তবে আমরা যতটা জানতে পেরেছি সাগরে প্লাস্টিকের কারণে সামুদ্রিক মাছসহ সাগরের অনেক ক্ষতি হয়। জেলেরা আসলে এ বিষয় সচেতন নয়। আমি দীর্ঘদিন ধরে দেখছি।

অমিয়/

মানুষের মতো আইনি অধিকার পাবে ডলফিনরা!

প্রকাশ: ১৬ জুলাই ২০২৫, ০১:০৭ পিএম
মানুষের মতো আইনি অধিকার পাবে ডলফিনরা!
ছবি: সংগৃহীত

দূষণ, জাহাজ ও ফেলে রাখা মাছ ধরার জালের কারণে হুমকির মুখে থাকা বোতলনাক ডলফিনদের রক্ষায় দক্ষিণ কোরিয়ার জেজু দ্বীপে চলছে ব্যতিক্রমী এক প্রচারণা। স্থানীয় পরিবেশবাদীরা চাইছেন, এই ডলফিনদের “আইনি ব্যক্তিত্ব” বা মানুষের মতো আইনগত মর্যাদা দেওয়া হোক।

জেজু দ্বীপের আকাশে ঝকঝকে রোদ। নীল পানিতে বোট যখন এগিয়ে চলছে, সবকিছুই শান্ত আর পরিষ্কার মনে হয়। হঠাৎ পানির ফাঁক গলে দেখা যায় একটি পাখনা, তারপর আরেকটি। কিছুক্ষণের মধ্যেই আট-নয়টি ডলফিনের একটি দল বোটের পাশে ছুটতে থাকে, পানির ওপর লাফিয়ে চলেছে এরা।

তবে "ওরে" (কোরিয়ান ভাষায় যার অর্থ “দীর্ঘ” এবং জেজু দ্বীপে “দীর্ঘজীবী হোক সে”) নামে একটি ডলফিনের পিঠে অন্যদের মতো পাখনা নেই। 

ওরে হলো প্রায় ১৩০টি ইন্দো-প্যাসিফিক বোতলনাক ডলফিনের মধ্যে একটি, যারা জেজু দ্বীপের চারপাশের জলে বাস করে। অনেক ডলফিনের শরীরে দাগ রয়েছে - কেউ মাছ ধরার জালে আটকে গিয়ে আহত, কেউ আবার বোট বা জেট স্কির ধাক্কায় ক্ষতবিক্ষত।

বোট চালাচ্ছিলেন জিওংজুন লি, যাকে দ্বীপে সবাই "ডলফিন ম্যান" নামে চেনে। তিনি একজন চলচ্চিত্র পরিচালক যিনি জেজুর ডলফিনদের নিয়ে ডকুমেন্টারি নির্মাণ করেন এবং তাদের রক্ষায় কাজ করেন।

তিনি বলেন, 'ডলফিনরা নিজেরা মাছ ধরার তার কাটতে পারে না, তাই আমরা সেটা কেটে দেই। এক ডলফিনের মুখ থেকে শরীর পর্যন্ত তার ঢুকে গিয়েছিল, আবার আরেকটি পেছনের পাখনায় জড়িয়ে ছিল- সব খুলে ফেলেছি।'

এখন জিওংজুন লি ও তার মতো আরও পরিবেশকর্মীরা চাইছেন ডলফিনদের "আইনি ব্যক্তি" (legal person) হিসেবে স্বীকৃতি দিতে। অর্থাৎ যেন তারা কোনো ক্ষতির শিকার হলে, তাদের পক্ষে মামলা করা যায়।

এ ধারণাটি মূলত প্রাণী কিংবা প্রকৃতিকে আইনি অধিকার দেওয়ার একটি আন্তর্জাতিক আন্দোলনের অংশ। কোরিয়ায় এই প্রথম কোনো প্রাণীর জন্য এমন স্বীকৃতির দাবি উঠেছে।

স্থানীয় এনজিও মারিন অ্যানিমাল রিসার্চ অ্যান্ড কনজারভেশন (MARC) এর কর্মী মিয়েয়ন কিম বলেন, 'যদি কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ডলফিনদের জীবনহানি ঘটায়, তবে আমরা তাদের পক্ষে আইনি পদক্ষেপ নিতে পারব। তবে এই প্রক্রিয়াটি জটিল- কোরিয়ান সরকার এবং জেজু দ্বীপবাসীর সমর্থন প্রয়োজন।'

বর্তমানে International Union for Conservation of Nature (IUCN)-এর তালিকায় এই ডলফিনগুলোকে "প্রায় বিপন্ন" (Near Threatened) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে তথ্যের অভাবে এদের প্রকৃত অবস্থান নির্ধারণ কঠিন।

জেজুর ডলফিনরা যেসব হুমকির মুখে রয়েছে:

>ফেলে রাখা মাছ ধরার জাল।

>পর্যটক বোটের অতিরিক্ত ভিড়।

>নির্মাণকাজের শব্দদূষণ।

>মৎস্য খামার থেকে পানিদূষণ।

এ ছাড়া সবশেষ উদ্বেগের কারণ হলো দক্ষিণ কোরিয়ার সবচেয়ে বড় উইন্ডফার্ম নির্মাণ, যা জেজুর উপকূলে তৈরি হচ্ছে।

MARC সংগঠনটি ডলফিনদের dorsal fin দেখে আলাদা করে চিনতে ছবি ও নামসহ একটি পরিচিতি গাইডও তৈরি করেছে-।

২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে, দ্বীপের পশ্চিম উপকূলে একটি সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা (MPA) ঘোষণা করা হয়েছে ডলফিনদের সুরক্ষার জন্য। তবে কিম জানান, এই এলাকাকে আরও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এখনো মাছ ধরার বোট বা অন্যান্য নৌযান সেই এলাকায় ঢুকে পড়ে।

ডলফিন ম্যান বলেন, 'কখনও দেখি একসঙ্গে অনেকগুলো বোট ডলফিনদের ঘিরে ফেলছে, তাদের পেছনে দৌড়াচ্ছে। আমরা এখন একটু হলেও সুরক্ষিত এলাকা পেয়েছি, কিন্তু ভবিষ্যতে পুরো এলাকাটাকেই সুরক্ষিত অঞ্চল ঘোষণা করতে হবে।' সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান

মেহেদী/

শুভ্র সুন্দর মাকড়সা লিলি

প্রকাশ: ১৫ জুলাই ২০২৫, ০৯:৪৬ এএম
শুভ্র সুন্দর মাকড়সা লিলি
ছবি: লেখক

গত ৪ জুন  সকালে হাঁটতে গিয়েছিলাম ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র তীরের জয়নুল আবেদিন উদ্যানে। উদ্যানের পশ্চিম পাশে ভাষাসৈনিক মোস্তফা এম এ মতিন পাঠাগারের সামনে মাকড়সা লিলি গাছে দেখলাম ফুল ফুটে আছে। ছবি তুলে ফেললাম ঝটপট।

ফুল দেখতে অনেকটা মাকড়সার জালের মতো বলে তার নাম স্পাইডার লিলি বা  মাকড়সা লিলি। আমাদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এ উদ্ভিদ গো-রসুন বলে পরিচিত । এটি বিরুৎ জাতীয় উদ্ভিদ। এই ফুল ইংরেজিতে White Spider Lily,  Beach Spider Lily, Sea Daffodil  নামে পরিচিত। এর বৈজ্ঞানিক নাম Hymenocallis littoralis, এটি  Amaryllidaceae  পরিবারের সদস্য। এর কাণ্ড ভূনিম্নস্থ এবং রূপান্তরিত হয়ে কন্দে পরিণত হয়। গোড়ায় গুচ্ছবদ্ধ পাতাসহ উদ্ভিদ ৩০ থেকে ৬০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। পাতা ৪ থেকে ৮ সেন্টিমিটার চওড়া, অনেকটা লম্বা। পাতা আনারস পাতার মতো লম্বা হয়। পাতা অনেক পুরু, ভারী, আগা সুচালো। লম্বা মঞ্জরিদণ্ডের আগায় ছাতার মতো  ধবধবে সাদা ও সুগন্ধি ফুল ফোটে।। ফুলের দলনল ১০ থেকে ১৪ সেন্টিমিটার লম্বা, আগায় ৬টি সরু ফিতার মতো পাপড়ি, গোড়ায় কাগুজে বাটি বা মুকুট জড়ানো। পাতায় দাগাঙ্কিত বা ভেরিগেটেড মাকড়সা লিলিও এখন নার্সারিগুলোতে পাওয়া যাচ্ছে।   

স্পাইডার লিলি ফোটার প্রধান মৌসুম গ্রীষ্মের শেষ থেকে বর্ষা পর্যন্ত। বর্ষায় ফোটা বৃষ্টিভেজা স্পাইডার লিলির সুবাস চারদিক মোহিত করে। স্পাইডার লিলির জন্মস্থান মূলত দক্ষিণ আফ্রিকা হলেও সারা পৃথিবীর উষ্ণমণ্ডলীয় দেশে এ ফুলের বিস্তার ঘটেছে। আমাদের প্রকৃতিতে বুনো পরিবেশেই জন্মে। পানি এর পছন্দ। রোদ ও আংশিক ছায়ায় ভালো থাকে। স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য পথের ধার অথবা জলার ধার উত্তম।

 এই উদ্ভিদ জায়গা করে নিয়েছে নগর উদ্যানে। পুষ্পপ্রেমিকদের একচিলতে বারান্দা কিংবা ছাদবাগানেও পৌঁছে গেছে সুগন্ধি এই ফুলটি। টবে চাষযোগ্য হওয়ায় এ ক্ষেত্রে আরও বাড়তি সুবিধা। ঢাকায় রমনা পার্ক, বোটানিক্যাল গার্ডেন ও শিশু একাডেমির বাগানসহ বিভিন্ন পার্ক ও উদ্যানে দেখা যায়। টবে চাষ করার জন্য তেমন বাড়তি কোনো পরিচর্যার প্রয়োজন নেই। শুধু কন্দটি যেন নষ্ট না হয়, সেদিকে একটু লক্ষ রাখতে হবে। টবে পানি জমলে কন্দ পচে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে । 

 কবিরাজরা লিভারের চিকিৎসায় গাছটির কন্দ ব্যবহার করেন। ফলে অতি আহরণে গ্রামের বন-বাদাড় থেকে উদ্ভিদটি প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। ক্ষত নিরাময়ে এই উদ্ভিদ ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া এই উদ্ভিদেও রয়েছে প্রদাহবিরোধী, ভাইরাসবিরোধী, কোষের অস্বাভাবিক বিভাজনবিরোধী বা টিউমারবিরোধী  গুণাগুণ । তবে এর রয়েছে সাইটোটক্সিক বা কোষের জন্য ক্ষতিকর উপাদান।     

লেখক: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ, মুমিনুন্নিসা সরকারি মহিলা কলেজ, ময়মনসিংহ  

ফসলের বন্ধু ফিতা মাছি

প্রকাশ: ১৪ জুলাই ২০২৫, ০৯:২২ এএম
ফসলের বন্ধু ফিতা মাছি
নাটোরের ধানখেতে দেখা সিরফিড মাছি। ছবি: লেখক

দুই মাস আগে নাটোরে গিয়েছিলাম বেড়াতে। সেখানে এক সকাল বেলায় দেখলাম, ফিতা মাছিরা রোদের ওমে ধানখেতের ওপর দিয়ে আনন্দে উড়ে বেড়াচ্ছে। ওড়াটা খুব জোরে না। উড়তে গিয়ে কখনো কখনো বাতাসেই ভেসে থাকছে, খুঁজছে যুৎসই ফুল। এরপর সেসব ফুলে বসছে। সুযোগ বুঝে ফুলে বসা একটি মাছির ছবি ঝটপট তুলে নিই। 

আর একদিন একটা শিমখেতে গিয়ে বসেছিলাম। সে খেতে প্রচুর পরিমাণে কালচে-সবুজ নরম ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাব পোকা দেখলাম। তারা শিমের পুষ্পমঞ্জরিতে কলোনি তৈরি করে ফেলেছে। সেখানে হালকা সবুজ-সাদা রঙের ফিতা মাছির কয়েকটা বাচ্চা জাব পোকাদের গায়ের ওপর হাঁটছে। সুড়সুড়ি পেয়ে জাব পোকারা সামান্য নড়ছে বটে, কিন্তু যাচ্ছে না। ফিতা মাছির বাচ্চাদের মুখটা হুকের মতো, সূঁচাল, পিছন দিক চওড়া, পা নেই, সারা গায়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাঁটা ভরা।  কাঁটাগুলোকে সংকোচন ও প্রসারণের মাধ্যমে ওরা হাঁটছে। বাচ্চাদের খাওয়ার ধরনটা দেখলাম অদ্ভুত। প্রথমে একটা জাব পোকাকে কামড়ে ধরল। তারপর পিছনের ওপর ভর দিয়ে আকাশের দিকে মুখ তুলো কামড়ে ধরা জাবপোকাকে নিয়ে কিছুক্ষণ ঝাঁকাল। মনে হলো শিকারের আনন্দে যেন সে নাচানাচি করছে। খানিকক্ষণ পর ওটাকে সাবাড় করে আর একটাকে ধরল। একইভাবে সেটাকেও খেল। ঘণ্টাখানেক ওখানে বসে বসে ওদের শিকার ধরার কৌশল ও খাওয়ার ধরনটা যেন সিনেমার মতো দেখলাম। ছবিগুলো একটা আতসী কাচ দিয়ে যখন দেখছিলাম, মনে হচ্ছিল যেন ডিসকভারি চ্যানেলের ভিডিও দেখছি।

এ দেশে ফসলের খেতে নানা রকমের মাছি দেখা যায়। সব মাছিই খেতে তাদের নিজেদের কাজ সারতে আসে। কেউ আসে ফসল নষ্ট করতে, যেমন ধানের পাতা মাছি ও নলি মাছি, লেবু ও বরবটির পাতা সুড়ঙ্গকারী মাছি বা লিফ মাইনার। এগুলোকে বলে শত্রু মাছি। আবার কেউ আসে ফসল নষ্ট করে যেসব পোকা তাদের খেয়ে ফেলতে। এগুলোর মধ্যে ডাকু মাছি সেরা, এরপর রয়েছে সিরফিড মাছি বা ফিতা মাছি। ট্যাকিনিড ও ট্যাবানিড মাছিও উপকার করে। তাই এই মাছিদের বলে ফসলের বন্ধু মাছি। 

সিরফিড মাছির পেটটা ফিতার মতো চ্যাপ্টা ও বর্ণিল। এ জন্য এর বাংলা নাম দেওয়া হয়েছে ফিতা মাছি। এদের দেহের রং সোনালি হলুদ। দেখতে অনেকটা মৌমাছির মতো। মুখ হলুদ, চোখ বড় ও দুই চোখের কাছে পশম থাকে, শুঁড় কালো। বুকের রং হালকা সবুজ, নিচের দিক বাদামি হলুদ। ডানা স্বচ্ছ ও ডানার গোড়া বাদামি হলুদ। পেটের রং আড়াআড়িভাবে কালো ও হলুদ ব্যান্ডযুক্ত বা ডোরাকাটা। পায়ের রং কমলা, গোড়ার কিছুটা অংশ কালো। দেহ ২৫ থেকে ৩৫ মিলিমিটার লম্বা। জুন থেকে ডিসেম্বরে সাধারণত এদের দেখা যায়। বিশেষ করে শীতকালে এদের বেশি দেখা যায়। কেননা এর বাচ্চারা জাবপোকা খেতে ওস্তাদ। 

ফিতা মাছির ইংরেজি নাম সিরফিড ফ্লাই বা হোভার ফ্লাই। সারা বিশ্বে প্রায় ৬ হাজার প্রজাতির সিরফিড মাছি আছে। বাংলাদেশে অন্তত ৩৫ প্রজাতির সিরফিড মাছি আছে। এদের অন্য নাম ফুলের মাছি বা হোভার মাছি। এগুলোর মধ্যে সিরফিড গণের মাছি আছে দুটি প্রজাতির। গবেষক আসিফ সাজ্জাদ ও সাফকোয়াত সাঈদ পাকিস্তানের পাঞ্জাবে ১৫ প্রজাতির ফিতা মাছি পেয়েছেন, যাদের পোষক গাছ হলো ৫১ প্রজাতির উদ্ভিদ। ডিপ্টেরা বর্গের সিরফিড মাছির বৈজ্ঞানিক নাম Syrphus sp. 

পূর্ণাঙ্গ মাছি ৪ থেকে ১০ মিলিমিটার লম্বা। পূর্ণাঙ্গ মাছিরা পরভোজী স্বভাবের না, ওরা জাব পোকা খায় না, খায় ফলের রস, ফুলের মধু বা শিশির। এরা ফুল থেকে ফুলে ঘুরে বেড়ায়। ধান, সরিষা, গোলাপ, শিম, বরবটি, লিচু ইত্যাদি ফসলের খেতে এদের উড়তে দেখা যায়। লিচু ফুলের পরাগায়ণে এরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এদের ওড়ার ভঙ্গিটাও বেশ। উড়োজাহাজের মতো বাতাসে ভেসে ভেসে চলে। ফুল পেলে সেখানে নোঙর করে, বসে। তবে খুবই অল্প সময়ের জন্য ওরা সেখানে থাকে। খাবার খেয়েই উড়াল দেয়। বসার কারণে ফুলের পরাগায়ণ ঘটে। তাই একদিকে পরাগায়ণ ঘটিয়ে পূর্ণাঙ্গ ফিতা মাছিরা কৃষকের উপকার করে, অন্যদিকে এর বাচ্চারা জাবপোকা খেয়ে ফসলের ক্ষতি থেকে কৃষকদের বাঁচায়। দুদিক থেকেই তাই এরা ফসলের বন্ধু পোকা। বাংলাদেশের প্রায় সবখানে এ পোকা দেখা যায়। এ ছাড়া ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার প্রভৃতি দেশে এদের দেখা যায়।

লেখক: কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিদ, ঢাকা

কুমিরের সঙ্গে বন্ধুত্ব তপুর!

প্রকাশ: ১২ জুলাই ২০২৫, ১১:৩১ এএম
আপডেট: ১২ জুলাই ২০২৫, ১১:৪৩ এএম
কুমিরের সঙ্গে বন্ধুত্ব তপুর!
ছবি: খবরের কাগজ

হিংস্র প্রাণীর মধ্যে কুমির একটি। কুমির দেখলে যেখানে মানুষ দৌড়ে পালায়, সেই কুমিরের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন বাগেরহাটের মেহেদী হাসান তপু।

বাগেরহাটের খানজাহান আলী (র.) মাজারের দিঘিতে থাকা কুমির আর তপুর বন্ধুত্বের কথা। মাজারের দিঘীর পাশেই বসবাস করেন তপু। তিনি নিয়মিত কুমিরের খোঁজখবর নেন, ডাকেন, খাওয়ান। কুমিরও তার ডাকে সাড়া দেয়।

ভিডিওতে দেখা যায়, পানিতে থাকা ধলা পাহাড় নামের কুমিরটিকে শান্তভাবে হাত দিয়ে স্পর্শ করছেন। কুমিরটিকে থামতে এবং চলতে বলছেন। কুমিরটিও তপুর কথা মতো পানি দিয়ে চলছে, থামছে এবং এগিয়ে যাচ্ছে। মাথা উঁচু করছে, মুরগি খাচ্ছে, উপরে উঠতে বললে উঠছে। তবে অনেকে তার এ কাজের প্রশংসা করেছেন। আবার কেউ কেউ খুবই বিপদজ্জনক বলে সমালোচনা করেছেন।

স্থানীয়রা ও প্রতক্ষদর্শীরা জানান ,তপু ছোটবেলা থেকেই মাজার এলাকায় বড় হয়েছেন। তার কুমিরের প্রতি একটা আলাদা টান রয়েছে। প্রতিদিন সকালে ও বিকেলে সে মাজারে গিয়ে ধলাপাহাড় নামে পরিচিত কুমিরদের ডাক দেন। তপুর ডাক শুনলেই কুমিরগুলো পানিতে ভেসে উঠে, এমনকি তপুর হাতে খাবার খেতেও এগিয়ে আসে। এভাবেই এ কুমিরের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে গড়ে তুলেছেন তপু।

স্থানীয় বাসিন্দা হালিমা বেগম বলেন, ছোটবেলা থেকে দিঘির কুমির দেখে আসছি। আমরা কখনো ভাবিনি কেউ এত কাছ থেকে কুমিরের সঙ্গে এমন সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে। তপুর সাহস আর মমতা দেখে মুগ্ধ আমরা সবাই মুগ্ধ হয়ে গেছি। ওর কথা শুনে চলে এ ধলা পাহাড় কুমির।

খুলনা থেকে আসা শুভ দাস বলেন, আমি ইন্টারনেটে ভিডিওটি দেখে কৌতূহল নিয়ে আসলাম। নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। এটা শুধু একটা ভিডিও না, বরং প্রাণীর সঙ্গে এতোটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক হতে পারে। আসলে না আসলে বুঝতে পারতাম না।

তপু বলেন, আমি ছোটবেলা থেকেই খান জাহান আলী মাজারের কুমির দেখাশোনা করে আসছি। সেই থেকেই কুমিরের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠেছে। কুমিরটি অনেকবার দিঘির বাইরে চলে, গেছে আমি আর আমার ছোট মামা ধরে এনে আবার দিঘীতে ছেড়ে দিয়েছি। প্রতিদিন বিকেল হলে ধলা পাহাড় মাজারের ঘাটে চলে আসে। দেখতে মানুষ ভিড় করেন। আমি এ ধলা পাহাড় কুমিরের সঙ্গে খেলা করি কখনো কখনো চুমু খাই সে আবার আমার কথা শুনে চলে। খান জাহান আলী মাজারের রেখে যাওয়া পীর সাহেবের সেই ধলা পাহাড় এবং কালা পাহাড় না। এটা ইন্ডিয়া থেকে ২০০৫ সালে ছয়টি কুমির আনা হয়েছিল তার একটি অবশিষ্ট। কালা পাহাড় ২০২৩ সালে মারা যায়।

আমরা ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি মাদি কুমিরকে বলা হয় ধলা পাহাড় আর পুরুষ কুমিরকে বলা হয় কালা পাহাড়। ও হচ্ছে মাদি কুমির। ওকে আমরা ধলা পাহাড় বলে ডাকি। ডাকলেই চলে আসে। এ কুমিরের সঙ্গেই আমার বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠেছে। আপনারা দেখতে পাচ্ছেন আমি ডাক দিলেই ও চলে আসছে। প্রতিদিন এই মাজারের হাজার হাজার মানুষ দেখা যায়। কেউ মাজারে এসে মনের আশা পূরণের জন্য মানত করে। কেউ কেউ আবার কুমিরকে মুরগি খাওয়ানোর জন্য আসেন। আমি ধলা পাহাড়কে নিজের বন্ধু ভাবি। অনেক সময় ওরা আমাকে চিনে আসে, এটা দেখে ভালো লাগে। 

খান জানান আলী মাজারের প্রধান খাদেম ফকির তরিকুল ইসলাম বলেন, তপুর মতো একজন যুবক কুমিরের সঙ্গে এমন বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছে, এটা সত্যিই অবাক করার মতো। তপু এটিকে নিয়মিত খাওয়ায়, খেলা করে, ওর ডাকে ছুটে চলে আসে। ছোটবেলা থেকেই তপুর কুমিরের প্রতি টান। তখন থেকেই ওর সঙ্গে কেমন জানি বন্ধু হয়ে গেছে তপুর। এ বন্ধুত্বের দেখে অনেক পর্যটক এখন দিঘির পাশে ভিড় করে। অনেকে বলছে, কুমিরের মতো হিংস্র প্রাণীর সঙ্গে মানুষের এমন সম্পর্ক সত্যিই দেখা যায় না। এখন সবাই বলে মানুষ আর কুমিরের মাধ্যেও বন্ধুত্ব হতে পারে, তার প্রমাণ তপু। 

রিফাত মাহামুদ/রিফাত/

অপূর্ব এশীয় শাবুলবুলি

প্রকাশ: ১২ জুলাই ২০২৫, ০৯:৩০ এএম
অপূর্ব এশীয় শাবুলবুলি
পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলায় আমগাছে বাসার পাশে বসে আছে একজোড়া এশীয় শাবুলবুলি পাখি। ছবি: লেখক

গাজীপুরের পুবাইলের একটি গ্রাম ‘ভাদুন’। সেই গ্রামে জল-জঙ্গল নামের একটি বাড়ি আছে। সেই বাড়ির কাছের একটি ঘন আমবাগানের কাঁঠালগাছে বাসা বানিয়েছিল এক জোড়া ভীষণ সুন্দর পাখি। বাসায় তিনটি ছানা ফুটেছিল। এ পাখিদের নাম এশীয় শাবুলবুলি। দুটি পাখির একটির রং ইটলাল বা পিঙ্গল। অন্যটির রং ধবধবে সাদা। পুরুষ পাখির লেজ অনেক লম্বা। লম্বা লেজ পাখিটিকে দারুণ সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছে। এমন লেজ তৈরি হতে প্রায় দুই-তিন বছর সময় লাগে। এশীয় শাবুলবুলি পাখির লাল ঝোলা, দুধরাজ, সাহেব বুলবুলি নামেও এলাকাভিত্তিক পরিচিতি রয়েছে। 

এশীয় শাবুলবুলি লম্বা লেজ ও ঝুঁটিওয়ালা পোকা শিকারি পাখি। এর দেহের দৈর্ঘ্য ২০ সেন্টিমিটার (ডানা ৯ সেমি, ঠোঁট ১.৭ সেমি, লেজ ১০ সেমি)। ওজন ২০ গ্রাম। পুরুষ পাখির লেজের ফিতা ৩৫ সেন্টিমিটার। পুরুষ পাখির বর্ণ দুই রকম হয়। সাদা ও ইটলাল। পুরুষ পাখির প্রাথমিক রং ইটলাল থাকে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পালকের রং পরিবর্তিত হয়ে সাদা হয়ে যায়। তখন তাকে আরও রাজকীয় লাগে। তবে পুরুষ পাখির মাথা, গলা, কান-ঢাকনি, ঝুঁটি ও ডানার ওপরের পালক কালো থাকে। 

ইটলাল রঙের পুরুষ পাখির পিঠের দিক লালচে ও দেহের নিচের দিক ধূসরাভাব পালক থাকে, বাকি অংশ সাদাই থাকে। উভয় পুরুষ পাখির লেজের কেন্দ্রের পালক ফিতার মতো লম্বা থাকে। পুরুষ ও মেয়ে পাখির চোখ কালচে বাদামি, ঠোঁট নীলচে ধূসর, পা ও পায়ের পাতা নীলচে ধূসর এবং নখর বাদামি। উভয় পাখির মাথায় ঝুঁটি বা চূড়া থাকে। 

এরা মূলত আমবাগানের পাখি। তবে বাঁশবনেও এদের দেখা মেলে। এরা গাছের ওপরের দিকের ছায়াময় এক ডাল থেকে অন্য ডালে ঘুরে বেড়ায়। পুরুষ পাখি খুবই লাজুক ও সতর্ক। মানুষ দেখলে লুকিয়ে পড়ে। গাছের শাখায় শাখায় খানিক বিরতি দিয়ে উড়ে পোকা ধরেই এ পাখির দিন কাটে। খাদ্যতালিকায় আছে প্রজাপতি, গুবরে পোকা, ফড়িং ও অন্যান্য পতঙ্গ। এটি গানের পাখি, কিন্তু কর্কশ স্বরে ডাকে। পাখিটি প্রায় পাঁচ রকমভাবে ডাকতে পারে। সবচেয়ে বেশি ডাকে প্রজনন মৌসুমে।

মার্চ থেকে অগাস্ট মাসে গাছের সরু শাখান্বিত ডালে মাকড়শার জাল, ঘাস, আঁশ ও পাতা দিয়ে এ পাখি বাসা বানায়। তিন-পাঁচটি ডিম দেয়। ডিমগুলো বেগুনি। ডিম ফোটে ১৩-১৫ দিনে। 

এশীয় শাবুলবুলি বাংলাদেশের দুর্লভ আবাসিক পাখি। ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনা বিভাগে মাঝারি ও ঘন আমবাগানে ও বাঁশবনে এদের দেখা যায়। গাজীপুরের গ্রামে এবং পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় এ পাখি আমি সবচেয়ে বেশি দেখেছি। 

লেখক: নিসর্গী ও পরিবেশবিদ, জার্মান অ্যারোস্পেস সেন্টার