
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের গল্পগ্রন্থ ‘ব্যথার দান’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২২ সালে। সেই গ্রন্থে বাদল বরিষণে নামে একটি গল্প রয়েছে। গল্পের শুরুতেই রয়েছে বেদনা, বৃষ্টি ও কদম ফুলের কথা- ‘বৃষ্টির ঝম-ঝমানি শুনতে শুনতে সহসা আমার মনে হলো, আমার বেদনা এই বর্ষার সুরে বাঁধা! সামনে আমার গভীর বন। সেই বনে ময়ূর পেখম ধরেছে, মাথার ওপর বলাকা উড়ে যাচ্ছে, ফোটা কদম ফুলে কার শিহরণে কাঁটা দিয়ে উঠছে, আর কিসের ঘন-মাতাল-করা সুরভিত নেশা হয়ে সারা বনের গা টলছে।’ এটি তার শ্রাবণের শুক্ল পঞ্চমীর এক বৃষ্টিমুখর রাতে প্রিয় মানুষ চঞ্চলা কিশোরী কাজরির জন্য ইউসুফের বেদনার স্মৃতি রোমন্থনের একটি বেদনাতুর গল্প। নজরুলের গান, লেটো গান, গল্প ও কবিতার অন্তত দশটি স্থানে কদমের উল্লেখ রয়েছে। কদম হলো বর্ষার দূত, আনন্দের ও প্রেমের। নজরুলের এই গল্প প্রেমের বিসর্জন ঘটিয়ে কদমকে প্রতিষ্ঠিত করেছে বেদনার প্রতীকে। রাতের বেলায় কদম ফুলের ঘ্রাণ যে না পেয়েছে, সে বুঝবে না তা মানুষকে কীভাবে স্মৃতিকাতর করে তুলতে পারে।
আষাঢ়ের এক সকালে ধামরাইয়ের সীতি গ্রামে গিয়ে দেখা পেলাম কয়েকটা কদমগাছের। ডালপালা ভরে শত শত কদম ফুল ফুটে রয়েছে। লাড্ডুর মতো গোল গোল ফুল। হলদে বলের ওপর খাড়া খাড়া সরু সাদা ফুল। এই রূপ থেকেই এ দেশে তৈরি হয়েছে রসকদম মিষ্টির। এ বছর কদমের স্ফুরণ প্রাচুর্য লক্ষ করা যাচ্ছে। রমনা, ধানমন্ডি লেকের পাড়ে, বলধায়, যেখানেই কদমগাছ দেখেছি, সব গাছেই প্রচুর ফুল ফুটেছে। পথের শিশুরা কদম পেড়ে পথে পথে বিক্রিও করছে। কোনো কোনো প্রেমিক-প্রেমিকার হাতে উঠছে সেসব ফুল। কোনো কোনো নারীর রূপসজ্জায় ঠাঁই পাচ্ছে কদম ফুল।
নারীর সৌন্দর্য ও কদম ফুল যেন সমার্থক হয়ে উঠেছে। কবি নজরুলের গানেও দেখি কদমের সেই উচ্ছ্বাস– ‘রিমি ঝিমি রিমি ঝিমি ওই নামিল দেয়া/ শুনি শিহরে কদম, বিদরে কেয়া।’ কদম আর কেয়া ফুল যেন বর্ষা প্রকৃতির সৌন্দর্য ও প্রকৃতির এক মুগ্ধকর প্রতীক হয়ে ধরা দিয়েছে এ গানে। কদমের আর এক নাম নীপ। নজরুলের গানে সে নীপবৃক্ষেরও উল্লেখ রয়েছে- ‘বিরহী কুহু-কেকা গাহিবে নীপ-শাখে/ যমুনা-নদীপারে শুনিবে কে যেন ডাকে।’
কদম আমাদের দেশের এক অনন্য রূপসী তরু। কদমের আদি নিবাস বাংলাদেশ, ভারত ও চীন। গাছ ৪৫ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। কদমের ইংরেজি নাম Burflower-tree, উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Neolamarckia cadamba ও গোত্র রুবিয়েসী।
কদমগাছ বড় বৃক্ষ, শীতে গাছের পাতা ঝরে যায় ও বসন্তে নতুন পাতা গজায়, গ্রীষ্মে গাছের ডালপালা প্রচুর পাতা ভরে ঘন ছায়া দেয়। এ জন্য এ গাছকে বিভিন্ন উদ্যান, বাগান ও পথের ধারে লাগানো হয়। এ গাছের কাণ্ড সোজা ও খাড়া, বাকল ফাটা ফাটা দাগবিশিষ্ট ও অমসৃণ। অসংখ্য ডালপালা কাণ্ডের চারদিক থেকে বের হয়। ডালের আগায় মার্বেলের মতো কুঁড়ি আসে ও ফুল ফোটে। আমরা যাকে কদম ফুল বলি, সেটি আসলে অনেকগুলো ফুলের সমষ্টি। বলের মতো গড়নটিকে বলা হয় পুষ্পমঞ্জরি, হলদে বলের ওপর গেঁথে থাকে সাদা রঙের ফুল। ফুলগুলো একটি হলদে-কমলা সুগোল বলের ওপর সুন্দরভাবে খাড়া হয়ে ফোটে, ফুল সাদা। ফুল সুমিষ্ট ঘ্রাণযুক্ত। প্রধানত বর্ষাকালে ফুল ফোটে, হেমন্তেও এখন কদম ফোটে। একটি পুষ্পমঞ্জরিতে কয়েক শ ফুল থাকে। ফুলের গোড়া যে বলের মধ্যে খাড়াভাবে গেঁথে থাকে, সে বলটিই ফুল ঝরার পর হয়ে ওঠে বীজের আধার বা ফল। কদম ফল স্বাদে টক বলে কেউ কেউ তা নুন লংকা দিয়ে চটকে খান। রাতে বাদুড়রা এসে ফল খায়, দিনে খায় কাঠবিড়ালিরা। ওরা না খেলে হয়তো দেশটাই কদমের চারা বা গাছে ভরে যেত। কেননা, একটা ফলে ৮ হাজার পর্যন্ত বীজ থাকতে পারে বলে জানা গেছে। বীজ থেকে চারা হয়। গাছ দ্রুত বাড়ে। লাগানোর পর প্রায় ৪ বছর বয়স থেকেই ফুল ফুটতে শুরু করে। ফুল ফোটা গাছের ডাল থেকে কলম করে টবে লাগালে পরের বছর থেকেই সেসব গাছে ফুল ফোটে। কদমগাছকে পথতরু ও ছায়াতরু, উদ্যানে ও পথের ধারে লাগানো যায়। বনজ গাছ হলেও শোভাময়ী। কদম কাঠ থেকে কাগজের মণ্ড ও বাক্স-পেঁটরা তৈরি হয়। এ গাছের কিছু ঔষধি গুণ আছে। পাতার রস কৃমি নাশ করে ও বাকল জ্বর সারায়।
লেখক: কৃষিবিদ ও পরিবেশবিদ