ঢাকা ২৪ আষাঢ় ১৪৩২, মঙ্গলবার, ০৮ জুলাই ২০২৫
English
মঙ্গলবার, ০৮ জুলাই ২০২৫, ২৪ আষাঢ় ১৪৩২

বাদল দিনের কদম কথা

প্রকাশ: ০৪ জুলাই ২০২৫, ০৯:৫২ এএম
বাদল দিনের কদম কথা
ধামরাইয়ের সীতি গ্রামে গাছে ফোটা কদম ফুল । ছবি: লেখক

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের গল্পগ্রন্থ ‘ব্যথার দান’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২২ সালে। সেই গ্রন্থে বাদল বরিষণে নামে একটি গল্প রয়েছে। গল্পের শুরুতেই রয়েছে বেদনা, বৃষ্টি ও কদম ফুলের কথা- ‘বৃষ্টির ঝম-ঝমানি শুনতে শুনতে সহসা আমার মনে হলো, আমার বেদনা এই বর্ষার সুরে বাঁধা! সামনে আমার গভীর বন। সেই বনে ময়ূর পেখম ধরেছে, মাথার ওপর বলাকা উড়ে যাচ্ছে, ফোটা কদম ফুলে কার শিহরণে কাঁটা দিয়ে উঠছে, আর কিসের ঘন-মাতাল-করা সুরভিত নেশা হয়ে সারা বনের গা টলছে।’ এটি তার শ্রাবণের শুক্ল পঞ্চমীর এক বৃষ্টিমুখর রাতে প্রিয় মানুষ চঞ্চলা কিশোরী কাজরির জন্য ইউসুফের বেদনার স্মৃতি রোমন্থনের একটি বেদনাতুর গল্প। নজরুলের গান, লেটো গান, গল্প ও কবিতার অন্তত দশটি স্থানে কদমের উল্লেখ রয়েছে। কদম হলো বর্ষার দূত, আনন্দের ও প্রেমের। নজরুলের এই গল্প প্রেমের বিসর্জন ঘটিয়ে কদমকে প্রতিষ্ঠিত করেছে বেদনার প্রতীকে। রাতের বেলায় কদম ফুলের ঘ্রাণ যে না পেয়েছে, সে বুঝবে না তা মানুষকে কীভাবে স্মৃতিকাতর করে তুলতে পারে। 

আষাঢ়ের এক সকালে ধামরাইয়ের সীতি গ্রামে গিয়ে দেখা পেলাম কয়েকটা কদমগাছের। ডালপালা ভরে শত শত কদম ফুল ফুটে রয়েছে। লাড্ডুর মতো গোল গোল ফুল। হলদে বলের ওপর খাড়া খাড়া সরু সাদা ফুল। এই রূপ থেকেই এ দেশে তৈরি হয়েছে রসকদম মিষ্টির। এ বছর কদমের স্ফুরণ প্রাচুর্য লক্ষ করা যাচ্ছে। রমনা, ধানমন্ডি লেকের পাড়ে, বলধায়, যেখানেই কদমগাছ দেখেছি, সব গাছেই প্রচুর ফুল ফুটেছে। পথের শিশুরা কদম পেড়ে পথে পথে বিক্রিও করছে। কোনো কোনো প্রেমিক-প্রেমিকার হাতে উঠছে সেসব ফুল। কোনো কোনো নারীর রূপসজ্জায় ঠাঁই পাচ্ছে কদম ফুল।

নারীর সৌন্দর্য ও কদম ফুল যেন সমার্থক হয়ে উঠেছে। কবি নজরুলের গানেও দেখি কদমের সেই উচ্ছ্বাস– ‘রিমি ঝিমি রিমি ঝিমি ওই নামিল দেয়া/ শুনি শিহরে কদম, বিদরে কেয়া।’ কদম আর কেয়া ফুল যেন বর্ষা প্রকৃতির সৌন্দর্য ও প্রকৃতির এক মুগ্ধকর প্রতীক হয়ে ধরা দিয়েছে এ গানে। কদমের আর এক নাম নীপ। নজরুলের গানে সে নীপবৃক্ষেরও উল্লেখ রয়েছে- ‘বিরহী কুহু-কেকা গাহিবে নীপ-শাখে/ যমুনা-নদীপারে শুনিবে কে যেন ডাকে।’

কদম আমাদের দেশের এক অনন্য রূপসী তরু। কদমের আদি নিবাস বাংলাদেশ, ভারত ও চীন। গাছ ৪৫ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। কদমের ইংরেজি নাম Burflower-tree, উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Neolamarckia cadamba ও গোত্র রুবিয়েসী।

কদমগাছ বড় বৃক্ষ, শীতে গাছের পাতা ঝরে যায় ও বসন্তে নতুন পাতা গজায়, গ্রীষ্মে গাছের ডালপালা প্রচুর পাতা ভরে ঘন ছায়া দেয়। এ জন্য এ গাছকে বিভিন্ন উদ্যান, বাগান ও পথের ধারে লাগানো হয়। এ গাছের কাণ্ড সোজা ও খাড়া, বাকল ফাটা ফাটা দাগবিশিষ্ট ও অমসৃণ। অসংখ্য ডালপালা কাণ্ডের চারদিক থেকে বের হয়। ডালের আগায় মার্বেলের মতো কুঁড়ি আসে ও ফুল ফোটে। আমরা যাকে কদম ফুল বলি, সেটি আসলে অনেকগুলো ফুলের সমষ্টি। বলের মতো গড়নটিকে বলা হয় পুষ্পমঞ্জরি, হলদে বলের ওপর গেঁথে থাকে সাদা রঙের ফুল। ফুলগুলো একটি হলদে-কমলা সুগোল বলের ওপর সুন্দরভাবে খাড়া হয়ে ফোটে, ফুল সাদা। ফুল সুমিষ্ট ঘ্রাণযুক্ত। প্রধানত বর্ষাকালে ফুল ফোটে, হেমন্তেও এখন কদম ফোটে। একটি পুষ্পমঞ্জরিতে কয়েক শ ফুল থাকে। ফুলের গোড়া যে বলের মধ্যে খাড়াভাবে গেঁথে থাকে, সে বলটিই ফুল ঝরার পর হয়ে ওঠে বীজের আধার বা ফল। কদম ফল স্বাদে টক বলে কেউ কেউ তা নুন লংকা দিয়ে চটকে খান। রাতে বাদুড়রা এসে ফল খায়, দিনে খায় কাঠবিড়ালিরা। ওরা না খেলে হয়তো দেশটাই কদমের চারা বা গাছে ভরে যেত। কেননা, একটা ফলে ৮ হাজার পর্যন্ত বীজ থাকতে পারে বলে জানা গেছে। বীজ থেকে চারা হয়। গাছ দ্রুত বাড়ে। লাগানোর পর প্রায় ৪ বছর বয়স থেকেই ফুল ফুটতে শুরু করে। ফুল ফোটা গাছের ডাল থেকে কলম করে টবে লাগালে পরের বছর থেকেই সেসব গাছে ফুল ফোটে। কদমগাছকে পথতরু ও ছায়াতরু, উদ্যানে ও পথের ধারে লাগানো যায়। বনজ গাছ হলেও শোভাময়ী। কদম কাঠ থেকে কাগজের মণ্ড ও বাক্স-পেঁটরা তৈরি হয়। এ গাছের কিছু ঔষধি গুণ আছে। পাতার রস কৃমি নাশ করে ও বাকল জ্বর সারায়।

লেখক: কৃষিবিদ ও পরিবেশবিদ

দোষ ও গুণের শিয়ালকাঁটা

প্রকাশ: ০৮ জুলাই ২০২৫, ১০:২৩ এএম
দোষ ও গুণের শিয়ালকাঁটা
ময়মনসিংহের কাচারিঘাটে জন্ম নেওয়া এক শিয়ালকাঁটা। ছবি: লেখক

বন ও নদীর ধারে জন্মানো সুন্দর হলুদ ফুলের শিয়ালকাঁটা অনেকেরই পরিচিত। এই উদ্ভিদ একই সঙ্গে বিষাক্ত এবং ঔষধি গুণসম্পন্ন। এ উদ্ভিদের কাণ্ড ভাঙলে একধরনের হলুদ ল্যাটেক্স বের হয়। এই ল্যাটেক্স বিষাক্ত। এর কাণ্ড, পাতা ও ফুলে কাঁটা থাকে। ফুল দেখতে পপি ফুলের মতো। কারণ শিয়ালকাঁটা আর পপি একই গণ আর গোত্রের উদ্ভিদ। গত ২৩ মার্চ ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র তীরের কাচারিঘাটে সকালে হাঁটতে গিয়ে একটি শিয়ালকাঁটাগাছের দেখা পাই। ঝটপট ছবি তুলে নিই। 

শিয়ালকাঁটা জন্মায় কোনো যত্ন ছাড়াই। এটি অল্প শাখাবিশিষ্ট গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ। ফল অনেকটা ডিম্বাকার ও লম্বায় ১ থেকে ১২ ইঞ্চি হয়ে থাকে। এর মধ্যে সরিষার মতো কালো রঙের বীজ থাকে। শিয়ালকাঁটা গ্রীষ্মকালে মারা যায়, শরৎকালে মাটিতে পড়ে থাকা কালো রঙের বীজ থেকে নতুন গাছ জন্মায়। এর সংস্কৃত নাম শৃগাল কণ্টক। গাছটির আরও নাম স্বর্ণক্ষীরা, স্বর্ণমুদ্রা, রুক্সিণী, সুবর্ণা, হেমদুগ্ধী, কাঞ্চনী ইত্যাদি। ইংরেজিতে শিয়ালকাঁটা মেক্সিকান পপি, মেক্সিকান প্রিকলি পপি, কারডো ইত্যাদি নামে পরিচিত।

এই গাছের কাণ্ড দেখতে কিছুটা শিয়ালের লেজের মতো এবং এর গা-ভর্তি কাঁটা। এ জন্যই এর নাম শিয়ালকাঁটা। বেলেমাটিতে ভালো জন্মায়। এর ডাঁটা রান্না করে খাওয়া যায়। এর বৈজ্ঞানিক নাম Argemone Mexicana, এটি Papaveraceae গোত্রের উদ্ভিদ। এর ফুলে পাপড়ি থাকে ছয়টি। এর বীজ ও মূলের নির্যাস থেকে তেল আহরণ করা যায়। এই তেল দিয়ে প্রদীপ জ্বালানো যায়। এর নির্যাসকে কীটনাশক হিসেবে ব্যবহার করা যায়। 

এই গাছ মেক্সিকো থেকে সারা বিশ্বে আগাছা হিসেবে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রাচীন গ্রিক ভাষায় ‘আর্জিমা’ মানে চোখের ছানি। এই গাছের রস চক্ষুরোগের চিকিৎসায় ব্যবহার হতো বলে এর গণের নাম Argemone এবং মেক্সিকোয় পাওয়া যায় বলে প্রজাতিক পদ Mexicana। এর কাণ্ড গাঢ় সবুজ ও পাতায় সাদাটে ছিট থাকে। এর পাতা ঢেউ-খেলানো ও খণ্ডিত। প্রতিটি খণ্ডের মাথায় কাঁটা থাকে। এই গাছ দেখতে অনেকটা পপিগাছের মতো। তাই একে মেক্সিকান পপিও বলা হয়।
মেক্সিকো থেকে হন্ডুরাস পর্যন্ত বিস্তৃত জায়গার স্থানীয় এই বুনোফুল প্রায় ৫০০ বছর আগে আমাদের দেশের প্রকৃতিতে ছড়িয়ে পড়ে। ষোড়শ শতকের দিকে স্প্যানিশ বাণিজ্যিক জাহাজে আলুর বস্তা ও মাটির সঙ্গে এই গাছের সরিষার মতো ছোট ছোট বীজ চলে এসেছিল এ দেশে। এভাবেই সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে গাছটি।

১৯৯৮ সালে ভারতের দিল্লির আশপাশে এর বিষক্রিয়ার প্রাদুর্ভাবে প্রায় ৬৫ জন মানুষ মারা যায়। এই বিষক্রিয়ার লক্ষণ শরীরে পানি জমে যাওয়া। এ গাছের রসে আছে কয়েক ধরনের অ্যালকালয়েডস।

শিয়ালকাঁটা ভেষজ গুণে পরিপূর্ণ। এই গাছ কৃমি, পিত্ত ও কফনাশক। জ্বর ও মূত্রকৃচ্ছ্র রোগে কার্যকর। মূলের রস কুষ্ঠরোগ নিরাময়ে কাজে লাগে। গাছের পীত বর্ণের নির্যাস গনোরিয়া ও উপদংশ রোগে বেশ উপকারী। রক্তের ক্ষমতা তৈরিতে, নতুন রক্ত তৈরিতে, দেহের ক্ষয় পূরণে, পেটের যাবতীয় রোগ নিরাময়ে শিয়ালকাঁটা ব্যবহৃত হয়। 

লেখক: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ, মুমিনুন্নিসা সরকারি মহিলা কলেজ, ময়মনসিংহ

হাজারীখিলে অবমুক্ত করা হলো ৩৩টি অজগর ছানা

প্রকাশ: ০৫ জুলাই ২০২৫, ১০:৫৭ এএম
হাজারীখিলে অবমুক্ত করা হলো ৩৩টি অজগর ছানা
অবমুক্ত করা হলো ৩৩টি অজগর ছানা।

চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় জন্ম নেওয়া ৩৩টি অজগরের বাচ্চা ফটিকছড়ি উপজেলার হাজারীখিল বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে প্রাকৃতিক পরিবেশে অবমুক্ত করেছে কর্তৃপক্ষ। 

শুক্রবার (৪ জুলাই) বিকেল ৪টায় বাচ্চাগুলো গভীর জঙ্গলে ছেড়ে দেওয়া হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. নজরুল ইসলাম, হাজারীখিল রেঞ্জ কর্মকর্তা শিকদার আতিকুর রহমান ও চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার কিউরেটর ডা. মো. শাহাদাত হোসেন শুভ।

চিড়িয়াখানার কিউরেটর শাহাদাত হোসেন শুভ বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ‘চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় ষষ্ঠবারের মতো কৃত্রিম উপায়ে অজগরের ৩৩টি বাচ্চা ফোটানো হয়। এসব অজগর ছানা ফটিকছড়ি উপজেলার হাজারীখিল বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে প্রাকৃতিক পরিবেশে অবমুক্ত করা হয়েছে। হাজারীখিল বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে অফিস কার্যালয় থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার ভেতরে ছাড়া হয় বাচ্চাগুলো।’

জানা গেছে, গত ৪ ও ১৪ এপ্রিল দুটি অজগর থেকে পাওয়া ৪৫টি ডিম সংগ্রহ করে হাতে তৈরি ইনকিউবেটরে বসানো হয়। দুই ধাপে গত ১১-১৩ জুনের মধ্যে ১৭টি ও ২১-২৪ জুনের মধ্যে ১৬টিসহ ৩৩টি অজগরের বাচ্চা জন্ম নেয়। ওই বাচ্চাগুলো পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর সক্ষমতা পাওয়ার পর অবমুক্ত করা হয়।  

 

নিরিবিলিপ্রিয় খুদে বক

প্রকাশ: ০৫ জুলাই ২০২৫, ০৯:৩০ এএম
নিরিবিলিপ্রিয় খুদে বক
তালগাছের কাণ্ডে বসে আছে খুদে বক, টাঙ্গাইল থেকে তোলা। ছবি: লেখক

গ্রীষ্মের এক সকাল। টাঙ্গাইল শহরের আশপাশের ঝোপঝাড় ও জলাশয়ের কাছে পাখি দেখতে বের হয়েছি। পানি উন্নয়ন বোর্ড অফিসের পেছনে একটি পুকুরের পাড়ে গিয়ে দেখলাম তিনটি ছোট পানকৌড়ি গাছের ডালে বসে আছে মাছ ধরার জন্য। পুকুরপাড়ের একটি আমগাছে বসে থাকা কোকিলের ছানাকে খাবার খাওয়াচ্ছে হলদে পাখি। কোকিল অন্য পাখির বাসায় ডিম পাড়ে এবং ছানাদের সেই পাখিরাই বড় করে তোলে আহার দিয়ে। কয়েকটি সিপাহি বুলবুলি, সাদাবুক মাছরাঙাও দেখা গেল। পুকুরে একটি ভাসমান তালগাছের কাণ্ডের ওপর একটি খুদে বক দেখে অবাক হলাম। কারণ এ বক কিছুটা নিরিবিলি পরিবেশ পছন্দ করে। পুকুরের চারপাশ বেশ নিরিবিলি। যে কারণে অনেক পাখির আনাগোনা।

খুদে বকটি চুপিসারে তাকিয়ে আছে জলের দিকে। শিকার দেখতে পেলেই ধরবে ঠোঁট দিয়ে। বান্দরবানের কেওক্রাডং পর্বতচূড়ায় যাওয়ার পথে বগা লেকে, মহেশখালীর প্যারাবনে এবং শেরপুর জেলার হাতিবান্ধা গ্রামেও খুদে বক দেখেছিলাম।

খুদে বক হালকা সবুজ ও হলদে চোখের জলচর পাখি। ছেলে ও মেয়ে পাখির চেহারা অভিন্ন। প্রধানত এই বক ঊষা, গোধূলী বেলায় এবং মেঘলা দিনে কর্মতৎপর থাকে। ছায়াময় জলার ধারে খুব সকালে একাকী বসে থাকে শিকারের জন্য। রোদ বাড়লেই ঝোপের আড়ালে চলে যায়। খুবই লাজুক পাখি। নিজকে আড়াল রাখতে সব সময় সতর্ক থাকে। মানুষর অস্তিত্ব কোনোভাবে টের পেলে উড়ে গিয়ে ঝোপে লুকিয়ে পড়ে। পানির কাছের মাটি ও ঝোপের সঙ্গে পালকের রং মিলে ক্যামোফ্লেজ সৃষ্টি হওয়ার কারণে খুব সহজে দৃষ্টিগোচর হয় না। বুনো পরিবেশে পাখিটি পর্যবেক্ষণ করে এ স্বভাবগুলো পাওয়া গেল। 

খুদে বক বাংলাদেশের সুলভ আবাসিক পাখি। এই সবুজ বকের বৈজ্ঞানিক নাম Butorides striatus. ইংরেজি নাম Little Green Her। পাখিটি দেশের কোথাও কোথাও সবুজ বক ও কুড়া বক নামেও পরিচিত। খুদে বকের গায়ের পালকের রং ধূসর মিশ্রিত কালো ও সবুজ। মাথা ও শিখার লম্বা পালক সবুজে কালচে, চিবুক, গাল, গলা সাদা। ঘাড়, বুক, পেট ধূসর। পিঠ, ডানা ও লেজের ওপরের দিক কালচে সবুজ। বর্ষকাল এ বকের প্রজননের সময়। জলের কাছের ঝোপে, নল বনে অগোছালোভাবে বাসা বানিয়ে সবুজ রঙের তিন থেকে পাঁচটি ডিম পাড়ে। খাদ্যতালিকায় আছে ছোট মাছ, চিংড়ি, কাঁকড়া, ব্যাঙ ও জলজ পোকা। বাংলাদেশের প্যারাবন, নদীর মোহনা, প্রবালপ্রাচীর, পাথুরে উপকূল, নদী, খাল, গ্রামের ছোট জলাশয় বা ডোবার ধারে প্রধানত বিচরণ করে। সচরাচর একাই থাকে। অগভীর জলাশয়ের কাছেই এ বক শিকার ধরতে পছন্দ করে। দেশের সব বিভাগেই খুদে বক দেখা যায়। 

লেখক: নিসর্গী ও পরিবেশবিদ, জার্মান অ্যারোস্পেস সেন্টার

নকল বোড়া সাপের কথা

প্রকাশ: ০৩ জুলাই ২০২৫, ১০:০১ এএম
নকল বোড়া সাপের কথা
সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের ছড়ার বালিতে নকল বোড়া বা পাহাড়ি সাপ। ছবি: লেখক

প্রায় ১১ বছর আগের কথা। বিরল ও দুর্লভ পাখি এবং বন্যপ্রাণীর সন্ধানে এসেছি হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে। দুপুরের খাবার সেরে খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে ডরমিটরির পেছন দিক দিয়ে ছড়ায় নেমে গেলাম। সেগুনগাছের ফলের থোকায় ফোকাস করে একটিমাত্র টেস্ট ক্লিক করে দ্বিতীয় ক্লিক করতেই শাটার বিকল হয়ে গেল। অনেক চেষ্টা করেও আর ঠিক করতে পারলাম না। যদিও সঙ্গে একটি বিকল্প ক্যামেরা রয়েছে। কিন্তু সেটা দিয়ে স্থির হয়ে বসে থাকা বা ধীরে চলা প্রাণীদের ছবি ভালো তোলা গেলেও দ্রুতগামী ও উড়ন্ত পাখি-প্রাণীর ছবি তোলা কঠিন হয়ে পড়ে। কাজেই এবারের ট্রিপটাই নষ্ট হয়ে গেল মনে হয়! মনটা একেবারেই খারাপ হয়ে গেল। 

পরদিন সকালে ওই বিকল্প ক্যামেরার ওপর ভরসা করেই ছড়ায় নামলাম। প্রায় আড়াই ঘণ্টা বিভিন্ন স্থানে পাখি-প্রাণী খুঁজে বেলা ১০টা ৪৯ মিনিটে শুকনো ছড়ার বালির ওপর দিয়ে ছোট্ট একটি নলাকার প্রাণীকে ধীরগতিতে এঁকেবেঁকে চলে যেতে দেখলাম। 

প্রাণীটিকে বেশ কবছর ধরে খুঁজছিলাম। কিন্তু এতবার সাতছড়ি, লাউয়াছড়া ও কাপ্তাই জাতীয় উদ্যান, রাজকান্দি সংরক্ষিত বনাঞ্চল এবং রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে গিয়েও কোনো দিনই প্রাণীটির দেখা পেলাম না। দ্রুত বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে ওর কিছু ছবি তুলে নিলাম। সঙ্গে থাকা সাতছড়ির গাইড প্রসেনজিৎ দেববর্মা একটি সরু শুকনো ডাল প্রাণীটির সামনে আলতো করে ধরতেই সে ওটা বেয়ে খানিকটা উঠে কয়েলের মতো ডালটিকে পেঁচিয়ে ছোবল মারার মতো ভঙ্গি করে থাকল। সাড়ে ১৪ মিনিট প্রাণীটির সঙ্গে সময় কাটিয়ে একটি গাছের ডালে রাখতেই সে ঝোপের ভেতরে চলে গেল। দেহের রং দেখে এটিকে একটি স্ত্রী প্রাণী বলেই মনে হলো। 

পরদিন সকালে ছড়ায় হাঁটার সময় আরেকটি একই প্রজাতির প্রাণীর সঙ্গে দেখা হলো। তবে ওর দেহের রং গতকালেরটির থেকে কিছুটা হালকা ও উজ্জ্বল। রং দেখে মনে হলো এটি পুরুষ। ওর বেশ কিছু ছবি তোলার পর প্রসেনজিৎ প্রাণীটিকে আলতো করে সরু ডালে তুলল। আমি ভালোভাবে লক্ষ করলাম প্রাণীটির হার্টবিট বেড়ে গেছে। সে বেশ ভয় পাচ্ছে মনে হলো। অথচ ওর ছবি দেখলে যে কেউ মনে করতে পারে যে প্রাণীটি অত্যন্ত ভয়ংকর ও বিষাক্ত। ছবিতে প্রাণীটির চেহারা যতটাই ভয়ংকর মনে হোক না কেন, ও যে আসলে একটা ভীতু প্রাণী তার প্রমাণ তো পেলাম। যা হোক, প্রসেনজিৎকে বললাম দ্রুত প্রাণীটিকে ছেড়ে দিতে। বড় একটি পাতার ওপর নামিয়ে দিতেই সে দ্রুত ঝোপের ভেতর হারিয়ে গেল। দুই দিনে একটি নতুন প্রাণীর স্ত্রী-পুরুষের দেখা পেয়ে ও ছবি তুলতে পেরে ক্যামেরা নষ্ট হওয়ার দুঃখ ভুলে গেলাম। 

সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে দেখা নলাকার এই প্রাণীটি আর কেউ নয়, এ দেশের সচরাচর দৃশ্যমান ও স্বল্প ঝুঁকিসম্পন্ন একটি নির্বিষ সাপ। নাম তার পাহাড়ি বা নকল বোড়া সাপ। ইংরেজি নাম Mock Viper বা Common Mock Viper। স্যামোডাইনেস্টেস (Psammodynastes) গোত্রের সাপটির বৈজ্ঞানিক নাম Psammodynastes pulverulentus।  এরা চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের মিশ্র চিরসবুজ বনে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত। বাংলাদেশ ছাড়াও উত্তর-পূর্ব ভারতসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশ এবং চীনের কয়েকটি অঞ্চলে দেখা যায়। 

এটি ছোট, নলাকার ও মসৃণ আঁশযুক্ত সাপ। সচরাচর দৈর্ঘ্য ৪০ থেকে ৬৫ সেন্টিমিটার। সর্বোচ্চ ৭৭ সেন্টিমিটার হতে পারে। দেহের রঙে বেশ তারতম্য রয়েছে। স্ত্রীগুলো সচরাচর গাঢ় ও পুরুষগুলো হালকা রঙের। দেহের ওপরটা হালকা থেকে গাঢ় বাদামি বা ধূসর ও মাথায় বৈশিষ্ট্যসূচক দ্বিধাবিভক্ত নকশা রয়েছে। হালকা ও গাঢ় বাদামি ডোরা দেহের দৈর্ঘ্য বরাবর চলে গেছে, যা কালো রঙের ছোট ছোট ফোঁটার কারণে মাঝেমধ্যে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এই ফোঁটাগুলোর মাঝখানটা সাদা। দেহের নিচটা ফ্যাকাশে, যাতে বাদামি রঙের ফুটকি রয়েছে। 

নকল বোড়া সমতল ভূমি ও পাহাড়ি বনাঞ্চলে বাস করে। এরা মূলত স্থলজ প্রাণী। তবে ঝোপজঙ্গল ও গাছে চড়তে পারে এবং গাছের ডাল থেকে পানির ওপর ঝুলে থাকতে দেখা যায়। নিশাচর ও দিবাচর সাপগুলো সচরাচর একাকী বিচরণ করে। এরা অবিষধর বা নির্বিষ সাপ। ভয় পেলে বোড়া সাপের মতো দ্রুত ছোবল মারে ও নিজেকে গুটিয়ে ফেলে। আর সে কারণেই ভিন্ন গোত্রের সদস্য হয়েও তাদের এই নাম। এদের প্রধান খাদ্য ব্যাঙ, টিকটিকি, ছোট সাপ ইত্যাদি। 

সচরাচর জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর বংশবৃদ্ধির সময়। স্ত্রী সাপ পরিবেশে ডিম পাড়ে না, বরং নিষিক্ত ডিম্বাণু বা ডিম জরায়ুতে অবস্থান করে। এখানেই ভ্রুণ বৃদ্ধি লাভ করে ও বাচ্চা ফোটে। এরপর বাচ্চগুলো মায়ের জরায়ু থেকে পরিবেশে বেরিয়ে আসে। স্ত্রী সাপ একসঙ্গে ৩ থেকে ১০টি বাচ্চার জন্ম দেয়।             

লেখক: পাখি ও বন্যপ্রাণী প্রজনন ও চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ, গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

চোখজুড়ানো কাঁটামুকুট ফুল

প্রকাশ: ০১ জুলাই ২০২৫, ১০:০১ এএম
আপডেট: ০১ জুলাই ২০২৫, ১০:৪০ এএম
চোখজুড়ানো কাঁটামুকুট ফুল
ময়মনসিংহের কাচারিঘাটের এক নার্সারিতে কাঁটামুকুট। ছবি: লেখক

গত ১৩ জুন সকালে গিয়েছিলাম ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র তীরের কাচারিঘাটের খানে মোহাম্মদ আলী নার্সারিতে। ওখানেই পেয়ে গেলাম কাঁটামুকুটের দেখা। ছবি তুলে ফেললাম ঝটপট। কাঁটামুকুট কাষ্ঠল উপগুল্ম। এটি ইংরেজিতে  crown of thorns, Christ plant, Christ thorn ইত্যাদি  নামে পরিচিত। এর বৈজ্ঞানিক নাম  Euphorbia milii, এটি Euphorbiaceae পরিবারের উদ্ভিদ। এদের আদি নিবাস মাদাগাস্কার। মাদাগাস্কারের পূর্ব দিকে অবস্থিত ভারত মহাসাগরের ফরাসি দ্বীপ লা রিইউনিয়নের (প্রাক্তন বোরবন দ্বীপ) গভর্নর Baron Milius এই  প্রজাতিটিকে ১৮২১ সালে ফ্রান্সে নিয়ে আসেন।  তার প্রতি সম্মানার্থে প্রজাতির নামকরণ করা হয়েছে। অনুমান করা হয় যে যিশুখ্রিষ্টকে এ গাছের কাঁটার মুকুট পরানো হয়েছিল। বিভিন্ন বর্ণের ও গঠনের কাঁটামুকুট জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এবং বাগানে ও টবে স্থান পেয়েছে।    

গ্রিক চিকিৎসক Euphorbus-এর  প্রতি সম্মানস্বরূপ এই উদ্ভিদ গণের নাম রাখা হয়েছে Euphorbia। নেপালে ও ভারতের কেরালা রাজ্যে এই গাছ পাওয়া যায়। কথিত আছে, কেরালায় যে ইহুদিরা বাস করেন তারা ইসরায়েল থেকে কাঁটামুকুট ভারতে এনেছেন।

কাঁটামুকুট বিরূপ পরিবেশে এবং প্রতিকূল পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে সক্ষম। বলতে গেলে যত্নআত্তি ছাড়াই ঘরে ও আঙিনায় বেড়ে ওঠে। এ জন্য শোভাবর্ধক উদ্ভিদ হিসেবে এর কদর রয়েছে। এর বাণিজ্যিক সম্ভাবনাও প্রচুর। 
এই গাছ পানি ও সরাসরি সূর্যের আলো পছন্দ করে। তাই নিয়মিত পানি দিতে হবে। গাছ দ্রুত বৃদ্ধির জন্য পুরোনো ও বাদামি পাতা, পাতা ছাড়া ডাল কেটে ফেলতে হবে। তবে ফাঙ্গাস রোগ এড়ানোর জন্য মাটিতে পড়া মৃত ও ঝরে পড়া পাতা সরিয়ে ফেলতে হবে। ডাল কাটার সময় একদম ডালের গোড়া থেকে কাটতে হবে। এর জন্য অবশ্যই প্লাস্টিকের গ্লাভস পরতে হবে আর লম্বা কাঁচি ব্যবহার করতে হবে। 

এর কাণ্ড বা ডাল ভাঙলে অথবা কেটে ফেললে কিংবা ফুল ছিঁড়লে যে কষ বের হয় তা দুধের মতো ধবধবে সাদা। কষ দীর্ঘক্ষণ ধরে ঝরতে থাকে। এই কষ বিষাক্ত এবং ত্বকের সংস্পর্শে এলে জ্বালা ও অস্বস্তির সৃষ্টি হয়। 

কাঁটামুকুটের কাঁটাও বিষাক্ত। কাঁটা শরীরে ফুটলে বা কাঁটার খোঁচা লাগলে ত্বকে ও মাংসে যন্ত্রণা হয়।  সাদা কষ বন্ধ করার জন্য কেটে ফেলা বা ভেঙে ফেলা জায়গায় বরফ বা ঠাণ্ডা পানি দিতে হবে।

সারা গায়ে কাঁটাভরা এ গাছটি ধীরে ধীরে বৃক্ষপ্রেমীদের মন কেড়ে নিচ্ছে। বাসগৃহের সামনে, ঘরের বারান্দায়, ভবনের ছাদে কেউ গাছ লাগালে কাঁটামুকুট লাগাতে ভুলেন না। গাঢ় সবুজ পাতাবিশিষ্ট গাছটি চোখজুড়ানো ফুল দিয়ে থাকে। ফুল ফোটে সারা বছর। কাটিং থেকে এর বংশবৃদ্ধি (Propagation) করা সহজ ও সুবিধাজনক।

লেখক:  অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ, মুমিনুন্নিসা সরকারি কলেজ, ময়মনসিংহ