
২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাস। সারা দেশে নির্বাচনের ডামাডোল চলছে। ১২ নভেম্বরেই সিদ্ধান্ত হয়েছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টসহ মিত্র দলগুলোকে নিয়ে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে। কালের কণ্ঠে ডেপুটি এডিটর পদে কাজ করলেও তখন পর্যন্ত বিএনপি বিটে বেশ সক্রিয় সাংবাদিক ছিলাম। ফলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেখে বুঝতে পারছিলাম, বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলেও সর্বত্রই শেখ হাসিনা সরকারের নিয়ন্ত্রণ বেশ শক্তভাবেই আছে।
তবে প্রতিকূল সব পরিস্থিতির মধ্যেও বিএনপি নির্বাচনে যাক, এমনটা অন্য অনেকের সঙ্গে আমিও চেয়েছিলাম। কারণ হলো, প্রথমত, পরপর দুবার নির্বাচন বর্জন করলে গণপ্রতিনিধিত্ব আইন অনুযায়ী বিএনপির নিবন্ধন বাতিল হওয়ার সুযোগ ছিল। দ্বিতীয়ত, আমি যে কারণে চেয়েছিলাম, সেটি ছিল ব্যক্তিগত লাভ-অলাভের হিসাব থেকে। বিএনপির নিবন্ধন বাতিল হলে দলটির রাজনীতি হুমকির মুখে পড়বে। আর তাতে বিএনপির ‘বিট’ বলতে আর কিছু থাকবে না। এমন পরিস্থিতি তৈরি হলে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর রাজনীতির বিষয়ে আমার যে ‘এক্সপার্টিজ’ বা বিশেষ অভিজ্ঞতা, সেটি আর কোনো কাজে আসবে না।
আরও খোলাসা করে বললে এর অর্থ হলো, বিএনপি না থাকলে বিএনপি বিটের আর কোনো সাংবাদিক জাতীয় দৈনিকগুলোতে প্রয়োজন হবে না। মোট কথা, প্রয়োজন না হলে আমাদের আর চাকরিতে না-ও রাখা হতে পারে। কারণ, বিএনপি বা বিরোধী দলগুলোর কর্মকাণ্ড না থাকলে এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ সাংবাদিককের আর দরকার হবে না। তাদের ‘ইউটিলিটি’ বা উপযোগিতা শেষ হয়ে যাবে। আমাদের আর চাকরি থাকবে না।
খবরের কাগজের নির্বাহী সম্পাদক হওয়ার পরে এখন অবশ্য বিট সাংবাদিকতার গণ্ডি পেরিয়ে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষণমূলক লেখালেখির পাশাপাশি পত্রিকার নিউজ পরিকল্পনা ও অন্যান্য কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছি। কাজের পরিধি এখন অনেক বেড়েছে। পত্রিকার ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যুক্ত হয়েছি। তবে ‘বিএনপি বিটে’র সাংবাদিক এই পরিচিতি এখনো আছে।
২০১৮ সালের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। বিএনপি বিটের পাশাপাশি সক্রিয় বেশির ভাগ সাংবাদিকের মনে থাকার কথা, ‘নির্বাচনে ন্যূনতম ফলাফল অনুকূলে না গেলে বিএনপি বিট বলতে আর কিছুই থাকবে না’- এমন আলোচনা একাদশ সংসদ নির্বাচনের সময় গণমাধ্যমে বেশ চাউর হয়েছিল। সঙ্গে এও বলা হয়েছিল, ক্ষমতায় গেলে শেখ হাসিনা সরকারের ক্ষমতাধর লোকেরাই মালিকদের চাপ দিয়ে বিএনপি বিটের সাংবাদিকদের চাকরিচ্যুত করবে। কারণ বিএনপি বিটের সাংবাদিক মানেই সমাজে বিএনপিপন্থি বলে পরিচিত। বিএনপিপন্থি ইউনিয়ন বা পেশাগত সংগঠনে সক্রিয় না হলেও বিট করার কারণে তার গায়ে এক ধরনের দলীয় ‘সিল’ পড়ে যায়। তার ‘ব্র্যান্ড’ হয়ে যায় বিএনপিপন্থি সাংবাদিক হিসেবে। একইভাবে দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের বিট করলেও আওয়ামীপন্থি সাংবাদিক হিসেবে চিহ্নিত হতে হয় তাকে।
বলা বাহুল্য, ৫ আগস্ট সরকার পতনের আগ পর্যন্ত গণমাধ্যমে আওয়ামীপন্থি সাংবাদিকরাই প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন। বড় বড় পদও তাদেরই দখলে ছিল। বিএনপিপন্থি বলে পরিচিত অধিকাংশ সাংবাদিক বেকার হয়ে পড়েছিলেন। কেউ চাকরি হারিয়ে এবং কেউবা হারানোর ভয়ে বিদেশে চলে গিয়েছিলেন। সিনিয়রদের মধ্যে যে অল্প কজন সাংবাদিক কঠোর পরিশ্রমের পাশাপাশি নানা কৌশলে টিকে ছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলাম আমি। ২০২১ সালের অক্টোবরে অবশ্য ওই কৌশলও ব্যর্থ হয়। কোনো অনিয়ম, বিতর্কিত কর্মকাণ্ড, এমনকি সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ড না করার পরেও বিনা কারণে হঠাৎ করেই ৩ অক্টোবর সকালে কালের কণ্ঠর উপ-সম্পাদক পদ থেকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। কারণ, আমার চেয়ে কম বয়সী এবং কম অভিজ্ঞতাসম্পন্ন নবনিযুক্ত একজন সম্পাদক চাইছিলেন না যে, এত সিনিয়র একজন সাংবাদিক কালের কণ্ঠে কাজ করুক। আমি বহাল থাকলে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা ওই সম্পাদকের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই কালের কণ্ঠর মালিকরা শুধু ‘অসফল’ (পরবর্তী সময়ে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়) ওই সম্পাদকের ইচ্ছা পূরণ করেছিলেন।
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের ঘটনা সবার জানা। ‘রাতের নির্বাচন’ নামে পরিচিত ওই নির্বাচনে বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট মিলে মাত্র ৯টি আসন লাভ করে। সম্পূর্ণ একটি ‘ফ্রড’ নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের পাশাপাশি বিশ্ব গণমাধ্যমেও আলোচিত হয়েছিল।
সে যা-ই হোক, ৯টি আসন পেয়ে নানা আলোচনা ও বিতর্কের পর বিএনপি একাদশ সংসদে যোগদান করে। তবে ২০১৮ সালের নির্বাচনের পরে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিকভাবে বিএনপি কিছুটা দুর্বল হলেও রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়নি। সবচেয়ে বেশি রিপোর্ট ও লেখালেখি তখনো বিএনপিকে নিয়েই হয়েছে। ফলে গুরুত্বহীন হলেও ওই যাত্রায় কোনো রকমে টিকে ছিল বিএনপি বিট।
২০২৪ সালে বিএনপি ও বিরোধী দলবিহীন নির্বাচনের আগে আবারও আলোচনা জোরদার হয় যে, বিএনপি বিট বলে কিছু থাকবে না। বিটের সাংবাদিকরাও ধরে নিয়েছিলেন যে, আর কী বিট! চাকরি তো যাবেই, জীবন না যায়! স্পষ্ট মনে আছে, শেখ হাসিনা বা সরকারের সমালোচনা সাংবাদিকদের মধ্যে প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বিএনপি বিটের সাংবাদিকদের জন্য বিষয়টি আরও বেশি স্পর্শকাতর ছিল বলে ভয়ে কোনো কথাই বলতাম না। খবরের কাগজের সম্পাদক মোস্তফা কামালের কাছে এ জন্য চিরকৃতজ্ঞ যে, বিএনপি বিটের সিনিয়র সাংবাদিক হওয়ার পরেও সাহস করে তিনি আমায় চাকরি দিয়েছিলেন। এ জন্য অবশ্য বারবার গোয়েন্দা সংস্থার চাপের মুখে পড়তে হয়েছিল তাকে। আমার প্রতি ভালোবাসার কারণে তিনি এগুলো বেশ কয়েকবার সামাল দিয়েছেন। ‘বিএনপির এক কোটিরও বেশি নেতা-কর্মী ঘরছাড়া’ শিরোনামে একটি লিড রিপোর্ট করার জন্য সরকারের চাপে আমাকে প্রায় এক মাস বাসায় থাকতে হয়েছে। আমাকে চাকরিচ্যুত করার জন্য প্রবল চাপ থাকলেও কামাল ভাই সেটি করেননি।
কিন্তু পৃথিবীর কী অদ্ভুত নিয়ম। প্রকৃতির কী খেলা। সরকারের সব বাড়াবাড়ি উল্টে গেল ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে। এ জন্যই বলা হয়, মহান আল্লাহ হলেন শ্রেষ্ঠ পরিকল্পনাকারী। রাজনৈতিক ‘মিথ’ তৈরি হয়েছিল শেখ হাসিনা সরকারকে সরানো যাবে না। আলোচনা ছিল এবং আমরা বিশ্বাসও করতেম যে, বিএনপি বিট থাকবে না। কিন্তু বাস্তবতা হলো, অন্তত এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগ বিট বলতে কিছু নেই। কারণ দলটির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের পাশাপাশি দলটির অধিকাংশ নেতা-কর্মী আত্মগোপনে। চাকরিচ্যুত না হলেও দেশে প্রভাব কমে গেছে তাদের।
রাজনৈতিক বিটের সিনিয়র সাংবাদিক হিসেবে বলতে পারি, আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিয়ে রিপোর্ট করার অনেক বিষয় থাকা সত্ত্বেও গণমাধ্যমের ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িতরা পারতপক্ষে ওই বিষয়ে লিখতে আগ্রহী নন। কারণ আওয়ামী লীগের নাম নিলেও ‘ফ্যাসিবাদ পুনর্বাসনের’ অভিযোগ উঠতে পারে। বেশির ভাগ গণমাধ্যম আওয়ামী লীগের নাম নিতেও এখন ভয় পাচ্ছে, এটাই বাস্তব পরিস্থিতি। এক কথায় আওয়ামী লীগের বিট থাকবে কি না, এটাই এখন বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, একটানা প্রায় ১৬ বছর ক্ষমতায় থাকার কারণে সাংবাদিকরা গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছিলেন আওয়ামী লীগের কাছে। আওয়ামী লীগপন্থি বলে পরিচিত প্রভাবশালী সাংবাদিকরা সরকারের পক্ষে থেকে বিধানমতো চাকরি করেছেন; কেউ কেউ নিজের ‘আখের’ও গুছিয়েছেন। কিন্তু সার্বিকভাবে সাংবাদিক সমাজের গুরুত্ব কমে গিয়েছিল। অথচ এখন মাত্র পঞ্চাশ বা এক শ শব্দের একটি রিপোর্ট ছাপার জন্য দলটির নেতাদের অনুরোধ, অনুনয়-বিনয় প্রত্যক্ষ করছি। এমন বিপদ হতে পারে দলটির নেতারা কখনো কল্পনাও করেননি। বিষয়টি বিএনপির জন্যও শিক্ষণীয়। আলোচনা ছিল বিএনপি বিট থাকবে না। এখন আওয়ামী লীগ বিটই হুমকির মুখে। কার টিকে থাকার কথা, আর কে টিকে থাকে!
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক খবরের কাগজ