সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে হাতে হাত রেখে কাজ করার শপথ নিয়েছে রাজধানীর বিভিন্ন স্কুল-কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীরা। অন্যায়-অবিচার দূর করে বিজ্ঞানমনস্ক এক আধুনিক রাষ্ট্র গড়ে তোলার শপথ নিয়েছে তারা। ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের এই নির্মাতারা দৃপ্তকণ্ঠে শপথ নিয়েছে, মহান মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস পাঠ করে একাত্তরের চেতনাকে প্রজন্মান্তরে বয়ে নিয়ে যাবে।
শুক্রবার (২ ফেব্রুয়ারি) সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর আয়োজিত ‘মুক্তির উৎসব’-এ এসে তারা এ শপথ নেয়। রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দুই হাজারের বেশি শিক্ষার্থী মুক্তির উৎসবে অংশ নেয়।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের শিক্ষা কর্মসূচির অধীনে বিগত বছরে অংশগ্রহণকারী ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে ২২তমবারের মতো এ উৎসব আয়োজন করা হয়। এবারের উৎসবের মূল প্রতিপাদ্য- ‘আমরা সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদা নিশ্চিত করব।’
বীর বিক্রম আশালতা বৈদ্য ও বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল (অব.) জাফর ইমাম শিক্ষার্থীদের শপথবাক্য পাঠ করান।
এদিন সকাল ৯টায় ছায়ানটের শিল্পীদের কণ্ঠে জাতীয় সংগীত পরিবেশনার সঙ্গে জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও বেলুন উড়িয়ে উৎসবের উদ্বোধন করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টিরা। পরে অনিক বোসের দল স্পন্দন, পল্লীবাংলার ব্রতচারী সংঘ, ইউনিসেফ বাংলাদেশ, স্পর্শ ফাউন্ডেশন, ব্রাইট স্কুল অ্যান্ড কলেজের খুদে শিল্পীরা সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় অংশ নেয়।
শপথবাক্য পাঠ করানোর পর বীর বিক্রম আশালতা বৈদ্য তাদের উদ্দেশে বলেন, ‘অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বাংলাদেশ আজকের অবস্থানে এসে পৌঁছেছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সামনে রেখে তোমরা কাজ করে যাবে। সব সময় মনে রাখবে, এ দেশ আমার, মাটি আমার, মানুষ আমার। তোমরা বাংলাদেশকে ভালোবাসবে।’
মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়িত করতে গেলে তার ইতিহাস সঠিকভাবে পাঠ করার আহ্বান জানিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা জাফর ইমাম বলেন, ‘আজ ইতিহাস ভুলে যাওয়ার প্রবণতা দেখি। কারণ দেশে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোনো চর্চা নাই, গবেষণা নাই। দেশটা তো হাওয়ায় স্বাধীন হয় নাই, রাতারাতিও মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়নি। আমরা দলমত নির্বিশেষে দেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে একতাবদ্ধ ছিলাম সেটি নতুন প্রজন্মকে জানতে হবে।’ রাজনৈতিক বিভেদের কারণে যারা জাতির জনক হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অস্বীকার করেন, তাদের এ দেশে থাকার অধিকার নেই বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তরুণদের সতর্ক করে দিয়ে তিনি বলেন, ‘এ দেশে যদি বঙ্গবন্ধুই না থাকে, তবে দেশটা পাকিস্তানি ভাবধারায় চলে যেতে পারে। সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।’
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. সারওয়ার আলী বলেন, ‘আমরা যখন যুদ্ধ করেছিলাম, স্বপ্ন দেখেছিলাম সমঅধিকারের ভিত্তিতে এ রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে। তোমরা সেই সমাজে মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করবে। এখানে কেউ যেন ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত না হয়।’
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি সারা যাকের মঞ্চে এসে কবি শামসুর রাহমানের ‘স্বাধীনতা তুমি’, কবি রবিউল হুসাইনের ‘প্রিয়তমা বাংলাদেশ’ কবিতা থেকে পাঠ করেন।
এ সময় সারা যাকের শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, ‘এ দেশ সবার। এখানে হিন্দু-মুসলমানরা যেভাবে ধর্ম পালন করেন, ঠিক সেভাবে বৌদ্ধরাও তাদের ধর্ম পালন করেন। আমরা যারা সমতলে বাস করি তাদের, যারা পাহাড়ে বসবাস করে তাদের সংস্কৃতি একেক রকম। আমরা সবাই মিলে বাঙালি। আমাদের উচিত সবাইকে সম্মান করা, সবার সমান অধিকার নিশ্চিত করা। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে আমরা সামাজিক ন্যায়বিচার, মানবিক মর্যাদা নিশ্চিত করব।’
শেষে কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, ‘তোমরা সবাই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ভালোমতো পড়বে। তা হলে দেখবে তোমাদের বুক একশ হাত ফুলে উঠবে। পৃথিবীর আর কোনো দেশ আমাদের মতো এত দাম দিয়ে স্বাধীনতা কেনে নাই। একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধারা যে স্বপ্ন দেখে গিয়েছিলেন এ দেশের জন্য, তা তোমরা পূরণ করবে। তা হলে তাদের প্রতি সম্মান দেখানো হবে।’
কথন ও সাংস্কৃতিক পরিবেশনার শেষে ছিল বাপ্পা মজুমদারের পরিবেশনা।
মুক্তির উৎসবে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনুষ্ঠিত র্যাফেল ড্রয়ে ১০০ জন বিজয়ীকে ল্যাপটপ, ট্যাব, মুক্তিযুদ্ধের বই, টি-শার্ট পুরস্কার দেওয়া হয়।
জয়ন্ত/সালমান/