জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালটির নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০০৩ সালে। শেষ হয় ২০১৯ সালে। এরপর শুরু হয় এর চিকিৎসা কার্যক্রম। কিন্তু কয়েক বছর না যেতেই ২৫০ শয্যার এ হাসপাতালটি ধুঁকতে শুরু করেছে। রোগীদের অনেকেই ঠিকমতো চিকিৎসা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ডাক্তার, নার্সসহ শূন্য পদ রয়েছে ১৫৪টি। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক প্রতিবেদন ও সরেজমিন ঘুরে এসব তথ্য জানা গেছে।
এ ব্যাপারে পরিচালক অধ্যাপক ডা. খায়ের আহমেদ চৌধুরী খবরের কাগজকে বলেন, ‘সকাল ৭টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত হাসপাতালের সময় নির্ধারণ করা থাকলেও জরুরি বিভাগে ২৪ ঘণ্টা রোগী দেখা হয়। এখানে সরকারের নির্ধারিত ফির বাইরে কোনো অর্থ নেওয়া হয় না। এখানে সরকারিভাবে যে ওষুধ সরবরাহ করা হয় তার পুরোটাই রোগীদের বিনামূল্যে সরবরাহ করা হয়। সরকারিভাবে সরবরাহকৃত লেন্স বিনামূল্যে সরবরাহ করা হয়। সক্ষমতার মধ্যেই রোগীদের ভালো চিকিৎসা দেওয়া হয়।’
বাংলাদেশে চক্ষু চিকিৎসার অন্যতম প্রধান এই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলার লস্কর ইউনিয়নের ৭০ বছরের ব্যক্তি মো. আবদুল সাত্তার। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে গুরুতর আহত হন তিনি। উন্নত চিকিৎসার জন্য এখানে ছুটে আসেন। সাত মাস চিকিৎসাও নিয়েছেন। তার দুই চোখে তিনবার অপারেশন করা হয়েছে। তার পরও ডান চোখ সম্পূর্ণরূপে নষ্ট হয়ে গেছে। বাম চোখে এখনো চিকিৎসা চলছে। আবদুল সাত্তারের অভিযোগ, জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসা নিতে এলেও চিকিৎসকদের সিরিয়াল পেতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা
করতে হয়। পরীক্ষা ও অপারেশনের জন্য দীর্ঘ লাইন ধরতে হয়। রোগীর তুলনায় চিকিৎসক ও নার্সের সংখ্যা কম।
শুধু প্রবীণরা নন, শিশুরাও পর্যাপ্ত এবং উন্নত সেবা পাচ্ছে না। ঢাকা জেলার সাভার উপজেলার নবীনগর গ্রামের তিন বছরের রিফাত। সিলিং ফ্যান পড়ে তার চোখ ও মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত হয় রিফাত। ফ্যানের পাখা (ব্লেড) তার চোখে লাগে। উন্নত চিকিৎসার জন্য শিশুটি আসে চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে। দুই দিন চিকিৎসা দেওয়ার পর তাকে ছাড়পত্র দিয়ে দেওয়া হয়। বাড়ি যাওয়ার পাঁচ দিন পর রিফাতের চোখে প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হয়। বাধ্য হয়ে পরিবারের সদস্যরা রিফাতকে আউটডোরে চিকিৎসার জন্য নিয়ে আসেন। পরিবারের অভিযোগ, সেবা পেতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়; যা শিশুদের জন্য বিরক্তিকর ও ক্লান্তিকর।
নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁয়ের মোগড়াপাড়ার ইসমত আরা বেগম লিপি চোখের ছানি অপারেশন করতে আসেন চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে। সেখানে ডান চোখের অপারেশনও করা হয়। তবে সমস্যার সমাধান হয়নি। বাধ্য হয়ে রোগী উন্নত চিকিৎসার জন্য ভারত পাড়ি জমান। শুধু লিপিই নন, সম্প্রতি হাসপাতালের বিভিন্ন তলায় ঘুরে বিভিন্ন বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা অভিযোগ করেন, উন্নত চক্ষু চিকিৎসার সেবা নিতে এসে এই হাসপাতালে ডাক্তারের অবহেলার কারণে অনেকেই ভুগছেন।
২৫০ শয্যাবিশিষ্ট চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল প্রকল্পটি শেষ করার কথা ছিল তিন বছরের মধ্যে। তবে প্রকল্পের মেয়াদ বেড়েছে ৪৩৩ শতাংশ ও খরচ বেড়েছে ৪১ শতাংশ। ১৬ বছরে এই কাজটি করেছেন চারজন প্রকল্প পরিচালক। প্রকল্পের শুরুতে ২০০৩-এর ১০ নভেম্বর থেকে ২০০৯ সালের ২০ মার্চ পর্যন্ত প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন অধ্যাপক ডা. মো. শাহাব উদ্দিন। এরপর ২০১৭ সালের ৩১ জুলাই পর্যন্ত প্রকল্প পরিচালক ছিলেন ডা. মো. রেজানুর রহমান। ২০১৮ সালের ২ জানুয়ারি পর্যন্ত পাঁচ মাসের জন্য পিডির দায়িত্ব পালন করেছেন অধ্যাপক ডা. মোস্তফা কামাল মজুমদার। এরপর ২০১৯ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সর্বশেষ প্রকল্প পরিচালক ছিলেন অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ গোলাম রসুল।
৯৩ পদে শূন্য ১৫৪
এই হাসপাতালে ৯৩টি পদে মোট ৬১৯ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীসংবলিত একটি জনবল কাঠামো সরকার অনুমোদন করে। বর্তমানে কর্মরত ৪৬৫ জন। ১৫৪ জনকে এখনো নিয়োগ দেওয়া হয়নি। এর মধ্যে শীর্ষ পর্যায়ে পরিচালক ও উপপরিচালক কর্মরত থাকলেও সহকারী ও প্রকৌশলী পদ দুটি একেবারে খালি রয়েছে। ১১ জন অধ্যাপকের বিপরীতে কর্মরত মাত্র তিনজন। ২০ জন সহযোগী অধ্যাপকের মধ্যে ১৭ জন, ২৫ জন সহকারী অধ্যাপকের মধ্যে ১৪ জন, ২১৭ জন সিনিয়র স্টাফ নার্সের মধ্যে ২১২ জন, ৩১ জন ওয়ার্ড বয়ের মধ্যে ১০ জন কাজ করছেন। এ ছাড়া ৪২ জন ক্লিনিং স্টাফের মধ্যে কাজ করছেন মাত্র একজন ও ১৬৩ জন তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির স্টাফের মধ্যে কাজ করেন ১০৮ জন। এভাবে বিভিন্ন পদে ৬১৯ জনের মধ্যে কাজ করেন ৪৬৫ জন।
এখানে শুধু সেবা দেওয়াই হয় না। এফসিপিএসসহ পাঁচ প্রকারের উচ্চতর ডিগ্রি ও প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা আছে। এ পর্যন্ত ১৩৯ জন ডাক্তারকে এফসিপিএস ডিগ্রি দেওয়া হয়েছে। এভাবে ডিও, এমএস, ফেলোশিপ প্রশিক্ষণ ও এইচএমও- এই পাঁচ বিভাগে ১ হাজার ৬২ জনকে ডিগ্রি দেওয়া হয়েছে।
প্রকল্পের টাকা সঠিকভাবে খরচ করা হয়েছে কি না, তা দেখভাল করতে ২২টি অডিট আপত্তি উত্থাপিত হয়েছিল। প্রকল্পের মেয়াদ ২০১৯ সালে অর্থাৎ ছয় বছর আগে শেষ হলেও একটি অডিট আপত্তি এখনো নিষ্পত্তি হয়নি।
সবচেয়ে বেশি সেবা নিচ্ছেন ঢাকা বিভাগের রোগীরা
এই চক্ষু হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। ২০২২ সালে এই হাসপাতালের আউটডোর, জরুরি বিভাগ ও ভর্তি হয়ে সেবা নিয়েছেন ৫ লাখ ৯০ হাজার ৬৮৭ জন। পরের বছরে সেবা নিয়েছেন ৬ লাখ ৬৯ হাজার ৪৭২ জন। গত বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালে চক্ষুসেবা নিয়েছেন ৭ লাখ ১ হাজার ২৫০ জন রোগী। গ্রীষ্মের শুরুর দিকে রোগীর সংখ্যা কম থাকলেও শীতের আগে রোগীর সংখ্যা বাড়ে। সবচেয়ে বেশি চক্ষুসেবা নিয়েছেন ঢাকা বিভাগের রোগী, ৬৬ শতাংশ। সবচেয়ে কম সেবা নিয়েছেন সিলেট বিভাগ থেকে, ১ শতাংশ।
পাওয়া যায় না ভালো মানের লেন্স
রোগীরা প্রয়োজনীয় উন্নত চিকিৎসার জন্য এখানে এলেও পর্যাপ্ত ওষুধ পান না। বাইরে থেকে কিনতে হয়। কিছু টেস্টও বাইরে থেকে করতে হয়। অভিযোগ রয়েছে, ভালো মানের লেন্স পাওয়া যায় না। রোগীদের খাবারের মানও ভালো নয় বলে অভিযোগ করেছেন অনেকেই। যন্ত্রপাতি নষ্ট হলে অতিদ্রুত মেরামত করা হয় না। এ জন্য রোগীদের ভোগান্তি পোহাতে হয়। বিশেষ করে জুলাই আন্দোলনের পর চিকিৎসা নিতে আসা আহতরা বেশ সংকটেই পড়েছেন। সম্প্রতি তাদের সঙ্গে ডাক্তার, নার্সদের সংঘর্ষ হলে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যায় হাসপাতালটি। এতে চরমভাবে ভোগান্তিতে পড়েন রোগীরা। পরে অবশ্য ইমার্জেন্সি বিভাগ ও বহির্বিভাগে চিকিৎসা শুরু হয়েছে।