‘ও ভাই আমাদের কাজ হলে বাসি
আমরা মুটে কল-খালাসি!
ডুবলে তরি মোরাই তুলতে আসি রে!’ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা ‘শ্রমিকের গান’ কবিতার এই চরণটি যেন সাম্প্রতিক লেখা। নিকট অতীতে করোনা মহামারির সময় যেমন কৃষক-দিনমজুররা খেতে ফসল ফলিয়ে দেশের মানুষের পাতে ভাতের নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন, তেমনি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মতো বৈশ্বিক সংকটেও প্রবাসী শ্রমিকরা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের হাল ধরেছিলেন।
শুধু অর্থনৈতিক মুক্তি নয়, কবিতার প্রথম দুটি পঙ্ক্তি
‘ওরে ধ্বংস-পথের যাত্রীদল!
ধর হাতুড়ি, তোল কাঁধে শাবল।’-এর মতো জাতীয় যেকোনো আন্দোলন-সংগ্রামেও থাকে তাদের ব্যাপক উপস্থিতি ও আত্মত্যাগ। গত বছরের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় একজন রিকশাচালক রিকশার ওপর দাঁড়িয়ে আন্দোলনকারীদের মিছিল সামনে রেখে দেওয়া স্যালুটের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
আজ মহান মে দিবসকে সামনে রেখে বিষয়টি মনে করিয়ে দিয়ে জানতে চাইলে গতকাল বুধবার সিপিবির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম খবরের কাগজকে বলেন, ‘বৈষম্য কমার কোনো লক্ষণও দেখছি না। আমাদের দাবি শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি মাসিক ৩০ হাজার টাকা। কিন্তু তাদের মজুরি এর ধারেকাছে নেওয়ার চেষ্টাও নেই।’
গার্মেন্ট শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোশরেফা মিশু বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে সাভার এলাকায় নিহতদের বেশির ভাগই শ্রমজীবী মানুষ। কিন্তু নতুন সরকার আসার ৯ মাসেও তাদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। তাদের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণে এতদিনে কোনো বোর্ড পর্যন্ত গঠন হয়নি।’
বৈষম্য নিরসনে করণীয় প্রশ্নে আরেক শ্রমিকনেতা বাংলাদেশ গার্মেন্ট ও সোয়েটার্স শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক কাজী মো. রুহুল আমিন বলেন, ‘জাতীয় ন্যূনতম মজুরি কমিশন গঠন, ৩০ হাজার টাকা জাতীয় ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা, সর্বজনীন রেশন চালু, আইএলও কনভেনশন অনুসারে অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন নিশ্চিত করাসহ শ্রম আইন সংশোধন ও কার্যকর করা, গ্রেপ্তারকৃত শ্রমিক ও নেতাদের মুক্তি, ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার, ছাঁটাই-নির্যাতন-দমন-পীড়ন বন্ধ, রানা প্লাজা, তাজরীন ফ্যাশনসহ সব শ্রমিক হত্যার বিচার, বন্ধকৃত পাট, সুতা, বস্ত্র ও চিনিকল রাষ্ট্রীয় মালিকানায় চালু, শ্রম উপদেষ্টার ঘোষণা অনুসারে আগামী ৭ মের মধ্যে স্টাইল ক্রাফট, টিএনজেড গ্রুপ, মাহমুদ গ্রুপসহ বিভিন্ন কারখানার বকেয়া বেতন-ভাতা পরিশোধ করতে হবে।’
বাংলা ভাষায় শ্রমিকদের নিয়ে গাওয়া গানগুলোর মধ্যে সবার আগে কানে বেজে ওঠে গণসংগীতশিল্পী ফকির আলমগীরের কণ্ঠে ‘জন হেনরি’ গানটি। গানটির কলি
‘জন হেনরির কচিফুল মেয়েটি
পাথরের বুকে যেন ঝর্ণা
মা’র কোল থেকে সে পথ চেয়ে
আছে তার
বাবা তার আসবে না -- আর না।’ যেন রাজধানীর অদূরে সাভারের রানা প্লাজা ধসে হাজারের বেশি শ্রমিক নিহতের কথাই মনে করিয়ে দেয়। ওই ঘটনায় নিহত এবং হাজারের বেশি আহতদের পরিবারের অব্যাহত দুর্বিষহ জীবনের কথা তুলে ধরেন শ্রমিকনেতা কাজী মো. রুহুল আমিন।
তিনি বলেন, ‘এক যুগেও সাভারের রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় শ্রমিক হত্যার বিচার পর্যন্ত পায়নি তাদের পরিবার। এই বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণেও মালিকরা শ্রমিকদের জীবনকে ন্যূনতম দাম দেয় না। কারণ মালিকদের সামনে এত এত শ্রমিক হত্যা করেও পার পেয়ে যাওয়ার উদাহরণ আছে।
প্রসঙ্গত, আজ ১ মে, মহান মে দিবস, যা শ্রমিক দিবস হিসেবেও পরিচিত। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবারের শ্রমিক দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে, ‘শ্রমিক-মালিক এক হয়ে, গড়ব এ দেশ নতুন করে।’
উল্লেখ্য, ১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে শ্রমের মর্যাদা, শ্রমের মূল্য এবং দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলনে শ্রমিকেরা যে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন তাদের সেই আত্মত্যাগের সম্মানে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে দিবসটি শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের দিন হিসেবে পালন করা হয়। দিবসটির গুরুত্ব তুলে ধরে সব গণমাধ্যম বিভিন্ন লেখা প্রকাশ ও অনুষ্ঠান প্রচার করে।
দিনটি উপলক্ষে দেওয়া বাণীতে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘এ দিবসে আদায় হয়েছে শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার। সে প্রেক্ষাপটে এটি শুধু একটি সাধারণ দিবস নয়, শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলন-সংগ্রামের অনুপ্রেরণার উৎস।’
মহান মে দিবসে শ্রমিকদের শুভেচ্ছা জানিয়ে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেন, ‘মে দিবস হচ্ছে ন্যায্য অধিকার আদায় ও নাগরিক বঞ্চনার বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রামের আলোকবর্তিকা। মে দিবস তাদের প্রতিরোধ করতে শেখায়, যারা শ্রমজীবী মানুষের অধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলে।’
মে দিবসের বিবৃতিতে সিপিবি সভাপতি মোহাম্মদ শাহ আলম ও সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স জাতীয় ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা ও সর্বত্র ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত, সর্বজনীন রেশন ব্যবস্থা ও ন্যায্যমূল্যের দোকান চালু, হত্যা-নির্যাতন-ছাঁটাই বন্ধ, ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন।
নারী শ্রমিকদের মধ্যে বৈষম্য দূর করে ইসলামি শ্রমনীতি চালুর দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নারী বিভাগের সেক্রেটারি অধ্যক্ষ নূরুন্নিসা সিদ্দীকা। বিবৃতিতে মালিক-শ্রমিকের দ্বন্দ্বের অবসান ঘটাতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
বাংলাদেশ গণমুক্তি পার্টির আহ্বায়ক এম এ আলীম ছাড়াও ফ্যাসিবাদবিরোধী বাম মোর্চার নেতারাও মে দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন।