আগামী বছর বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভালো জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। আর ওই ভোটের জন্য দেশের জনগণ প্রস্তুত বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
বুধবার (১১ জুন) লন্ডনের প্রভাবশালী নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান চ্যাথাম হাউস আয়োজিত সংলাপে এ কথা বলেন তিনি।
ড. ইউনূস বলেন, ‘১৭ বছর পর আমরা একটি সত্যিকারের নির্বাচন আয়োজনের দ্বারপ্রান্তে। এটি হবে আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য, অংশগ্রহণমূলক ও নিরপেক্ষ নির্বাচন।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম কেবল একটি নতুন সরকার গঠনের জন্য রক্ত দেয়নি, তারা চেয়েছে একটি নতুন বাংলাদেশ। এই নতুন বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্যে একটি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। আমরা প্রতিটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের জন্য পৃথক কমিশন গঠন করেছি। তাদের সুপারিশের ভিত্তিতে সামনে এগোচ্ছি। এখন আমাদের মূল দায়িত্ব হলো সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঐকমত্য গড়ে তোলা।’
সংলাপে আরেক প্রশ্নের উত্তরে ড. ইউনূস বলেন, ‘আমরা এখন অপেক্ষায় আছি ‘জুলাই সনদের’। এই সনদটি পুরো জাতির সামনে জুলাই মাসের সনদ হিসেবে তুলে ধরা হবে।’
আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে ড. ইউনূস বলেন, ‘আওয়ামী লীগের কার্যক্রম সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থানে হত্যাকাণ্ডের জন্য বিচারের পর দলটি নিষিদ্ধ হওয়া, না হওয়ার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগের কোনো সদস্য জাতির কাছে ক্ষমা চাননি, যারা গণহত্যা ঘটিয়েছেন এবং এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বিচার শেষ হওয়ার আগে আমরা জনগণের নিরাপত্তার জন্য আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রম সাময়িক সময়ের জন্য স্থগিত করেছি।’
আগামীতে নির্বাচিত সরকারে থাকা নিয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে ড. ইউনূস দুই হাত নেড়ে বলেন নো ওয়ে, নো ওয়ে।
তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় আমাদের উপদেষ্টা পরিষদের কোনো সদস্যই এমনটা করবেন না। আমাদের দায়িত্ব হলো- বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তর ভালোভাবে সম্পন্ন করা এবং জনগণকে খুশি করা। নির্বাচন শেষে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। আমরা নির্বাচনটা যথাযথভাবে নিশ্চিত করতে চাই। এটা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।’
তিনি বলেন, ‘যদি নির্বাচনে ভুল হয়, তাহলে এই বিষয়টার আর সমাধান হবে না।’
রোহিঙ্গা ইস্যুতে প্রশ্ন করা হলে ড. ইউনূস বলেন, ‘সাত বছর আগে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে এসেছে। তাদের অনেকে পাঁচ মাস থেকে শুরু করে ৫ বছর বা ৭ বছর বয়সীও ছিল। তারা সবাই আজ যুবক বা কিশোর। এখন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার বিভিন্ন কর্মসূচিতে অর্থায়ন বন্ধ করে দেওয়ার পর প্রশ্ন উঠেছে তাদের ভরণপোষণ দেবে কারা। তাদের তো থাকার নির্দিষ্ট সময়ও নেই। বিষয়টি নিয়ে তার সরকার গুরুত্বসহকারে কাজ করছে।’
চ্যাথাম হাউস সংলাপে প্রধান উপদেষ্টা বাংলাদেশে পাসপোর্ট প্রাপ্তির সুবিধাসহ তার সরকারের নেওয়া বিভিন্ন কার্যক্রমের কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘আগে পাসপোর্টসহ বিভিন্ন সরকারি সেবা পেতে ‘মাধ্যম’ প্রয়োজন হতো। যার মাধ্যমে দুর্নীতির সুযোগ তৈরি হতো। এখন সরকারি বিভিন্ন সেবা অনলাইনের মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে, যাতে সবাই সহজেই সেবা নিতে পারেন।’
বক্তব্যের শুরুতে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা একটি ভুল সভ্যতার অংশ হয়ে গেছি, আমরা নিজেরাই একটি আত্মবিধ্বংসী সভ্যতা গড়ে তুলেছি। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে আমাদের দরকার নতুন করে সভ্যতা গড়ে তোলা। এর জন্য দরকার কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনা, বেকারত্ব দূর করা এবং ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী গড়া। এটার জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। এটা কোনো শিক্ষা বা জ্ঞানের বিষয় নয়।’
এ সময় উপস্থিত ছিলেন যুক্তরাজ্য ও বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক, গবেষক এবং গণমাধ্যমকর্মীরা।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে যুক্তরাজ্যের সহায়তা চাইলেন প্রধান উপদেষ্টা
রোহিঙ্গাসংকট, পাচার হওয়া বাংলাদেশি সম্পদ উদ্ধার, সাম্প্রতিক ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া নিয়ে যুক্তরাজ্যের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জোনাথন পাওয়েলের সঙ্গে আলোচনা করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
বুধবার লন্ডনের একটি হোটেলে আয়োজিত বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা, আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং বাংলাদেশের চলমান গণতান্ত্রিক উত্তরণ নিয়ে তাদের মধ্যে আলোচনা হয়। ড. ইউনূস রোহিঙ্গাসংকট মোকাবিলায় আসন্ন জাতিসংঘ সম্মেলনে যুক্তরাজ্যের সক্রিয় সমর্থন কামনা করেন এবং দশ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীর মায়ানমারে নিরাপদ প্রত্যাবাসনে ভূমিকা বাড়ানোর আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের পূর্ববর্তী সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার ১৬ বছরের শাসনামলে প্রায় ২৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অবৈধভাবে বিদেশে পাচার হয়েছে, যা রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। ড. ইউনূস পাচার করা এই অর্থ ফিরিয়ে আনতে যুক্তরাজ্যের সহযোগিতার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।’
বৈঠকে জোনাথন পাওয়েল বাংলাদেশের এই সংকটকালে অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের জন্য অব্যাহত সমর্থনের প্রস্তাব দেন।
বৈঠকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক খাত, বিশেষ করে ব্যাংকিং খাতে ইতিবাচক অগ্রগতি এবং বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরে আসার বিষয়েও আলোচনা হয়।