বজ্রপাতে প্রতিবছর গড়ে ২৫০ থেকে ৩০০ জন প্রাণ হারায়। তাদের বড় অংশই প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। এবার অবশ্য কিছুটা আশার কথা শোনা যাচ্ছে। তাদের সুরক্ষার কথা চিন্তা করে বজ্রপাত প্রতিরোধী ‘আর্লি স্ট্রিমার ইমিশন এয়ার টার্মিনাল (ইএসইএটি)’ নামক যন্ত্র স্থাপন করেছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর। ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি) প্রযুক্তি ব্যবহার করে বজ্রপাত নিরোধক এই যন্ত্রের মাধ্যমে বজ্রপাতকে নিমিষে মাটিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এরই মধ্যে এই যন্ত্র ব্যবহার করে সুফল পেয়েছে রোহিঙ্গা ক্যাম্প। এ ছাড়া হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার দুটি ইউনিয়নে সুফল মিলেছে বলেও জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
স্থানীয় সরকার বিভাগ কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রায় ৭৫০টি ইএসইএটি যন্ত্র স্থাপন করেছে। এসব যন্ত্র স্থাপনের পর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বজ্রপাতে এখন পর্যন্ত কোনো মানুষের মৃত্যু হয়নি। ইএসইএটি নামক যন্ত্রটি তার চারদিকে ৪০০ মিটারের মধ্যে বজ্রপাত সৃষ্টি হলে নিজের দিকে টেনে মাটিতে পাঠিয়ে দেয়। এতে সেই স্থানের প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষা পায়। ভারত, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া ও নেপালেও ইতোমধ্যে এ ধরনের আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর যন্ত্র ব্যবহার করে ব্যাপক সফলতা পাওয়া গেছে। এসব দেশে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে স্কুল, হাসপাতাল, কৃষিজমি ও উপকূলীয় এলাকাগুলোতে স্মার্ট বজ্রপাত নিরোধক রড, গ্রাউন্ডিং ও লাইভ মনিটরিং প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে এবং মৃত্যুহার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে।
চুনারুঘাট উপজেলার গাজীপুর ইউনিয়ন পরিষদে সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, এলাকাটিতে একটি ইএসইএটি যন্ত্র স্থাপন করা হয়েছে। পাশেই ধান কাটছিলেন তিন কৃষক। আঞ্চলিক ভাষায় তারা জানান, এই এলাকায় বজ্রপাতের পরিমাণ অনেক বেশি। চোখের সামনে তারা অনেক মৃত্যু দেখেছেন। জমির পাশে এই যন্ত্র বসানোর পর গত দুই বছরে এ এলাকায় কেউ বজ্রপাতে মারা যায়নি।
একই জায়গায় নালায় জাল দিয়ে মাছ ধরছিলেন মো. সুবেল মিয়া।
তিনি বলেন, ‘এ যন্ত্র স্থাপনের পর আমরা অভয়ে এখানে কাজ করতে পারছি। আগে ঝড় এলেই ভয় করত। দৌড়ে বাড়িতে আশ্রয় নিতাম।’ একই ইউনিয়নের গোবরখলা গ্রামের শিক্ষার্থী জুবায়ের তালুকদার বলেন, ‘যন্ত্রটি বসানোর আগের বছরও খোয়াই নদে বজ্রপাতে এক জেলে এবং পাশের গ্রামে দুটি গরু ও এক নারী মারা যায়। বজ্রপাতে এলাকার ২০-২৫টি গাছও নষ্ট হয়। তবে যন্ত্রটি স্থাপনের পর এ অঞ্চলে বজ্রপাতে কেউ মারা যাননি।’
চুনারুঘাট উপজেলার শানখলা ইউনিয়নে আরেকটি যন্ত্র স্থাপন করা হয়েছে। এতে স্থানীয় লোকজন সুরক্ষা পাচ্ছে জানিয়ে ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের এই বজ্রপাতপ্রবণ অঞ্চলে এ ধরনের যন্ত্র স্থাপনের কারণে আমরা সুরক্ষিত আছি।’
চুনারুঘাট উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন (পিআইও) কর্মকর্তা নুর মামুন বলেন, ‘বজ্রপাত থেকে মানুষকে সুরক্ষা দিতে দুই বছর আগে পরীক্ষামূলকভাবে দুটি স্থানে ইএসইএটি ডিভাইস স্থাপন করা হয়েছে। যন্ত্রটি স্থাপনে মাত্র একটি খুঁটি প্রয়োজন হয়, ফলে কৃষকের জমি নষ্ট হয় না। এমন উদ্যোগ আরও সম্প্রসারিত করা দরকার।’
প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান আইকনিক ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড ইএসইএটি যন্ত্রটি সরবরাহ করছে। প্রতিষ্ঠানটির সিইও মো. মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘এ ডিভাইসটির চারদিকে ৪০০ মিটার এলাকায় বজ্রপাত হলে তা নিজের দিকে টেনে মাটিতে নিয়ে যায়। সঠিকভাবে যত্ন নিলে এটি দীর্ঘদিন ব্যবহার করা যায়। আমরা কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ২০১৯ সালে প্রায় ৭৫০টি স্থানে এ যন্ত্র স্থাপন করেছি। এখন পর্যন্ত কোনো সমস্যা তৈরি হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘ফ্রান্সের তৈরি ইন্ডিলেক অ্যাসেট সিস্টেম, যা এখন বাংলাদেশের বাস্তবতায় প্রয়োগ করা হচ্ছে। এটি শুধু একটি বজ্রনিরোধক রড নয় বরং একটি পূর্ণাঙ্গ স্মার্ট ডিভাইস। এর ভেতরে সংযুক্ত রয়েছে ইন্টারনেটভিত্তিক (আইওটি) তথ্য বিশ্লেষণ ও সরাসরি পর্যবেক্ষণের সুবিধা। যন্ত্রটি সোলার থেকে চার্জ নেওয়ায় আলাদা বিদ্যুতের প্রয়োজন পড়ে না। ই-সিমের কারণে সরাসরি ডেটাগুলো পাওয়া যায়। যেকোনো স্থানে বসে মোবাইল ফোনে বা কম্পিউটারে এর কার্যক্রম মনিটরিং করা যায়।’
দুর্যোগ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশের ১৫টি জেলায় সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয়। এর মধ্যে সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জ অন্যতম। অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আশরাফ দেওয়ান গবেষণা করছেন বাংলাদেশের বজ্রপাত নিয়ে। এক গবেষণা প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, ‘হাওর অঞ্চলের নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সিলেট জেলায় প্রাক-বর্ষা মৌসুমে (মার্চ-এপ্রিল-মে মাসে) বেশি বজ্রপাত হয়। বর্ষা মৌসুমে (জুন-জুলাই-আগস্ট) বজ্রপাত বেশি হয় সুনামগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল, গোপালগঞ্জ, বরিশাল এবং উত্তরবঙ্গের রংপুর, পঞ্চগড় ও কুড়িগ্রামে। আর পার্বত্য চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও কক্সবাজারে বর্ষা মৌসুমের পর (অক্টোবর-নভেম্বর) বেশি বজ্রপাত হয়। এমনকি সাতক্ষীরা, খুলনা ও পটুয়াখালীতে শীতকালেও বজ্রপাত হয়।
আইকনিক ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের বিজনেস হেড শেখ হাসিনা আক্তার বলেন, ‘আমাদের আর্লি স্ট্রিমার ইমিশন এয়ার টার্মিনাল বজ্রপাত হলে ড্যাস বোর্ডে ই-মেইলে সব ধরনের তথ্য সংরক্ষিত থাকে। আর তথ্য জমা থাকে পাঁচ বছর পর্যন্ত। এই প্রযুক্তি ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ও এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক রোহিঙ্গা ক্যাম্পে স্থাপন করেছে। সেখানে তারা ভালো ফলাফল পাচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে প্রয়োজন কৃষক, শ্রমিকদের জীবনের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। এ যন্ত্রের মাধ্যমে তা করা যায়।’