শিশু আব্দুল্লাহ্র বয়স ছয় মাস দশদিন। ক্লান্ত চাহনি আর দুর্বল শরীর নিয়ে মা সুরাইয়া বেগমের কোলে জড়সড়ো হয়ে বসে আছে। সামনে রাখা লাল রঙের বাটিতে খাবার স্যালাইন। সুরাইয়া বেগমের দিশেহারা অবস্থা। টলটলে চোখ, যেকোনো সময় বাঁধ ভেঙে ছুটবে অশ্রুধারা। সারাক্ষণ উশখুশ করে যেন খুঁজছে কিছু, বা কাউকে।
দৃশ্যটি বৃহস্পতিবার (৪ জুলাই) মহাখালী আন্তর্জাতিক উদরাময় রোগ গবেষণা কেন্দ্র বা আইসিডিডিআরবি কলেরা হাসপাতালের।
সুরাইয়া বেগম জানান, গত পরশু রাত থেকে বমি আর পাতলা পায়খানা শুরু হয় আব্দুল্লাহ্র। সঙ্গে রয়েছে জ্বর। এত ছোট বাচ্চার ঘন ঘন পাতলা পায়খানা আর বমি হওয়ায় শরীর দুর্বল হয়ে পড়েছে। দিশা না পেয়ে সকালেই ছেলেকে নিয়ে ছুটে এসেছেন এখানে। ডাক্তার দেখার পর বারবার স্যালাইন খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু শুধু স্যালাইন খাওয়ালেই ঠিক হয়ে যাবে, ব্যাপারটিতে ঠিক ভরসা পাচ্ছেন না সুরাইয়া।
রিসেপশন এরিয়ার বিপরীত দিকের একটি কক্ষে সারি দেওয়া চেয়ার-টেবিল রাখা। সেখানেই মায়েদের কোলে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছে ডায়রিয়া আক্রান্ত শিশুরা। প্রতিটি শিশু রোগীর সামনে একটি বাটিতে রাখা আছে খাবার স্যালাইন। মায়েরা সেখান থেকে চামচে তুলে কোলের শিশুদের স্যালাইন খাওয়াচ্ছেন।
হাসপাতালের রিসেপশন পেরিয়ে ওয়ার্ডে গেলে দেখা মেলে সত্তরোর্ধ্ব ভর্তি রোগী আক্তার নাজনীনের। নারায়ণগঞ্জের দেউলী চৌড়াপাড়ার বাসিন্দা। বয়সের ভারে ন্যুব্জ। গত তিন দিন ধরে পাতলা পায়খানা আর বমি হচ্ছে। এই বয়সে শরীরে এত ধকল কাবু করে ফেলেছে বৃদ্ধাকে। গত দুদিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি তিনি। বললেন, ‘আমি তো ভাবছি মইরাই যামু। উইঠ্যা বহার শক্তি আছিল না। এইহানে আহার পর সুই দিয়া স্যালাইন দিল হাতের মইধ্যে। আস্তে আস্তে এহন অবস্থা ঠিক অইছে। সকালে স্যালাইন খুইল্যা দিছে।’ সঙ্গে থাকা পুত্রবধূ পপি আক্তার কিছুক্ষণ পরপর বাটি থেকে চামচ ভর্তি স্যালাইন তুলে দিচ্ছেন শাশুড়ির মুখে।
হাসপাতাল ঘুরে প্রতিটি কোণেই দেখা যায় ডায়রিয়া আর কলেরা আক্রান্ত রোগীর হাহাকার। একই সঙ্গে দেখা যায় সাদা অ্যাপ্রোন পরা ডাক্তার আর নার্সদের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে অক্লান্ত ছুটে চলা। এত কর্মব্যস্ততা আর ছুটোছুটির ভেতরেও সবকিছু যেন সিস্টেমেটিক। ডায়রিয়া রোগীতে ঠাসা হাসপাতালে কোথাও নেই একটু কটু গন্ধ, না আছে কোথাও এতটুকু ময়লার চিহ্ন। রোগীদের ভাষ্যানুযায়ী আইসিডিডিআরবির ব্যবস্থাপনা, চিকিৎসা ও সংশ্লিষ্ট সব কর্মীর ব্যবহার ও সেবা তাদের মন ছুঁয়ে গেছে।
আইসিডিডিআরবির নির্বাহী পরিচালক ড. তাহমিদ আহমেদ বলেন, ডায়রিয়া ও কলেরার চিকিৎসায় আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) কলেরা হাসপাতালে রোগী ও স্বজনদের কাছে এক আস্থার জায়গা। এখানে সেবা নিতে আসা সিংহভাগ মানুষই অতি দরিদ্র পরিবার থেকে আসেন। আমরা রোগীদের শুধুমাত্র রোগী নয়, বরং সহমর্মিতার দৃষ্টিতে দেখি। এখান থেকে বছরে আড়াই লাখের মতো রোগী বিনা খরচে চিকিৎসা নেয়। গত ছয় দশকের বেশি সময় ধরে বিজ্ঞানভিত্তিক উদ্ভাবন, চিকিৎসা, রোগী ব্যবস্থাপনা ও রোগ প্রতিরোধে অগণিত সাফল্য অর্জন করে চলেছে আইসিডিডিআরবি। ওরস্যালাইন আবিষ্কার, মুখে খাওয়া কলেরার টিকা আবিষ্কার, ডায়রিয়া চিকিৎসায় জিংকের ব্যবহার, শিশুদের তীব্র অপুষ্টির চিকিৎসাপদ্ধতিসহ দেশের স্বাস্থ্য খাতের অর্জনে এই প্রতিষ্ঠান ভূমিকা রেখে চলেছে।
হাসপাতাল শাখার প্রধান ডা. বাহারুল আলম খবরের কাগজকে বলেন, ‘যেসব রোগী ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিতে আসেন, তাদের ৬০ শতাংশ রোগীই পাঁচ বছরের কমবয়সী শিশু। যারা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হন, তাদের শরীরে প্রচুর পরিমাণ পানিশূন্যতা দেখা দেয়। এক্ষেত্রে যত দ্রুত সম্ভব রোগীর ফ্লুইড রিপ্লেসমেন্টের প্রয়োজন হয়। সাধারণ খাবার স্যালাইনই রোগীকে সুস্থ করে তোলার জন্য যথেষ্ট।’
তিনি জানান, হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে তিন থেকে চারশ জন রোগীর সেবা দেওয়া হয়। তবে মে থেকে জুন এবং নভেম্বর থেকে জানুয়ারি, বছরের এই দুই সময় ডায়রিয়ার প্রকোপ বেশি থেকে। প্রতি বছরই এই সময়টাতে দিনে প্রায় ১২শ থেকে ১৩শ রোগীর সেবা দেওয়ার রেকর্ড রয়েছে। এ ছাড়া গত দুই মাসে হাসপাতালের রেকর্ড অনুযায়ী মে মাসে সেবা পেয়েছেন মোট ১৮ হাজার ১৪১ এবং জুন মাসে মোট ১৮ হাজার ৬৩৪ জন রোগী। সে হিসাবে দুই মাসে দিনে ৬শ জনেরও বেশি ডায়রিয়া রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন এই হাসপাতাল থেকে।
হাসপাতালের নার্সিং অফিসার ক্যাথরিন কস্তা বলেন, ‘আগের দিন রাতের হিসাব অনুযায়ী হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ২১২। এদের মধ্যে অনেকেই যাদের অবস্থা আজ শঙ্কামুক্ত, তাদের ডিসচার্জ করে দেওয়া হবে। তিনি আরও জানান, এখানে চিকিৎসা নিতে আসা বেশির ভাগ রোগীকেই আমরা শুধু খাবার স্যালাইন খেতে বলি। বেশির ভাগ রোগীই কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে যেতে পারেন। যাদের অবস্থা একটু বেশি খারাপ, তাদেরকেই শুধু ভর্তি রাখা হয়। এসব রোগীও সর্বোচ্চ তিন দিনের ভেতর সুস্থ হয়ে যায়। তিন দিনের বেশি ভর্তি রোগীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অনেক কম।’
ডা. বাহারুল আলম জানান, এখানে শুধু ডায়রিয়া রোগের চিকিৎসাই হয় না, গবেষণাও হয়। আমাদের সেবা এখন শুধুমাত্র দেশের গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ নেই, ছড়িয়ে গেছে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশসমূহে, এই প্রতিষ্ঠানের গবেষণালব্ধ ফলাফল কাজে লাগিয়ে আর্তমানবতার সেবার জন্য গৃহীত নানা কার্যক্রম ক্রমাগত সমৃদ্ধ হয়ে চলেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুরোধে হাইতি, ইয়েমেন, ইরাক, সিরিয়াসহ পৃথিবীর যে দেশেই কলেরার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে, সেখানেই আইসিডিডিআরবির চিকিৎসক ও গবেষকরা ছুটে গিয়েছেন এবং স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্মীদের কার্যকরভাবে কলেরা চিকিৎসা এবং নিয়ন্ত্রণে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।