বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে গিয়ে আহত যোদ্ধাদের ইউনিক আইডি কার্ড থাকবে। তারা সব সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে সারা জীবন বিনামূল্যে সেবা পাবেন। যেসব বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে সরকারি চুক্তি থাকবে সেখানেও বিনামূল্যে সেবা পাবেন তারা। আগামী ১৭ নভেম্বরের পর সাপোর্ট সেন্টার থাকবে। সেখান থেকে সব ধরনের সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করা হবে। আহতদের চিকিৎসায় সব সরকারি হাসপাতালে বেড ডেডিকেটেড থাকবে।
বৃহস্পতিবার (১৪ নভেম্বর) সচিবালয়ে ছয় উপদেষ্টার সঙ্গে আহতদের বৈঠকের পর প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ডা. সায়েদুর রহমান সাংবাদিকদের এই তথ্য জানান।
এদিকে বৈঠকের আগে সচিবালয়ে যাওয়া আহতদের দুই পক্ষের মধ্যে বাগবিতণ্ডা হয়। ফলে প্রায় তিন ঘণ্টা পর বৈঠক শুরু হয়। বিকেল সাড়ে চারটার পর উভয় পক্ষ বৈঠকে বসেন।
গতকাল বুধবার গভীর রাতে চার উপদেষ্টা জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর) গিয়ে আহতদের সঙ্গে ওই বৈঠকের ঘোষণা দিয়েছিলেন।
৬ উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক
বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে আহত ছাত্র-জনতার সঙ্গে ছয় উপদেষ্টার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগমের সভাপতিত্বে বৈঠকে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার, ডাক টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম, যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, সমাজ কল্যাণ উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ, উপদেষ্টা মাহফুজ আলম এবং স্বাস্থ্যবিষয়ক বিশেষ সহকারী মো. সায়েদুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। বিকেলে সাড়ে ৪টায় শুরু হয়ে প্রায় আড়াই ঘণ্টা চলে ওই বৈঠক।
ওই বৈঠকে ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ, জুলাই শহিদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম, আন্দোলনে শহিদ মুগ্ধ’র যমজ ভাই ও জুলাই শহিদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ অংশ নেন। বৈঠকে শতাধিক আহত ছাত্র-জনতা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকের আগে বাগবিতণ্ডা
অভ্যুত্থানে আহতদের দুই পক্ষের মধ্যে বাগবিতণ্ডা নির্ধারিত সময়ের প্রায় তিন ঘণ্টা পর বৈঠকটি শুরু হয়।
জানা যায়, বৃহস্পতিবার দুপুর ২টায় সচিবালয়ে অভ্যুত্থানে আহতদের সঙ্গে উপদেষ্টাদের বৈঠকে বসার কথা ছিল। সে অনুযায়ী আহতরা বৈঠকে আসেন। কিন্তু বৈঠক শুরুর আগে হাসপাতালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের সঙ্গে ‘রক্তিম জুলাই’ নামে আহতদের একটি সংগঠনের নেতাদের বাগবিতণ্ডা শুরু হয়। এ সময় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলম ও হাসনাত আব্দুল্লাহ তাদেরকে থামানোর চেষ্টা করেন।
কিন্তু ছাত্র আন্দোলনকারীরা সম্মেলন কক্ষে তাদের ক্ষোভ জানাতে থাকেন। তারা বলেন, যারা আন্দোলনে ছিলেন না তারা বৈঠকে থাকতে পারবেন না।
এ সময় সমন্বয়করা বলেন, অভ্যুত্থানের ঘটনায় যারা হতাহত হয়েছেন তারা কেউ আলাদা নন। সবার পরিচয় যোদ্ধা হিসেবে। তাই নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি না করে সরকারের কাছে দাবিগুলো তুলে ধরুন। এভাবে দুই পক্ষের বাগবিতণ্ডা ও তর্কবিতর্কের আড়াই ঘণ্টা পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলে উপদেষ্টাদের সঙ্গে বৈঠকটি শুরু হয়।
আহতদের ৭ দাবি
বৈঠকে আহতরা সাত দফা দাবি তুলে ধরেন। দাবিগুলো হলো- গণঅভ্যুত্থানে আহত যোদ্ধাদের অতিদ্রুত মন্ত্রী বা উপদেষ্টারা আহত হলে যে মানের চিকিৎসা দেওয়া হতো সে মানের চিকিৎসা দিতে হবে। গণঅভ্যুত্থানে যারা আহত হয়ে নিজ খরচে চিকিৎসা নিয়েছেন, তাদের চিকিৎসা খরচ পরিশোধ করতে হবে। গণঅভ্যুত্থানে শহিদ পরিবার ও আহত যোদ্ধাদের সম্মাননা কার্ডের মাধ্যমে একটি প্রজন্ম পর্যন্ত মাসিক ভাতা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। গণঅভ্যুত্থানে শহিদ ও আহত যোদ্ধাদের স্মৃতি ফাউন্ডেশন নামে জাদুঘর নির্মাণ করে প্রতি বছর ১ জুলাই হতে ৫ আগস্ট পর্যন্ত শহিদদের স্মরণে গণ-স্বাক্ষর কর্মসূচির আয়োজন করতে হবে। গণঅভ্যুত্থানে শহিদ হয়েছেন ও আহত হয়ে যারা অঙ্গ হারিয়েছেন, একটি নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করে তাদের মেডিকেল ফাইল তদন্ত করে কোনো ডাক্তার বা মেডিকেলের অবহেলার কারণ খুঁজে পেলে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। দ্রুত সময়ের মধ্যে গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগীদের বিচারের মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত করে সেই সংগঠনকে নিষিদ্ধ করতে হবে। আগামীতে রাষ্ট্র সংস্কারে ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানে শহিদ পরিবারের সদস্য ও আহত যোদ্ধাদের মতামত গ্রহণ করতে হবে
গভীর রাতে নিটোরে ৪ উপদেষ্টা
বুধবার গভীর রাতে চার উপদেষ্টা জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর) যাওয়ার পর সড়ক ছেড়ে হাসপাতালে ফিরেন জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে আহতরা। গণঅভ্যুত্থানে আহতরা সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসনের দাবিতে নিটোর সামনের সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করছিলেন। বিক্ষোভকারীরা স্বাস্থ্য উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিতে সড়কে অবস্থান নিয়ে স্লোগান দিচ্ছিলেন।
জানা যায়, রাত আড়াইটার দিকে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে দেখা করতে যান আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার, স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, উপদেষ্টা মাহফুজ আলম এবং প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদায় সহকারী (স্বাস্থ্য) হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত মো. সায়েদুর রহমান। দাবি পূরণের আশ্বাস পাওয়ার পর আহত ব্যক্তিরা রাত সোয়া ৩টার দিকে হাসপাতালে ফিরে যান।
স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নুরজাহান বেগম বুধবার পঙ্গু হাসপাতাল পরিদর্শন করতে যান। তার সঙ্গে ছিলেন ব্রিটিশ হাইকমিশনার সারাহ কুক। স্বাস্থ্য উপদেষ্টা সবার সঙ্গে দেখা করেননি এ অভিযোগে হাসপাতাল থেকে বেরোনোর সময় তার পথ আটকে বিক্ষোভ করেন আহত ব্যক্তিরা। আগারগাঁও এলাকায় পঙ্গু হাসপাতাল ও পাশের জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অর্ধশতাধিক ব্যক্তি ওই সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন।
আহত ব্যক্তিদের উদ্দেশে উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেন, আপনাদের কথা শোনার মতো উপযুক্ত সময় এখন নয়। সেখানে আলোচনার ভিত্তিতে একটি রূপরেখা প্রণয়ন করা হবে। সেই রূপরেখা ডিসেম্বরের মধ্যে বাস্তবায়ন করা হবে। আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, ‘আমাদের ব্যর্থতা, আমাদের ভুল আছে। কিন্তু চেষ্টার দিক দিয়ে আমাদের ঘাটতি ছিল না। যেকোনো কারণেই হোক আমরা পারিনি। আমাদের ওপর বিশ্বাস রাখুন।’
আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, ‘একটা ভঙ্গুর অবস্থার মধ্যে আমরা দায়িত্ব নিয়েছি। বহু সমস্যা দেখা দিয়েছে। আসুন আমরা আলোচনার ভিত্তিতে একটা রূপরেখা তৈরি করি। সেটা ঠিকমতো বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না, তা দেখার জন্য আপনারা একটা টিম করবেন।’
স্বাস্থ্য উপদেষ্টার সহকারী মো. সায়েদুর রহমান আহত ব্যক্তিদের দেশের সেরা চিকিৎসা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দেন। উপদেষ্টাদের আশ্বাস পেয়ে আহত ব্যক্তিরা হাসপাতালে ফিরতে রাজি হন। তখন উপদেষ্টারা তাদের নিয়ে হাসপাতালে ঢোকেন। রোগীদের হাসপাতালের শয্যায় পৌঁছে দিয়ে পঙ্গু হাসপাতাল ও জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ভর্তি অন্য রোগীদের দেখে ভোর সোয়া ৪টার পর উপদেষ্টারা বাসার উদ্দেশে যাত্রা করেন।