আজ ১ মে, মহান মে দিবস। শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের দিন। ১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের শ্রমিকেরা ১০ থেকে ১২ ঘণ্টার কর্মদিবসের বিপরীতে ৮ ঘণ্টা কর্মদিবসের দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে জীবন দিয়েছিলেন। সেই আত্মদানের পথ ধরেই পৃথিবীর দেশে দেশে শ্রমজীবী মানুষ ন্যায্য মজুরি, অবকাশ, মানবিক আচরণ, স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ কর্মপরিবেশের দাবিতে আন্দোলন করে আসছেন। অনেক দেশেই শ্রমিকদের ৮ ঘণ্টার কর্মদিবসের দাবি পূরণ হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের অন্য নারী শ্রমিকদের মতো উপকূলের নারী শ্রমিকরা রয়েছেন আজও পিছিয়ে।
পুরুষের সমান কাজ করেও নায্য মজুরি পান না উপকূলের নারী শ্রমিকরা। নারী-পুরুষ একইসঙ্গে একই কাজ করে নারীরা ভুগছেন মজুরি বৈষম্যে। তারা তাদের অধিকার ও ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
উপকূলীয় এলাকায় দিনমজুরের চাহিদা অনেক বেশি। কিন্তু শ্রমিক সংকটের কারণ এই এলাকার অধিকাংশ পুরুষ শ্রমিকরা দেশের বিভিন্ন এলাকায় ইট ভাটাসহ গ্রাম ছেড়ে শহরে কাজে চলে যান। এজন্য শ্রমিক সংকট কাটাতে এবং স্বল্প মূল্যে শ্রমিক পেতে হতদরিদ্র নারী শ্রমিকদের বেছে নেন কৃষকসহ এই এলাকায় গড়ে ওঠা বিভিন্ন কাঁকড়া হ্যাচারি বা মৎস্য প্রকল্পের ব্যবসায়ীরা।
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপকূলীয় এলাকায় পুরুষের পাশাপাশি নারী শ্রমিকরা কাঁকড়ার খামার, মাছের ঘের, বিলে ধান কাটা, ধান মাড়াই করা, নদীতে রেণু আহরণ, সুন্দরবনের নদীতে মাছ ধরা, রাজমিস্ত্রির সহকারী, মাটিকাটা, গ্রামীণ রাস্তানির্মাণ ও সংস্কার, কৃষিকাজ করে থাকেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, উপজেলার মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের ধানখালী এলাকার ধানক্ষেতে ধান কাটা ও কেটে মাড়াই করার কাজ করা শ্রমিকের প্রায় অর্ধেকই নারী। একজন পুরুষ শ্রমিক দৈনিক ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা মজুরিতে কাজ করছেন। একই কাজ করে একজন নারী শ্রমিক মজুরি পাচ্ছেন ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। সমান কাজ করেও নারী শ্রমিকরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। এ বৈষম্য লাঘবের দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
নারী শ্রমিক কুলসুম আক্তার বলেন, স্বামীর আয়ে সংসার চালাতে কষ্ট হয়। তাই সংসার চালানোর জন্য আমিও ধান খেতে কাজ করতি আইছি (কাজ করতে এসেছি)। কিন্তু বেটাগো (পুরুষের) সমান কাজ করেও দিন শেষে অর্ধেক মজুরি পাচ্ছি। এটা খুব কষ্টের। এ মজুরি বৈষম্য নিরসনের দাবি জানাচ্ছি।
সোনাখালী গ্রামের নারী শ্রমিক সালেহা বেগম বলেন, একই সময়ে একই কাজ করে অর্ধেক মজুরি পাই। যখন মজুরি নিই তখন অনেক খারাপ লাগে।
নারীরা আজও অবহেলিত এবং বৈষম্যের শিকার দাবি করে শ্যামনগর পৌরসভা চিংড়াখালী গ্রামের রুমভা রানী জানান, কৃষিজমিতে দিনমজুরের কাজ শেষে বাড়িতে ফিরে রান্না করতে হয়। স্কুল থেকে সন্তানরা ও কাজ থেকে ফেরা দিনমজুর স্বামীকে দুপুরের খাবার দিয়ে গৃহস্থালির কাজ গোছাতে গোছাতে বিকাল। এরপর দুই কিলোমিটার দূর থেকে খাবার পানি এনে বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। রাতটুকু বিশ্রামের পর সকাল হতেই আবার কাজের জন্য বেরিয়ে পড়তে হয়। হাড়ভাঙা এমন পরিশ্রমের পরও পরিবারে যথাযথ মূল্যায়ন না পাওয়ার অভিযোগ তার।
শুধু কুলসুম আক্তার ও সালেহা বেগম আর রুমভা রানী নন, বরং উপকূলীয় এ জনপদের নারীদের প্রায় সবারই দাবি, তারা অনেক বেশি অবহেলা এবং বঞ্চনার শিকার। মজুরি বৈষম্যের পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে সমান সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয় না বলে অভিযোগ তাদের।
চাষি রফিকুল ইসলাম বলেন, ১০ বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছিলাম। এখন ধান কটে ঘরে তোলার সময় এসেছে এজন্য আমরা জমিতে প্রতিদিন ৮ জন শ্রমিক কাজ করছে। পুরুষ শ্রমিকের পাশাপাশি নারী শ্রমিকরাও কাজ করছে। পুরুষ শ্রমিকদের দৈনিক ৫৫০ টাকা এবং নারী শ্রমিকদের ৩০০ টাকা মজুরি দেই।
শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ, ঈশ্বরীপুর, কৈখালী, ভুরুলিয়াসহ বিভিন্ন এলাকার নারীদের অভিযোগ, নারী অধিকার নিয়ে সভা-সমাবেশ হচ্ছে। কিন্তু এত কিছুর পরও অদ্যাবধি নারীদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
কর্মক্ষেত্র আর মজুরির পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তাসহ পারিবারিকভাবেও এ জনপদের নারী বৈষম্যের শিকার বলে জানান অনেকে। শ্যামনগর সরকারের মহাসিন ডিগ্রী কলেজের শিক্ষার্থী মিনারা ইয়াসমিন, আরিফা আক্তার, আসমাউল হুসনা ও নূহা ইসলামসহ অন্যরা বলেন, মেয়েরা এখনও ন্যায্য অধিকার পাচ্ছেন না। পারিবারিক অসচ্ছলতার কারণে পিতামাতা মেয়েদের বেশিদূর পর্যন্ত লেখাপড়া করান না। ছেলেসন্তানদের বিষয়ে তারা উল্টো মনোভাব দেখান। এ ছাড়া স্কুল-কলেজে যাতায়াতের ক্ষেত্রে তারা প্রতিনিয়ত নানা সমস্যার সম্মুখীন হন।
উপজেলার দাতিনাখালি বনজীবী নারী উন্নয়ন সংগঠনের পরিচালক শেফালী বেগম। তিনি বলেন, এই অঞ্চলে অধিকাংশ পুরুষ সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল। আগে বছরে তিন মাস সুন্দরবনে প্রবেশ নিষেধাজ্ঞা থাকতো কিন্তু বর্তমানে ছয় মাস থাকে। সে কারণে পুরুষের পাশাপাশি নারীদের কাজ করতে হয়। না হলে তাদের সংসার চলে না।
তিনি আরও বলেন, এই অঞ্চলে অধিকাংশ নারীরা কাঁকড়া খামারে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। কিছু নারী মাছের ঘেরে, নদীতে রেণু আহরণ, সুন্দরবনের নদীতে মাছ ধরা, রাস্তা সংস্কার ও কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত। তাদের বাড়ির কাজ করতে হয় পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে পুরুষের সঙ্গে সমান বা তার চেয়ে বেশি কাজ করতে হয়। এরপরও পুরুষ যে মজুরি পায়, নারী পায় তার অর্ধেক। রাস্তা সংস্কারের কাজে একজন পুরুষ ৫০০ টাকা পেলে নারীকে দেওয়া হয় ৩০০ টাকা। এই এলাকার অধিকাংশ নারী তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন নয়। কর্মপরিবেশ, কর্মঘণ্টা বিষয়ে অধিকাংশই জানেন না। অনেকে জানলেও কাজ হারানোর ভয়ে এ বিষয়ে মুখ খুলতে চান না। সংগঠনের পক্ষ থেকে আমরা সম অধিকারের জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছি।
শ্যামনগর উপজেলা জাতীয় মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান মিসেস শাহানা হামিদ বলেন, পুরুষের পাশাপাশি নারীও অর্থনীতির চালিকাশক্তি। তাদের পেছনে রেখে উন্নয়ন অগ্রযাত্রার কথা ভাবা যায় না।
নারীদের অধিকার এখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি দাবি করে তিনি আরও বলেন, নারী-পুরুষদের মজুরি বৈষম্য থাকলে নারীরা কাজে অনুৎসাহী হবেন এবং দেশ অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে যাবে। তাই মজুরি বৈষম্য নিরসনে প্রশাসনকে উদ্যোগ নিতে হবে।
শ্যামনগর উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা শারিদ বিন শফিক বলেন, সাতক্ষীরা শ্যামনগর উপকূলীয় এ এলাকায় নারী শ্রমিক বেড়েছে। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও পরিবারের উন্নয়নে এগিয়ে আসছে। তবে এখানে নারী শ্রমিকদের মজুরি বৈষম্য রয়ে গেছে। নারীদের মজুরি বৈষম্য নিরসনে নারীরা যেন তাদের নায্য মজুরি পায় সে বিষয়ে মালিক ও শ্রমিকদের মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর থেকে সচেতনতা কার্যক্রম করা হয়। এছাড়া নারীর সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনিসহ সম-অধিকার প্রতিষ্ঠায় সরকার কাজ করে যাচ্ছে।
শ্যামনগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. নাজমুল হুদা বলেন, পুরুষ শ্রমিকদের পাশাপাশি নারী শ্রমিকরা মাঠে কাজ করছেন এটা ভালো লক্ষণ। দেশকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতে হলে নারী-পুরুষ সমানতালে এগোতে হবে। তবে কোনোভাবেই মজুরি বৈষম্য করা যাবে না। এতে নারী শ্রমিকরা কাজের উৎসাহ হারিয়ে ফেলবেন। তবে আগের তুলনায় নারী শ্রমিকদের মজুরি বৈষম্য অনেকটা কমে আসছে বলে দাবি করেন তিনি।
উল্লেখ্য, সারা বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় পালন করা হয় এ মে দিবস। ১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকেরা আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। ওই দিন অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করতে গিয়ে কয়েকজন শ্রমিককে জীবন দিতে হয়। এরপর থেকে দিনটি ‘মে দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য শ্রমিকদের আত্মত্যাগের এ দিনটিকে তখন থেকেই সারা বিশ্বে ‘মে দিবস’ হিসেবে পালন করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে বিশ্বব্যাপী সরকারি ছুটি থাকে এ দিন।
সিফাত/