সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর শেষ কর্মদিবস ছিল বুধবার (৪ জুন)। তাই কোনোমতে অফিসে হাজিরা দিয়ে বা নির্ধারিত সময় পার করেই অনেকেই ছুটছিলেন গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে। কেউ আবার পরিবার নিয়ে ব্যাগ-লাগেজ গুছিয়ে রওনা দেন।
বুধবার (৪ জুন) দুপুরের পর থেকেই রাজধানী ঢাকার সব সড়কেই দেখা যায় টার্মিনালমুখী মানুষের সরব পদচারণ।
এতে যাত্রীদের ব্যাপক চাপ দেখা যায় রাজধানীর রেলওয়ে স্টেশন, বাস ও লঞ্চ টার্মিনালে। সবার মাঝেই ছিল গ্রামে যাওয়ার ব্যাকুলতা। বাসের টিকিট-সংকট, কষ্টকর ভ্রমণ, পথের ঝক্কিঝামেলা মাথায় থাকলেও মন-প্রাণ ছুটে চলে বাড়ির দিকে।
সরেজমিন বুধবার রাজধানীর রেলওয়ে স্টেশন, বাস ও লঞ্চ টার্মিনাল এলাকা ঘুরে এসব চিত্র দেখা যায়। ঢাকা রেলওয়ে স্টেশনে (কমলাপুর) দেখা যায়, ঈদযাত্রার পঞ্চম দিনে রেলযাত্রায় বুধবার দিনভর ভুগিয়েছেন কালোবাজারিরা। আন্তনগর, মেইল, কমিউটার ট্রেনে দাঁড়িয়ে যাত্রার টিকিট নিয়ে বুধবার এই সংঘবদ্ধ চক্র ছড়ি ঘুরিয়েছে যাত্রীদের ওপর।
নিয়ম অনুযায়ী, ট্রেনের আসনসংখ্যার অনুপাতে ২৫ শতাংশ স্ট্যান্ডিং টিকিট বিক্রি করতে পারে রেলওয়ে। কিন্তু যাত্রীদের অতিরিক্ত চাপে আরও বেশি সংখ্যায় স্ট্যান্ডিং টিকিট বিক্রি করতে বাধ্য হন কাউন্টারকর্মীরা।
একপর্যায়ে সরেজমিন পরিদর্শনে এসে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী নির্দেশনা দেন টিকিট বিক্রির হার ২৫ শতাংশের মধ্যে রাখতে। এরপর স্ট্যান্ডিং টিকিট দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠলে যাত্রীরা কালোবাজারিদের খপ্পরে পড়েন। অনেকে আসনসহ টিকিট পেলেও রেলযাত্রার শুরুর সময় জানতে পারেন, তার টিকিট জাল। তাদের কেউ কেউ পরে রেলযাত্রা বাতিল করতে বাধ্য হন।
বুধবার সকাল ৯টা ২০ মিনিটের দিকে ঢাকা ছেড়ে যায় রংপুর এক্সপ্রেস ট্রেনটি। সেই ট্রেনের যাত্রী ফখরুল ইসলাম স্ট্যান্ডিং টিকিট না পেয়ে ফিরে যাচ্ছিলেন। তখন সাধারণ পোশাকে থাকা এক তরুণ এগিয়ে এসে তাকে উত্তরবঙ্গের কোনো রুটের টিকিট লাগবে কি না জিজ্ঞাসা করেন। পরে তার কাছে পাওয়া যায় রংপুরের টিকিট। স্ট্যান্ডিং টিকিটের দাম যেখানে ৪২০ টাকা নেওয়ার কথা, সেখানে ফখরুলকে কিনতে হয় ৭০০ টাকায়।
ফখরুল ইসলাম অভিযোগ করে খবরের কাগজকে বলেন, ‘এরা আসলে আগে থেকে টিকিট সব বুকিং দিয়ে রাখে। তারপর ট্রেন ছাড়ার ঠিক আগে আগে ওরা স্টেশনের কোনায় দাঁড়িয়ে থাকে। ওরা টের পেয়ে যায় কার টিকিট লাগবে। ঈদে বাড়ি যেতেই হবে, না হলে ব্ল্যাকার থেকে টিকিট কাটব, এমন প্রশ্নই আসে না।’
ফখরুলের মতো আরও অনেক যাত্রীই এদিন কালোবাজারিদের কবলে পড়েন। উপায়ান্তর না দেখে তারা অনেকে দ্বিগুণ বা আড়াই গুণ টাকা দিয়ে টিকিট নিয়ে রওনা হন বাড়ির পথে। অনেক যাত্রী আন্তনগর ট্রেনের স্ট্যান্ডিং টিকিট না পেয়ে যান মেইল বা কমিউটার ট্রেনের টিকিট কাটতে। জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ স্টেশনের যাত্রী এরশাদ হোসেন কাউন্টার থেকে টিকিট পাননি। পরে ব্ল্যাকারের কাছে টিকিট মেলে। তবে ১০৫ টাকার টিকিট তাকে কিনতে হয়েছে ২৫০ টাকায়।
এ নিয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘এবার রেলের টিকিটে কোনো কালোবাজারি হয়নি। কালোবাজারি অনেক কমে গেছে, বলতে গেলে এখন নেই।’
ঈদযাত্রায় ট্রেনের পাওয়ার কার বা খাবার গাড়িতে (বুফেকার) যাত্রী পরিবহন নিষিদ্ধ থাকলেও বুধবার বেলা ৩টার দিকে রাজশাহীগামী সিল্ক সিটি এক্সপ্রেসে এর ব্যতিক্রম দেখা গেছে। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ফাহিমুল ইসলাম ও রেলওয়ের মহাপরিচালক আফজাল হোসেন সরেজমিন এসে বেশ কয়েকজন যাত্রীকে বুফেকার থেকে নামিয়ে দেন। পরে তাদের শোভন শ্রেণির কামরায় পাঠানো হয়। ফাহিমুল ইসলাম স্বীকার করে নেন, রেলের কিছু অসাধু কর্মচারী বাড়তি টাকার লোভে বুফেকারে যাত্রী পরিবহন করছেন। এদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান।
বাসে টিকিটে হাহাকার, অতিরিক্ত ভাড়ায় নাজেহাল যাত্রীরা
ঢাকার গাবতলী, সায়েদাবাদ, মহাখালী ও ফুলবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ড এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, ঈদযাত্রার শেষ পর্যায়েও অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ে করা হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যার পর রাজধানীর কল্যাণপুর, টেকনিক্যাল ও গাবতলী বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দেখা যায়, হাতে ব্যাগ ও শিশুসন্তানদের নিয়ে টিকিটের জন্য এক কাউন্টার থেকে অন্য কাউন্টারে ছুটছেন যাত্রীরা। কিন্তু বাস কাউন্টারের স্টাফরা যাত্রীদের দিকে ঘুরেও তাকাচ্ছিলেন না। টিকিটের বিষয় প্রশ্ন করলে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকেন। কোনো ধরনের পাত্তাই দিচ্ছেন না যাত্রীদের। দু-একটি বাস এলেও সেখানে তিল ধারণের ঠাঁই নেই, কারণ ওই সব যাত্রী আগে টিকিট কেটে রেখেছিলেন। এখন শুধু বাড়ির উদ্দেশে যাত্রা করছেন। যারা আগে টিকিট কাটেননি, তারা পড়েছেন চরম ভোগান্তিতে।
সপরিবারে নাটোরে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশে টেকনিক্যাল মোড়ের কাউন্টারে আসেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা রাজীব আহমেদ। চারটি টিকিট দরকার তার। একাধিক কাউন্টারে ঘুরেও টিকিট না পেয়ে হতাশা ব্যক্ত করেন তিনি। অভিযোগ করেন, বাসের স্টাফরা অতি চালাকি করছেন। তাদের পরিচিত দু-একজন এলেই ইশারা দিয়ে টিকিটের ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন।
এদিকে বাসের কাউন্টারের সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের বিরুদ্ধে বাড়তি ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। যাত্রীরা বলছেন, বাড়তি টাকা দিলেই মিলছে টিকিট। এর আগে গতকাল বিকেলেও কল্যাণপুর ও গাবতলী গিয়ে দেখা যায়, ঈদে ঘরমুখী মানুষের বেশ চাপ। সড়কেও ছিল বাইকসহ বিভিন্ন ধরনের যানবাহনের জটলা। অনেকেই পরিবারসহ ব্যাগ-লাগেজ নিয়ে ছুটছিলেন বাসস্ট্যান্ডের দিকে।
এদিকে বুধবার বিকেলে মহাখালী বাস টার্মিনালে দেখা যায় জামালপুরের বিনিময় পরিবহন, ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়াগামী ইমাম পরিবহন, টাঙ্গাইলের নিরালা পরিবহনের সামনে যাত্রীদের ব্যাপক ভিড়। তবে অভিযোগ করা হচ্ছিল- দেড় থেকে দুই গুণ বেশি ভাড়া রাখা হয়েছে। গতকাল বিকেলে মহাখালী বাস টার্মিনাল পরিদর্শনে এসে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ‘যদি অতিরিক্ত ভাড়া কেউ আদায় করে, তবে মালিক সমিতিকে জানাবেন বা আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানাবেন। জড়িতদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
রাজধানীর ফকিরাপুল, আরামবাগের বাস কাউন্টারে সিলেট, খুলনাগামী যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলেও বাড়তি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে। র্যাব, পুলিশ ও বিআরটিএর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা যতক্ষণ সক্রিয় ছিলেন, ঠিক ততক্ষণ টিকিট বিক্রিতে নির্ধারিত টাকা নেওয়া হচ্ছিল। তারা চলে গেলেই ইচ্ছামতো বাড়তি ভাড়া আদায় করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন যাত্রীরা।
বাংলাদেশ বাস ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শুভঙ্কর ঘোষ রাকেশ বলেন, ‘নন-এসি বাসের ভাড়া, বিশেষ করে আমার পরিবহনে একটা টাকাও বাড়ানো হয়নি। বিআরটিএ নির্ধারিত ভাড়াই আমরা নিচ্ছি। তবে এসি বাসের ভাড়া একেক রকম। এসব গাড়ির ভাড়া তো মালিক সমিতিও নির্ধারণ করতে পারে না। বিআরটিএ এখনো এই ভাড়া নির্ধারণ করে দেয়নি। বিআরটিএ যদি সবকিছুর সমন্বয় করে একটি ভাড়া নির্ধারণ করে দিত, তাহলে সেই ভাড়া রাখা হতো।’
সদরঘাটে ঘরমুখী মানুষের ভিড়
বুধবার বিকেলে রাজধানীর সদরঘাটে ছিল যাত্রীদের উপচেপড়া ভিড়। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) সদরঘাট নৌ টার্মিনালের যুগ্ম পরিচালক মুহম্মদ মোবারক হোসেন জানান, গতকাল ৮০টি লঞ্চ সদরঘাট টার্মিনাল থেকে বিভিন্ন রুটের উদ্দেশে ছেড়ে গেছে।
কর্ণফুলী লঞ্চের স্টাফ তোহা আলম বলেন, ‘ঈদযাত্রা উপলক্ষে কেবিনের সব টিকিট আগেই বিক্রি হয়ে গেছে। অনেক যাত্রী কেবিনের টিকিট না পেয়ে শেষে ডেকে করে বাড়ি যাচ্ছেন। আবহাওয়া ভালো থাকলে এবার লঞ্চের ঈদযাত্রা বেশ আনন্দময় হবে।’
মহাসড়কে বেড়েছে যানবাহনের চাপ, যাত্রীরা বাড়ি যাচ্ছেন খোলা ট্রাকে
সড়কপথে ঈদযাত্রায় বুধবার ঢাকা-টাঙ্গাইল-যমুনা সেতু মহাসড়কে যানবাহনের চাপ ছিল প্রায় দ্বিগুণ। দেখা গেছে, গণপরিবহন না পেয়ে অনেক মানুষ খোলা ট্রাক কিংবা রাজধানী থেকে ফিরতে থাকা কোরবানির পশুবাহী গাড়িতে উঠেছেন। এই মহাসড়কে ঈদযাত্রায় বুধবার ভোগান্তি বাড়ে একাধিক সড়ক দুর্ঘটনায়। যমুনা সেতুর সংযোগ সড়কে বুধবার ভোরে একাধিক সড়ক দুর্ঘটনার পর যানজট তৈরি হয় এলেঙ্গা থেকে। তবে দুর্ঘটনায় পড়া গাড়িগুলো সরিয়ে নেওয়ার পর দুপুরে মহাসড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক হয় বলে জানান যমুনা সেতুর পূর্ব থানার ওসি ফয়েজ আহমেদ।
গজারিয়ার ভবেরচর হাইওয়ে পুলিশের (এসআই) মোহাম্মদ ফয়সাল আহমেদ খবরের কাগজকে জানান, গতকাল ভোর থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মুন্সীগঞ্জ প্রান্তে চট্টগ্রামমুখী লেনে গাড়ি চলেছে ধীরগতিতে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সেই জট ছুটে যায়। তবে সন্ধ্যার পর মহাসড়কের বিভিন্ন অংশে বাড়তি চাপ থাকার কথা জানান তিনি।
বুধবার ঢাকা-আরিচা ও আশুলিয়ার নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে যানবাহন চলছে ধীরগতিতে। সাভার হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ছালেহ আহমেদ বলেন, শিল্পাঞ্চলের অধিকাংশ কারখানায় ছুটি ঘোষণা করায় সাভারে ঈদে ঘরমুখী মানুষের চাপ বাড়ে। ফলে সড়কে যানবাহনের সংখ্যাও বাড়ে। ঢাকা-আরিচা ও নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কের বাইপাইলসহ বেশ কিছু জায়গায় যানবাহনের ধীরগতি থাকলেও কোথাও যানজট ছিল না।
প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন খবরের কাগজের নিজস্ব প্রতিবেদক জয়ন্ত সাহা, আরিফ সাওন, শেখ জাহাঙ্গীর আলম, জিয়াউদ্দিন রাজু, মুন্সীগঞ্জ, টাঙ্গাইল ও সাভার প্রতিনিধি।