
দেশের শীর্ষ পাঁচ ব্যবসায়ী এবং তাদের সব প্রতিষ্ঠানের কর, ভ্যাট ও শুল্ক ফাঁকির তদন্তে নেমেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কেন্দ্রীয় সংস্থা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল (সিআইসি)।
তদন্তের প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও তাদের প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবের তথ্য চেয়ে বিভিন্ন ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, সঞ্চয় অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি পাঠানো হয়েছে। গতকাল এনবিআর থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব কথা জানানো হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘ওরিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান ওবায়দুল করিম, নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার, সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খান, বেক্সিমকো গ্রুপের কর্ণধার সালমান এফ রহমান এবং বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান ও তাদের প্রতিষ্ঠানের রাজস্ব পরিশোধসংক্রান্ত সব তথ্য খতিয়ে দেখা হবে। রাজস্ব ফাঁকির প্রমাণ পাওয়া গেলে ধারাবাহিকভাবে এসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আয়কর আইন, ২০২৩ ও মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এর আওতায় রাজস্ব উদ্ধারের পাশাপাশি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়েছে, ‘সিআইসি বিভিন্ন সংবাদ পর্যালোচনা ও সুনির্দিষ্ট গোপন তথ্যের ভিত্তিতে সম্ভাব্য কর ফাঁকিবাজদের তালিকা করেছে। অবৈধ সম্পদ অর্জনকারী সন্দেহভাজন এসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে রাজস্ব ফাঁকির বিশেষ অনুসন্ধান শুরু করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় এ পাঁচ ব্যবসায়ী ও তাদের প্রতিষ্ঠানের রাজস্ব ফাঁকির তদন্ত করা হবে।’
এর আগে গত বুধবার এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান সিআইসি কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে এই পাঁচটি শিল্পগোষ্ঠীর গত কয়েক বছরের আয়কর, ভ্যাট, কাস্টমস-সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করে কর ফাঁকির তদন্ত করতে নির্দেশ দেন। এ ছাড়া এসব গোষ্ঠীর মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের আমদানি-রপ্তানি পর্যালোচনা করতেও বলা হয়েছে। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সাবেক মন্ত্রীসহ অনেকের ব্যাংক হিসাব জব্দ ও তলব করা হয়েছে। এসব ব্যক্তি ও তাদের পরিবার এবং ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের রাজস্ব ফাঁকির তথ্য খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
এরই মধ্যে এনবিআরে নামে-বেনামে ওরিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান ওবায়দুল করিম, নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার, সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খান, বেক্সিমকো গ্রুপের কর্ণধার সালমান এফ রহমান এবং বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান ও তাদের প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি, রাজস্ব ফাঁকিসহ বিভিন্ন অভিযোগ জমা পড়েছে। এসব অভিযোগ তদন্ত কর্মকর্তারা আমলে এনে বিস্তারিত তদন্ত করছেন।
ওরিয়ন গ্রুপের ওবায়দুল করিমের নামে এনবিআরে জমা পড়া অভিযোগে বলা হয়েছে, বিগত সরকারের আমলে বিভিন্ন ধরনের অবৈধ সুবিধা নিয়েছেন ওবায়দুল করিম। গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ী (মেয়র মোহাম্মদ হানিফ) ফ্লাইওভার নির্মাণে ওরিয়ন গ্রুপ বিনিয়োগ দেখিয়েছে ১০০ কোটি টাকা। কিন্তু প্রকল্পের ব্যাংক হিসাবে মাত্র ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯০ টাকা দেখানো হয়েছে। ১০০ কোটি টাকার বাকি অর্থ বিভিন্ন খাতে জাল কাগজপত্রের মাধ্যমে খরচ দেখানো হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, ওরিয়নের চেয়ারম্যান আমদানি-রপ্তানিতে ভুয়া তথ্য দেখিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করেছেন।
নাসা গ্রুপের নজরুল ইসলাম এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যানও ছিলেন। তার নামে এনবিআরে জমা পড়া অভিযোগে বলা হয়েছে, নজরুল ইসলাম পদ-পদবির ক্ষমতা ও প্রভাব খাটিয়ে আমদানি-রপ্তানির আড়ালে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করেছেন। ঋণ দেওয়া-নেওয়াসহ নানা ক্ষেত্রে করেছেন গুরুতর অনিয়ম। যার ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে বিভিন্ন ব্যাংকের কয়েকটি প্রতিবেদনেও। বিশেষ প্রভাব খাটিয়ে বহু জমি দখলে নিয়েছেন। নজরুল ইসলাম রাতারাতি আওয়ামী লীগের শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে যান। তিনি প্রায় প্রতিবছরই গ্রাহকের (নাসা গ্রুপ) ঋণসীমার অতিরিক্ত বিতরণ করেছেন এবং আমদানির তুলনায় রপ্তানি কম দেখিয়েছেন। নাসা গ্রুপের চেক, পে-অর্ডার বা নগদ অর্থ উত্তোলনের মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের টাকা অন্যান্য ব্যাংকের বিভিন্ন হিসাবে স্থানান্তর করা হয়েছে। এসব অর্থ কোথায় ও কী উদ্দেশ্যে গ্রহণ এবং কোন খাতে ব্যবহার করা হয়েছে, তা জানা যায়নি। নাসা গ্রুপের নামে ব্যাংকিং সেক্টরের নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, জালিয়াতি, অর্থ পাচারসংক্রান্তসহ বহু অভিযোগ রয়েছে।
এনবিআরের অভিযোগে বলা হয়েছে, সামিটের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খান রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে অবৈধ সুবিধা নিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করেছেন। নামমাত্র রাজস্ব পরিশোধ করেছেন। প্রভাব খাটিয়ে এনবিআর থেকে তার এবং তার প্রতিষ্ঠানের রাজস্বসংক্রান্ত ফাইল খতিয়ে দেখা স্থগিত করে রেখেছেন। স্বতন্ত্র বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী (আইপিপি) প্রতিষ্ঠান সামিট পাওয়ার লিমিটেড ১৯৯৭ সালে উপাদনে আসে। ২০০১ সালে সামিটের তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ৩৩ মেগাওয়াট। বিগত সরকার এবারে ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিপিডিবির সঙ্গে একের পর এক বিদ্যুৎ বিক্রির চুক্তিতে আবদ্ধ হতে থাকে কোম্পানিটি। প্রথমে কুইক রেন্টাল, পরে আইপিপি স্থাপনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে থাকে সামিট পাওয়ার। বিশেষ করে গত এক দশকে বেসরকারি খাত থেকে বিপিডিবির বিদ্যুৎ কেনায় সামিট পাওয়ারই প্রাধান্য পেয়েছে। নিয়মবহির্ভূত সুবিধা, ব্যাংকঋণ এবং ভর্তুকি নেওয়া ছিল প্রতিষ্ঠানটির নিয়মিত বিষয়। সিঙ্গাপুরে ব্যবসা চালানোর অনুমতি দেওয়া হয়।
এনবিআরে জমা পড়া আবেদনপত্রে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা এবং বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎসহ বিদেশে টাকা পাচারের অভিযোগ আছে। সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে দুর্নীতির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ নিয়ে কয়েকটি গণমাধ্যমে প্রতিবেদন ছাপা হয়। তার ভিত্তিতেই এনবিআর থেকে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে শেয়ারবাজারে জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে শেয়ারহোল্ডারদের হাজার কোটি টাকা লোপাট, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করে বিদেশে পাচারের অভিযোগও করা হয়েছে।
এনবিআরে জমা হওয়া আবেদনপত্রে বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান ওরফে শাহ আলমকে ভূমিদস্যু হিসেবে উল্লেখ করে ১ লাখ কোটি টাকারও বেশি আত্মসাতের অভিযোগ করা হয়েছে। শাহ আলম দেশের বিভিন্ন তফসিলি ব্যাংক থেকে নামমাত্র জামানত রেখে নেওয়া ঋণের বেশির ভাগ অর্থ দুবাই, সিঙ্গাপুর, সাইপ্রাস, লন্ডন, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে পাচার করেছেন। ১৯৮৮-৮৯ সালের দিকে শাহ আলম জোয়ার সাহারা মৌজায় প্লট আকারে জমি বেচাকেনা শুরু করেন। এসব জমি জোর করে দখলে নেন বলেও অভিযোগ আছে। এ ছাড়া শাহ আলম ভয়ভীতি দেখিয়ে পিংক সিটি আবাসন প্রকল্প, ভাইয়া গ্রুপের হাউজিং প্রকল্প, মোহাম্মদীয়া হাউজিং, রিলায়েন্স হাউজিং, পারটেক্স হাউজিংসহ ১৫-২০টি হাউজিং কোম্পানির জায়গা দখল করে নিয়েছেন বলেও জানানো হয়েছে। বহু মানুষের টাকা মেরে দিয়ে তাদের পথে বসিয়েছেন। তিনি আমদানি-রপ্তানিতে জাল কাগজপত্র দেখিয়ে হাজার কোটি টাকা ফাঁকি দিয়ে অর্থ পাচার করেছেন।