ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হাসিনার পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে প্রথম যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের কোনো প্রতিনিধিদল আসছে আজ শনিবার (১৪ সেপ্টেম্বর)। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বেশ কয়েকটি প্রস্তাব দেবে বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব দপ্তরের ডেপুটি আন্ডার সেক্রেটারি ব্রেন্ট নেইম্যানের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল আজ নয়াদিল্লি থেকে ঢাকায় আসছে। এ প্রতিনিধিদল আগামীকাল রবিবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশ বেশ কয়েকটি প্রস্তাব দেবে। পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনতে সহায়তা, সরকারের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখা ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি ভারতীয় মনোভাব যাতে সহায়তাপূর্ণ থাকে তেমন প্রস্তাব।
গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নেওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র এই সরকারের সঙ্গে কাজ করার কথা জানায়। তারপর জাতিসংঘসহ পশ্চিমা বিশ্বও অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে কাজ করার কথা জানায়। ইতোমধ্যে পশ্চিমা অনেক দেশের রাষ্ট্রদূতের কাছে ড. ইউনূস পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে সহায়তা চেয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন সম্প্রতি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লুর সঙ্গে সে দেশের বড় একটি টিম আসবে। ডোনাল্ড লু কম সময় এখানে থাকবেন। কিন্তু ওই টিম অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও বৈঠক করবে। পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়েই কথা হবে।
এক প্রশ্নের উত্তরে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা জানান, সেন্ট মার্টিন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তার অবস্থান আগেই নিশ্চিত করেছে। তাদের পক্ষ থেকে এমন কিছু বলা হয়নি।
পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে সহায়তা
একটি হিসাব বলছে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৬ বছরে দেশ থেকে ১১ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। এর বিপরীতে বিদেশি ঋণ রয়েছে প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলার। সরকার এখন ঋণ পরিশোধ করতে পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে চায়। ইতোমধ্যে সরকার কূটনৈতিক চ্যানেলে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কথাও বলেছে।
ঢাকার কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, এবার মার্কিন প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বে ডোনাল্ড লু নয়, ট্রেজারি বিভাগের সহকারী আন্ডার সেক্রেটারি ব্রেন্ট নেইম্যান থাকছেন। এ কারণে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত পেতে সহায়তা-সংক্রান্ত আলোচনা গতি পাবে।
প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ড. ইউনূস দায়িত্ব নেওয়ার পর সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনারের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈঠকগুলোতে আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতিবাজদের পাচার হওয়া বিপুল পরিমাণ টাকা ফেরত আনতে সহযোগিতা চেয়েছেন। রাষ্ট্রদূতদের মধ্যে মার্কিন দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্সও ছিলেন।
সরকারের প্রতি অব্যাহত মার্কিন সমর্থন
সংশ্লিষ্টরা জানান, যুক্তরাষ্ট্র যদিও অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই সমর্থন জানিয়ে আসছে তার পরও সরকার এই সমর্থন অব্যাহত রাখার নিশ্চয়তা চাইবে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা মিত্ররাও যেন সরকারের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখে, সেই নিশ্চয়তা চাইতে পারে ঢাকা।
আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের ওপর পুরো পশ্চিমা ব্লক, এমনকি জাতিসংঘের সমর্থনও নির্ভর করে। কাজেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরকারের বোঝাপড়াটা গুরুত্বপূর্ণ।
ইতোমধ্যে জাতিসংঘের মহাসচিব ড. ইউনূসকে চিঠি দিয়ে সরকারের প্রতি সমর্থনের কথা জানিয়েছেন। এ ছাড়া জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার একাধিকবার ফোনে কথা বলেছেন। জাতিসংঘ তদন্ত দল পাঠিয়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গুলির ঘটনার তদন্তের আশ্বাস দিয়েছে।
ঢাকার প্রতি নয়াদিল্লির সহায়তাপূর্ণ মনোভাব তৈরিতে ভূমিকা
ঢাকার প্রতি নয়াদিল্লির নমনীয় মনোভাব তৈরিতে ভূমিকা রাখতে ওয়াশিংটনের কাছে সহায়তা চাওয়া হবে বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়। ভারত শেখ হাসিনার প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখায় পতন মেনে নিতে পারেনি। তাই নানা কারণে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে টানাপোড়েন চলছে দেশটির।
সম্প্রতি ‘পানি আগ্রাসন’ ও ‘সীমান্ত হত্যা’ নিয়ে সম্পর্ক যথেষ্ট নাজুক দুই দেশের মধ্যে। এ অবস্থায় নয়াদিল্লির মনোভাব যাতে ঢাকার প্রতি নমনীয় হয়, সে জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা চাওয়া হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়।
আজ আসছে প্রতিনিধিদল
ব্রেন্ট নেইম্যানের নেতৃত্বে উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল আজ আসছে। তাদের সঙ্গে থাকছেন ডোনাল্ড লু। তবে তিনি সরাসরি ওয়াশিংটন থেকে আসবেন না।
নবনিযুক্ত পররাষ্ট্রসচিব মো. জসীম উদ্দিন গত বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদল ঢাকায় আসছে। এটা বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে যুক্তরাষ্ট্র যে গুরুত্ব দেয় তার একটা বড় প্রতিফলন। আমাদের সঙ্গে তাদের আলোচনাটা বহুমাত্রিক হবে। এটা শুধু একটি বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। সেভাবেই আমাদের দিক থেকে প্রস্তুতি নিচ্ছি।’
আলোচ্যসূচিতে কোন বিষয়ে গুরুত্ব পাবে- জানতে চাইলে পররাষ্ট্রসচিব বলেন, ‘আমাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে কথাবার্তা বলব এবং তার মধ্যে বহুমাত্রিকতা হবে। কিন্তু আমি আলোচনার আগে বা প্রতিনিধিদল বসার আগে কোনো ধরনের সুনির্দিষ্ট আলোচ্যসূচির বিষয় প্রকাশ করে আলোচনাকে প্রভাবিত করতে চাই না।’
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের সদস্যরা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনসহ একাধিক উপদেষ্টার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে পারেন।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে প্রতিনিধিদলের সাক্ষাৎ কাল
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল আগামীকাল রবিবার (১৫ সেপ্টেম্বর) প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে জানানো হয়েছে, আজ শনিবার মার্কিন প্রতিনিধিদল ঢাকায় আসার পর কাল বেলা ১১টার দিকে ঢাকার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় এ বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।
গত ৮ আগস্ট অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রথমবারের মতো কোনো মার্কিন প্রতিনিধি বাংলাদেশ সফর করছে। সফরকালে প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেবেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক ব্যুরোর সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। তিনি এখন নয়াদিল্লি সফর করছেন।
প্রতিনিধিদলে মার্কিন ট্রেজারি বিভাগ, ইউএসএআইডি ও মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধিদের কার্যালয়ের প্রতিনিধিরা থাকবেন।