সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেও টিকিট জটিলতার কারণে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যেতে না পারা প্রায় ১৮ হাজার বাংলাদেশিকে মালয়েশিয়ায় প্রবেশের সুযোগ করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম।
শুক্রবার (৪ অক্টেবর) বিকেলে ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেন তিনি। খবর ইউএনবি ও বাসসের।
এই ঘোষণা দেওয়ার জন্য দেশের সব মানুষের পক্ষ থেকে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস। একই সঙ্গে যৌথ প্রচেষ্টার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সংকটের দ্রুত ও আন্তর্জাতিক সমাধানের গুরুত্বের কথা তুলে ধরেন। এ ছাড়া অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথইস্ট এশিয়ান নেশনসের (আসিয়ান) সেক্টরাল ডায়ালগ পার্টনার হতে বাংলাদেশের জন্য মালয়েশিয়ার সমর্থন চেয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা।
এর আগে এদিন বেলা ২টায় মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছালে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তাকে স্বাগত জানান। বিমানবন্দরে তাকে লাল গালিচা সংবর্ধনা দেওয়া হয়।
যৌথ সংবাদ সম্মেলনে উপযুক্ত কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার কথা উল্লেখ করে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী জানান, তার সরকার সব শর্ত পূরণ সাপেক্ষে প্রথম ধাপে ১৮ হাজার বাংলাদেশি শ্রমিকের মালয়েশিয়ায় প্রবেশের বিষয়ে অবিলম্বে মনোযোগ দেবে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমরা পুরো ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করেছি। আমরা অত্যন্ত স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গিয়েছি। আমাদের শ্রমিক দরকার, তাদের আধুনিক দাস হিসেবে গণ্য করা যাবে না; তারা বাংলাদেশ বা অন্য দেশের যেখানেই আসুক না কেন। আমি এখানকার মতো আগেও প্রকাশ্যে এ কথা বলেছি।’ মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী অবশ্য বাংলাদেশকে সতর্কতা অবলম্বন করতে এবং মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত বাংলাদেশি বা বিদেশি- কারও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডকে প্রশ্রয় না দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বিষয়গুলো স্মরণ করিয়ে দেন।
আসিয়ান সংলাপে অংশীদার হতে মালয়েশিয়ার সমর্থন চান ড. ইউনূস
যৌথ সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথইস্ট এশিয়ান নেশনসের (আসিয়ান) সেক্টরাল ডায়ালগ পার্টনার হতে বাংলাদেশের জন্য মালয়েশিয়ার সমর্থন চেয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা ২০২৫ সালে আসিয়ানের আসন্ন সভাপতি পদে মালয়েশিয়াকে অভিনন্দন জানাই। আমরা আসিয়ানের সেক্টরাল ডায়ালগ পার্টনার হিসেবে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছি। আমরা আঞ্চলিক ফোরামে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির জন্য মালয়েশিয়ার সক্রিয় ভূমিকার অপেক্ষায় রয়েছি।’
দুই দেশের বিদ্যমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কথা স্মরণ করে মালয়েশিয়াকে বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের বন্ধু উল্লেখ করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, আনোয়ার ইব্রাহিমের সফর বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। দুই মাস আগে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর কোনো দেশের প্রধানমন্ত্রীর এটিই প্রথম বাংলাদেশ সফর। এই সফর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি মালয়েশিয়ার সমর্থনের স্বীকৃতি। দুই নেতার মধ্যে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা সম্পর্কে তিনি বলেন, তারা উভয়েই দীর্ঘদিনের দ্বিপক্ষীয় ইস্যুগুলোকে জোরদার করতে তাদের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আলোচনায় বাংলাদেশের দ্বিতীয় বিপ্লব নজিরবিহীন গণ-আন্দোলন বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। শিক্ষার্থীরা তাদের স্বাধীনতা ও বৈষম্যমুক্ত নতুন বাংলাদেশ গড়ার জন্য তাদের জীবন বিসর্জন দিয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ন্যায়বিচারপূর্ণ বাংলাদেশ গড়তে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তিনি আরও বলেন, ‘জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে আমরা আমাদের ভ্রাতৃপ্রতিম দেশ মালয়েশিয়ার অবিচল সমর্থন ও সহযোগিতার প্রশংসা করি।’ অভিন্ন মূল্যবোধ, আস্থা ও জনগণের কল্যাণের স্বীকৃতির মাধ্যমে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদার করার কথা উল্লেখ করে অধ্যাপক ইউনূস জানান, তারা সহযোগিতা, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ এবং সংস্কৃতির ক্ষেত্র নিয়ে আলোচনা করেছেন। তারা মায়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ থেকে মায়ানমারে নিরাপদ প্রত্যাবাসন করার বিষয় নিয়েও আলোচনা করেন।
প্রধান উপদেষ্টা জানান, দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত রোহিঙ্গা ইস্যুটি সমাধানের জন্য তিনি মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীকে বিষয়টি আসিয়ান ফোরামে নিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ও পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ে নিয়মিত দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করার বিষয়ে সম্মত হয়েছি।’ ঢাকায় অনুষ্ঠেয় চতুর্থ যৌথ কমিশনের বৈঠকের কথা উল্লেখ করে তিনি দুই দেশের মধ্যে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের ওপর জোর দেন। তিনি জানান, তারা কৃষি, জ্বালানি, যোগাযোগ, সুনীল অর্থনীতি, বিজ্ঞান, উদ্ভাবন ও প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে সহযোগিতার সম্ভাবনা অন্বেষণ এবং মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়েও আলোচনা করেছেন।
অধ্যাপক ইউনূস বলেছেন, ‘আমরা আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে একটি নতুন উচ্চতায় উন্নীত করতে নিবিড়ভাবে কাজ করতে আমাদের দৃঢ় অঙ্গীকার ও সংকল্প ব্যক্ত করেছি।’
প্রসঙ্গত, বর্তমানে আনুমানিক আট লাখ বাংলাদেশি মালয়েশিয়ায় বসবাস ও কাজ করেন। এর মধ্যে ২০২২ সালের আগস্ট থেকে চলতি বছরের মে মাসের মধ্যে প্রায় সাড়ে চার লাখ অভিবাসী হয়েছেন।
‘পুরোনো বন্ধু’ ইব্রাহিমকে পেয়ে উচ্ছ্বসিত ইউনূস
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস ও মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের আগে হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে সংক্ষিপ্ত একান্ত বৈঠক করেন। এ সময় অধ্যাপক ইউনূস জানান, তিনি তার পুরোনো বন্ধুকে ঢাকায় স্বাগত জানাতে পেরে ‘অত্যন্ত আনন্দিত’, কারণ তারা চার দশকেরও বেশি সময় ধরে একে অপরকে চেনেন। ড. ইউনূস ছাত্র নেতৃত্বাধীন বিপ্লব, ছাত্র ও জনগণের আত্মত্যাগ এবং পূর্ববর্তী সরকারের হত্যাযজ্ঞ নিয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন। প্রধান উপদেষ্টা মালয়েশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় এবং এর নেতাদের সঙ্গে তার দীর্ঘ সম্পর্কের কথাও বলেন। তারা তাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকস্থলে যাওয়ার জন্য একই গাড়িতে ওঠেন।
দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই সফর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই সফরটি বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক গভীর এবং টেকসই বন্ধুত্বের অভিব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।’
মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ‘কম্প্রিহেনসিভ স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ’-এর ওপর গুরুত্বারোপ করেন এবং বাংলাদেশে মালয়েশিয়ার কোম্পানি ও মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি কোম্পানিগুলোর সমস্যা দ্রুত সমাধান করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
আরও জনশক্তি রপ্তানিতে সহযোগিতা চাইলেন রাষ্ট্রপতি
রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় যাতে আরও জনশক্তি যেতে পারে, সে ব্যাপারে মালয়েশিয়ার সরকারের সহযোগিতা চেয়েছেন। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম গতকাল বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎকালে তিনি এই সহযোগিতা চান।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের ‘অর্থনীতি সংস্কার’ কর্মসূচিতেও মালয়েশিয়া সরকারের সহযোগিতারও অনুরোধ জানান রাষ্ট্রপতি।
রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব মো. জয়নাল আবেদীন সাংবাদিকদের জানান, সাক্ষাৎকালে তারা দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়, বিশেষ করে বাণিজ্য, বিনিয়োগ, অর্থনৈতিক, কারিগরি সহযোগিতা, রোহিঙ্গা ইস্যু, শ্রমবাজারসহ বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে মতবিনিময় করেন।
বৈঠকে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের চারজন মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, সংশ্লিষ্ট সচিব, বাংলাদেশের নিযুক্ত মালয়েশিয়ার হাইকমিশনার প্রমুখ তার সঙ্গে ছিলেন। বাংলাদেশের পক্ষে ছিলেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন এবং আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল ও সংশ্লিষ্ট সচিবরা উপস্থিত ছিলেন।
বঙ্গভবনের ক্রেডেনশিয়াল হলে বৈঠক শেষে একটি পরিদর্শন বইয়ে স্বাক্ষর করেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী।
লাল গালিচা সংবর্ধনা
দুই দেশের সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে অতি সংক্ষিপ্ত সরকারি সফরে আনোয়ার ইব্রাহিম গতকাল শুক্রবার দুপুর ঢাকায় পৌঁছালে তাকে লাল গালিচা সংবর্ধনা দেওয়া হয়। ৫৮ সদস্যের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিয়ে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী বেলা ২টার দিকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। এ সময় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তাকে গান স্যালুট ও গার্ড অব অনার দিয়ে অভ্যর্থনা জানান। বিমানবন্দর থেকে তাকে সরাসরি হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে তিনি কয়েক ঘণ্টা কাটান। অধ্যাপক ইউনূস মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সম্মানে হাই টি-এর আয়োজন করেন। মালয়েশিয়া বাংলাদেশে অষ্টম বৃহত্তম বিনিয়োগকারী দেশ। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বেশ কয়েকটি কোম্পানিসহ মালয়েশিয়ার প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশে ৫ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি বিনিয়োগ করেছে এবং এখন শিক্ষাসহ আরও বিনিয়োগ করতে ইচ্ছুক।
সন্ধ্যায় ঢাকা ত্যাগ
বাংলাদেশে সংক্ষিপ্ত সফর শেষ করে গতকাল সন্ধ্যায় কুয়ালালামপুরের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম গণমাধ্যমকে জানান, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী সন্ধ্যা ৭টার দিকে ঢাকা ত্যাগ করেন। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বিমানবন্দরে তাকে বিদায় জানান।